Web bengali.cri.cn   
 চীনের তৈরি যাত্রীবাহী বিমান
  2014-07-30 15:13:15  cri


গত ১৮ জুন দুপুর ১টা ২৮ মিনিটে চীনের তৈরি প্রথম বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী বিমান 'এআরজে-২১' সাংহাই বিমানবন্দর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে আকাশে ওড়ে এবং ২ ঘন্টা ৮ মিনিট আকাশে থাকার পর আবারো সাংহাই বিমানবন্দরে অবতরণ করে।

পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের পর বিমানের পাইলট চাও পেং বলেন- "'এআরজে-২১' বিমানটি এ ধরনের অন্য বিমানগুলোর চেয়েই এগিয়েই থাকবে বলে মনে করি। এটি দ্রুতগতির এবং স্থিতিশীল।"

'এআরজে-২১' চীনের তৈরি প্রথম বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী বিমান যেটি আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে। বিমানে রয়েছে ৭০ থেকে ৯০ আসন। অনেক দিক দিয়েই এটি এমনকি বোয়িং-৭৩৭-এর সাথে তুলনীয়। পরিকল্পনা পর্যায় থেকে পরীক্ষামূলক উড্ডয়নকাল পর্যন্ত 'এআরজে-২১' প্রকল্পের কাজ চলেছে গত ১৩ বছর ধরে। এ সময়কালে প্রকল্পটিকে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। অনেক দেশি-বিদেশি বিমান কোম্পানি এই বিমানের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে। এরই মধ্যে নির্মাতা কোম্পানি ২৫০টি বিমানের অর্ডার পেয়েছে।

'এআরজে-২১' প্রকল্পের উপ-পরিচালক কুও চি পো বলেন, বিমানটির সফল পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের মাধ্যমে চীনে তৈরি বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী বিমানের যুগ শুরু হলো। তার বিশ্বাস, অদূর ভবিষ্যতে 'এআরজে-২১' চীনের প্রতীক হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে অন্য ব্রান্ডের বিমানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। তা ছাড়া, এ প্রকল্পের অভিজ্ঞতা চীনের পরিকল্পিত সুপরিসর বিমান সি-৯১৯-এর জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সাংহাই বিমান নকশা ও গবেষণালয়ের গবেষক চৌ চি সেং বলেন, 'এআরজে-২১' এবং 'সি ৯১৯'-এর প্রযুক্তিগত মানদন্ড ও গবেষণাকাঠামো একই। বাজারে 'এআরজে-২১' হবে 'সি ৯১৯'-এর পাথফাইন্ডার বা অগ্রদূত। তিনি বলেন- "এআরজে-২১-এর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চীনের বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী বিমানশিল্প 'সি-৯১৯' পর্যায়ে পৌঁছাবে।"

সুপরিসর বিমান মানে বড় বিমান। এ ধরনের বিমানের যাত্রীধারণ ক্ষমতা ১৫০ বা তার ঊর্ধ্বে। বর্তমানে শুধু যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয ইউনিয়ন ও রাশিয়া সুপরিসর বিমান তৈরি করে থাকে। বর্তমানে বিশ্বে বেসামরিক বিমান চলাচল খাতে সুপরিসর বিমানের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বৈশ্বিক রাজনীতি ও সামরিক নীতির দৃষ্টিকোণ থেকেও এ প্রযুক্তির গুরুত্ব আছে।

বর্তমানে মার্কিন 'বোয়িং' ও ইউরোপের 'এয়ারবাস'-এর সুপরিসর বিমানগুলোই বিশ্ব বাজারের অনেকাংশ দখল করে আছে। কার্যকারিতা, গুণগত মান এবং বাজার দখলের ক্ষেত্রে এ দুটি জায়ান্ট বিমান নির্মাতা কোম্পানির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায় চীনের 'সি-৯১৯'।

