0618
|
চীনা অ্যারোস্পেস হাই-টেক হোল্ডিং কোম্পানি লিমিটেডের মার্কেটিং বিভাগের প্রধান লিউ চি কাং বলেছেন: "কুড়ি বছর আগে থেকেই তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট প্রতিটি কর্মী একটি স্বপ্ন দেখতেন। স্বপ্নটি হচ্ছে: তথ্যের মহাসড়কের সাথে যুক্ত হয়ে এবং তথ্য ভাগাভাগির মাধ্যমে বিশ্বায়ন বাস্তবায়িত করা। পরবর্তীকালে কেউ কেউ এ স্বপ্ন দেখা ছেড়ে দেন। কিন্তু কেউ কেউ জেদ ধরে বসে থাকেন। অবশেষে আমরা আবিষ্কার করি যে, বিশ্বের এক স্থানকে অন্য স্থানের সাথে প্রযুক্তির মাধ্যমে যুক্ত করে তথ্যের ভাগাভাগি সম্ভব এবং এর মাধ্যমে বিশ্বায়ন বাস্তবায়ন করা যায়।"
এ কথাগুলো খাটে চীনের পেই তো উপগ্রহ ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও। পেই তো উপগ্রহ ব্যবস্থা চীনের নিজস্ব আঞ্চলিক উপগ্রহ ব্যবস্থা যাকে মার্কিন জিপিএস এবং রাশিয়ার 'গ্লোনাস'-এর সাথে তুলনা করা যায়। এটি বিশ্বের তৃতীয় স্বাধীন উপগ্রহ ব্যবস্থা যা পরিবহণ, আবহাওয়া, জরুরি উদ্ধারকাজ ইত্যাদি বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজে লাগছে। এ ব্যবস্থার একটি ছোট নাম আছে, সেটি হচ্ছে: 'পি ডি এস'।
লিউ চু কাং বলেন: "ভবিষ্যতে আরও বেশি মোবাইল ডিভাইস ও ব্যক্তিগত যন্ত্রপাতিতে ডিপিএস প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে এবং তখন ব্যক্তির স্থান পরিবর্তন ও যানবাহন পরিবর্তন সম্পর্কে তাত্ক্ষণিকভাবে তথ্য জানা যাবে।"
যখন উপগ্রহের মাধ্যমে অবস্থান সম্পর্কে জানার প্রসঙ্গ আসে, তখন প্রথমেই আসবে মার্কিন জিপিএস ব্যবস্থার কথা। আসলে চীন বিশ্বের গুটিকতক দেশের একটি যেটি উপগ্রহের মাধ্যমে চালনপথ নির্ণয় করার প্রযুক্তি করায়াত্ত করেছে। গত শতাব্দীর ৬০ দশকে, জিপিএসের গবেষণা কাজ শুরু হয় এবং ঠিক তখনই চীন নিজস্ব উপগ্রহের মাধ্যমে একই ধরনের ফল পাওয়ার প্রচেষ্টা শুরু করে। কিন্তু শুরুর দিকে অর্থের অভাবে এ প্রকল্প বেশিদূর এগোয়নি। ১৯৯৪ সালে চীনা 'পেই তো' উপগ্রহ ব্যবস্থা স্থাপনের কাজ আবার শুরু হয়। বিগত ২০ বছর ধরেই 'পেই তো' উপগ্রহ ব্যবস্থাকে পূর্ণতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে চীন। এ সময় তিন পর্যায়ের একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চলে। পেই তো উপগ্রহ ব্যবস্থার প্রধান স্থপতি সুন চিয়া তুং বলেন- "এটা খুব বিশাল একটি প্রকল্প এবং এর নির্মাণ-প্রক্রিয়াও খুব জটিল। গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে আমরা 'পেই তো-এক' নামে একটি পরীক্ষা উপগ্রহ উত্ক্ষেপণ করি এবং সেটি ছিল আমাদের প্রথম পদক্ষেপ। এরই ভিত্তিতে আমরা একটি আঞ্চলিক উপগ্রহ নেভিগেশান ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করি। ২০২০ সালের মধ্যে আমরা বিশ্বব্যাপী কার্যকর একটি উপগ্রহ নেভিগেশান ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করব।"