আগামী ২০২০ সাল পর্যন্ত চীনের বেসামরিক বিমান চলাচল খাতে নতুন করে আরো ১৬০০টি সুপরিসর বিমান যুক্ত করতে হবে এবং সার্বিকভাবে যুক্ত করতে হবে তিন হাজার বিমান। চীনা বিমান ও মহাকাশ শিল্প উন্নয়ন গবেষণালয়ের গবেষক হুয়া ইউয়ু মিন বলেন, সুপরিসর বিমানের চাহিদার দিক দিয়ে বিশ্বে চীনের অবস্থান বর্তমানে দ্বিতীয়। তিনি বলেন- "আগমী ২০ বছরে এশিয়া ও চীনে যাত্রীবাহী বিমানের বাজার দ্রুত সম্প্রসারিত হবে। এটি আমাদের তৈরি বিমানের জন্য ভালো সুযোগ সৃষ্টি করবে। তখন এই বিরাট বাজারে বোয়িং ও এয়ারবাসের মতো আমাদের বিমানেরও চাহিদা সৃষ্টি হবে।"

স্বপ্ন সবসময় সুন্দর। কিন্তু স্বপ্নের বাস্তবায়ন অনেক কঠিন। ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত চীনে 'সি-৯১৯' নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে। এই দীর্ঘ পথচলায় ৪০টি প্রধান প্রযুক্তি আয়ত্ত করা হয়েছে, ১০০টি প্রযুক্তিগত বাধা দূর করা হয়েছে এবং ১৭০টিরও বেশি পেটেন্ট আবেদন করা হয়েছে।

এদিকে, চলতি বছরের মে মাসে সি-৯১৯-এর মূল বডির সামনের অংশের নির্মাণকাজ শেষ হয়। সি-৯১৯-এর প্রধান স্থপতি উ কুয়াং হুই বলেন- "নির্মিত এ অংশটি সি-৯১৯-এর প্রথম অংশ। আশা করছি, চলতি বছরেই বিমানের বাকি অংশগুলোর নির্মাণকাজ শেষ হবে।"

সি-৯১৯ প্রকল্পের দায়িত্বশীল ব্যক্তি চেং সিং হে বলেন, তৃতীয় প্রজন্মের অ্যালুমিনিয়াম-লিথিয়াম মিশ্রণ দিয়ে সি-৯১৯-এর বডি তৈরি করা হচ্ছে। চীনে তৈরি কোনো যাত্রীবাহী বিমানে এই প্রথম এ উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে। এ উপাদান ব্যবহারের ফলে বিমানের ওজন তুলনামূলকভাবে কম হবে।

তিনি বলেন- "সি-৯১৯-এর গবেষণায় ওজন, ঘর্ষণ ও নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করাই ছিল মূল বিষয়। অধিকরত নিরাপদ, স্বল্প ব্যয়ের এবং পরিবেশবান্ধব বিমান নিয়ে বোয়িং ও এয়ারবাসের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাই আমরা।"

সি-৯১৯ নির্মাণ প্রক্রিয়ায় চীনের নিজস্ব প্রযুক্তির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সর্বশেষ প্রযুক্তি যুক্ত করা হয়েছে। সাংহাই বিমান নকশা গবেষণালয়ের একটি বিশেষ বিভাগের উপ-প্রধান ছিয়ান চুং ইয়ান জানান, সি-৯১৯ প্রকল্পের সাথে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ উপকরণ সরবরাহকারীরা যুক্ত আছেন। তিনি বলেন-

"সিএফএম আমাদেরকে ইঞ্জিন সরবরাহ করছে। বোয়িং ও এয়ারবাসও এ কোম্পানির তৈরি ইঞ্জিন ব্যবহার করে। অন্যদিকে বিমান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সরবরাহ করছে বিশ্বখ্যাত 'হানিওয়েল' কোম্পানি। আমরা আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে শিখছি এবং তৈরি করছি নিজেদের বিমান।"