সুন চিয়াও তুং বলেন, বর্তমানে দুটি পর্যায়ের কাজ সফলভাবে শেষ করেছে চীন এবং এরই মধ্যে ১৪টি উপগ্রহের সমন্বয়ে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে একটি উপগ্রহ নেভিগেশান ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০১২ সালের শেষ নাগাদ থেকে বেসরকারি সেবা প্রদান করতে শুরু করে পেই তো ব্যবস্থা। জি পি এস ও গ্লোনাস ব্যবস্থার সাথে প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম এই পেই তো ব্যবস্থা। এটি স্থিতিশীল ও নির্ভুল।
চালনপথ নির্ণায়ক 'পেই তো' ব্যবস্থার মূল ফল। প্রশ্ন হচ্ছে: কোনটার কাজ তুলনামূলকভাবে বেশি নির্ভুল? জিপিএস, নাকি পেই তো? চাং চিয়ান কুয়াং একজন ট্যাক্সি চালক এবং তিনি জিপিএস ও পেই তো—দুটোই ব্যবহার করে দেখেছেন। তিনি বলেন-
"একবার আমি পেইচিংয়ের চিন রং রাস্তায় গেলাম এবং দেখলাম উঁচু ভবনে পেই তো ব্যবস্থার সিগনাল তুলনামূলকভাবে বেশি স্পষ্ট।" চাং চিয়ান কুয়াংয়ের এই ভাবনা পে তো সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা দিতে পারে।
চাং চিয়ান কুয়াং আরো বলেন- "গ্যাস স্টেশন, পার্কিং এলাকা, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি যে কোনো কিছুর খোঁজ পেতে আমাকে পেই তো সাহায্য করে।"
বর্তমানে যানবাহনেই পেই তো ব্যবস্থার ব্যবহার সবচে বেশি। পেই তো ব্যবস্থার তত্ত্বাবধানে দুর্ঘটনার হার কমতে বাধ্য। বর্তমানে চীনে দেড় লাখ গাড়িতে পেই তো প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। পেই তো উপগ্রহ নেভিগেশান ব্যবস্থার পরিবহন বিভাগের উপ প্রধান লি চিং বলেন-
"এ ব্যবস্থার মাধ্যমে আমরা ব্যবহারকারীদের পাঠিয়ে থাকি ট্রাফিক অবস্থার তাত্ক্ষণিক তথ্য এবং বিপজ্জনক পথ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্যও তাদের স্মরণ করিয়ে দিই। "
মত্স্য শিল্পেও পেই তো ব্যবস্থার ব্যাপক ব্যবহার আছে। জেলেরা এ ব্যবস্থার মাধ্যমে জানতে পারে নিজেদের অবস্থান বা তাদের মাছ-ধরা নৌকার অবস্থান। বিশেষ পরিস্থিতিতে তারা নৌ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ্ও করতে পারে। জানা গেছে, চীনে প্রায় ৫০ হাজার মাছ-ধরা নৌকায় বর্তমানে পেই তো প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ে মত্স্য কেন্দ্রের তথ্য বিভাগের প্রধান হুয়াং চিয়ান কুয়াং বলেন, পেই তো-র এসএমএস পাঠানোর বিশেষ কৌশল ত্রাণকার্য চালানোর সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। হুয়াং চিয়ান কুয়াং বলেন-"চলতি বছরের প্রথমার্ধে লিয়াও নিং প্রদেশের ছাং হাই জেলায় রাত ৯টায় একটি মাছ-ধরা নৌকার তলা ফুটো হয়ে ডুবে যাচ্ছিল। তখন জাহাজের জেলেরা পেই তো প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের সাহায্য চায়। আমাদের ত্রাণ দল নৌকাটি ডুবে যাওয়ার ঠিক ১০ মিনিট আগে ৮ জন জেলের সবাইকে জীবিত উদ্ধার করে।"
পরিবহন ও মত্স্য খাত ছাড়া, ভবিষ্যতে পেই তো ব্যবহার অন্যান্য খাতে সম্প্রসারণের ওপরও নজর রাখছেন সংশ্লিষ্টরা। চলতি বছরের মে মাসে AEROSPACE HI-TECH HOLDING GROUP C0.,LTD পেই তো গাড়ি নেটওয়ার্ক ও জাহাজ নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা উপহার দেয়। কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগের প্রধান লিউ চি কাং বলেন, গাড়ি নেটওয়ার্ক ও জাহাজ নেটওয়ার্ক সাধারণ নাগরিকদের আরও বেশি মূল্যবান সেবা দিতে পারবে এবং প্রত্যেকে এ ব্যবস্থা থেকে উপকৃত হবেন। তিনি বলেন- "গাড়ি নেটওয়ার্ক মানে পেই তো ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষের সাথে গাড়ির, গাড়ির সাথে গাড়ির এবং গাড়ির সাথে পথের সংযোগ স্থাপন করা। চীনা জাতীয় অর্থনীতিতে পণ্য স্থানান্তরের ভূমিকা বেশি এবং আমাদের এ ব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।"
চীনে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের অনেকেই বর্তমানে পেই তো প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। চীনা বোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোও আজকাল বিশেষ ধরনের ফোন তৈরি করছে, যেগুলোতে পেই তো প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়।
জানা গেছে, চীনে বিক্রিত নেভিগেশান ডিভাইসের মোট সংখ্যা ৩৪ কোটি ৮০ লাখ এবং এর মধ্যে ৩৩ কোটি ৩০ লাখ ডিভাইসই স্মার্টফোনে পাওয়া যাচ্ছে। ২০১৩ সালের শেষ নাগাদ চীনে পেই তো ডিভাইসের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩ লাখে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আগামী দুই বছরে 'ভিহিকেল নেভিগেশান' ব্যবহারকারীর সংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে যাবে এবং এশিল্পের মূল্য ১০০০০ কোটি ইউয়ান হবে। অন্যদিকে, ২০১৫ সালে চীনা নেভিগেশান শিল্পের আকার হবে ২২৫০০ কোটি ইউয়ান।
উপগ্রহ নেভিগেশন শিল্প প্রতি বছর ৩০-৪০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে এবং ২০২০ সালে এর মোট মূল্য ৪০০০০ কোটি ইউয়ানে হবে বলেও অনুমান করা হচ্ছে। সম্ভবত তখন পেই তো প্রযুক্তি ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ হবে।
পেই তো ব্যবস্থা চীনা তথ্য শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে। পেই তো সিং থুং কোম্পানির সি ই ও চৌ রু সিন বলেন, ভবিষ্যতে পেইতো ব্যবস্থা আরও বেশি বিষয়ে কাজে লাগবে। যেমন, প্রবীণ ও শিশুদের তত্ত্বাবধান ও যত্ন নেওয়া এবং মোবাইল ফোনের অবস্থান নিশ্চিত্ করা ইত্যাদি।
তা ছাড়া, পেই তো ব্যবস্থা নিয়ে থাইল্যান্ড,পাকিস্তান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা করছে চীন। ইতোমধ্যেই থাইল্যান্ডের ১০ হাজারেরও বেশি ট্যাক্সিতে পেই তো প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।
২০২০ সাল পর্যন্ত চীনের পেই তো উপগ্রহ ব্যবস্থায় মোট উপগ্রহের সংখ্যা দাঁড়াবে ৩০টিতে। তখন বিশ্বব্যাপী এ ব্যবস্থা সেবা দিতে পারবে।