সি-৯১৯ 'এয়ারওর্দিনেস সার্টিফিকেট' অর্জনের প্রচেষ্টা ইতোমধ্যেই শুরু করেছে। এই সনদ অর্জন করা খুবই কঠিন। যখন একটি বিমান আকাশে ওড়ে তখন বজ্রবৃষ্টি, বাতাস, বিদ্যুত্ ও নিম্ন তাপমাত্রাসহ নানা সমস্যার সম্মুখীণ হয়। এ সনদ (airworthiness certificate) অর্জন করলে বুঝতে হবে যে, সংশ্লিষ্ট বিমানটি এসব সমস্যা কাটিয়ে নিরাপদে আকাশে উড়তে সক্ষম। বর্তমানে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নিজ নিজ মানদণ্ডের airworthiness certificate ইস্যু ব্যবস্থা চালু আছে। সি-৯১৯ এই তিনটি সনদই অর্জন করতে চায় এবং এভাবে পেতে চায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এ বিষয়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তি ছিয়ান চুং ইয়ানের যুক্তরাষ্ট্রে ১০ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা আছে। তিনি বোয়িং-৭৮৭-এর জন্য airworthiness certificate অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বোয়িং-৭৯৭ বিমানের প্রথম উড্ডয়ন দেখার পরই তার মনে দেশে ফিরে কিছু করার ভাবনা জাগ্রত হয়। তিনি বলেন- "আমার মনে আছে সেদিন আমি দীর্ঘ সময় অফিসে বসেছিলাম এবং হঠাত করেই আমার মনে হয়েছিল যে, আমার চীনে ফিরে আসা উচিত এবং নিজেদের সুপরিসর বিমান নির্মাণে ভূমিকা রাখা উচিত।"

বর্তমানে চীনে কাজ করছে ছিয়ান চুং ইয়ানের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক পেশাদার দল। এ দলটি নতুন বিমানের জন্য airworthiness certificate অর্জনের জন্য কাজ করে।

সুপরিসর বিমান তৈরি করা একটি জটিল ও বিশাল প্রকল্প। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে থাকে, চলতে থাকে পরিবর্তন-পরিবর্ধন। এই প্রক্রিয়ায় ছিয়ান চুং ইয়ান ও তার দলের কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

Commercial Aircraft Corporation of China Ltd-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা চিন চুয়াং লং বলেন, রোয়িং ও এয়ারবাসের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সক্ষম বিমান তৈরির জন্য চীনা কর্মীরা যে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তা অকল্পনীয়। এ কাজে প্রতিটি কর্মীর সহযোগিতা ও মনোযোগ প্রয়োজন। তিনি বলেন- "পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৬ সালে আমাদের বিমান বাজারে আসবে। আমরা চাই আমাদের তৈরি সুপরিসর বিমান যত দ্রুত সম্ভব নীল আকাশে উড়বে।"

আশা করা হচ্ছে, ২০১৫ সালে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে আকাশে উড়বে সি-৯১৯ বিমান। এরই মধ্যে বিদেশ থেকে সি-৯১৯-এর ৪০০টিরও বেশি অর্ডার পাওয়া গেছে। International Airlines Group-এর সিইও williw walsh-এর মতে বিশ্ববাজার ও বাজারের ক্লায়েন্টরা চীনের সুপরিসর বিমানের ওপর আস্থা প্রদর্শন করেছে। তিনি বলেন-

"বোয়িং ও এয়ারবাসের কর্মকর্তারা একাধিকবার চীনের সুপরিসর বিমানকে নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এশিল্পের উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে এবং বিমানের দামও যুক্তসংগত পর্যায়ে রাখতে সহায়তা করবে বলে আমি মনে করি।"

এয়ারবাসের প্রথম অক্ষর 'এ' এবং বোয়িংয়ের প্রথম অক্ষর 'বি'। আর চীনে তৈরি বেসামরিক সুপরিসর বিমানের নামের প্রথম অক্ষর 'সি'। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ভবিষ্যতের বেসামরিক বিমান উত্পাদন শিল্পে এই 'এ' 'বি' 'সি' নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকবে।

1 2
সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
Play
Stop
ওয়েবরেডিও
বিশেষ আয়োজন
অনলাইন জরিপ
লিঙ্ক
© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040