0402lvyou
|
চীনের কথা বললেই যে শব্দটি আমাদের মনে প্রথম উঁকি দেয় তা হচ্ছে: চীনের মহাপ্রাচীর। একে চীনা ভাষায় বলা হয় 'ছাংছং' । 'ছাংছং'-এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে দীর্ঘ দেয়াল।এটি মানুষনির্মিত বিশ্বের সবচে বড় স্থাপনা।কথিত আছে, চাঁদ থেকেও এই স্থাপনা অবলোকন করা যায়। বিশ্বের সপ্তম আশ্চর্যের একটি হচ্ছে চীনের এইমহা প্রাচীর। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হওয়ার পাশাপাশি এটি চীনের জাতীয় প্রতীকও বটে। তাহলে চলুন বন্ধুরা বেড়িয়ে আসি চীনের মহা প্রাচীর থেকে।
শ্রোতাবন্ধুদের মনে একটি প্রশ্নের উদয় হতে পারে। প্রশ্নটি হচ্ছে: হাজার হাজার বছর আগে কেন এতো জনবল,সম্পদ,সময় ব্যয় করে এই মহা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল? আসলে এই মহা প্রাচীর নির্মাণের প্রধান লক্ষ্য ছিল বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করা।
ছিন ডাইন্যাস্টিতে মং চিয়াং নূ নামে একজন খুব সুন্দর এবং দয়ালু মেয়ে ছিল। একদিন সে তার বাড়ির উঠোনে কাজ করার সময় হঠাত্ দেখতে পেল উঠোনের আঙুরের মাচার নীচে একজন লোক লুকিয়ে আছে। দেখে আতঙ্কে চিত্কার করে উঠার মুহূর্তে লোকটি হাত নেড়ে অনুনয়-বিনয় করে বললো, দয়া করে চিত্কার করবেন না। আমাকে সাহায্য করুন,আমাকে বাঁচান। আমার নাম ফান সি লিয়াং,আমি পালিয়ে এসেছি।আসল ব্যাপার হচ্ছে, তত্কালীন রাজা ছিন শি হুয়াং মহা প্রাচীর নির্মাণের জন্য লোকজন ধরে এনে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য করতেন। এতে যে কতো মানুষ ক্লান্তিতে ও অনাহারে মৃত্যুবরণ করেছে তার সংখ্যা কারো জানা ছিলনা। তো, মং চিয়াং নূ তাকে লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করলেন। পরে লোকটি জ্ঞান-গরিমা,ভদ্রতা ও সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে ভালোবেসে ফেলে মং চিয়াং নু। এদিকে ফান সি লিয়াংও প্রেমে পড়ে যান তার। তারা দুজনে ঠিক যেন দুটি দেহ একটি প্রাণ,তাদের আত্মা যেন একই বাঁধনে বাঁধা। পরে বাবা-মায়ের সম্মতিতে দুজন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
বিয়ের সেই শুভদিনে কনের বাড়িতে সাজ সাজ রব, আলোক সজ্জার ঝলকানি ও অতিথিদের পদচারণায় মুখর পুরো বাড়িতে উৎসবের আমেজ। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমে আসে,পান ও ভোজনরত অতিথিরাও ধীরে ধীরে ফিরে যাচ্ছিলেন নিজ নিজ বাড়ি। নব্য বিবাহিত বর-বধূ বাসরঘরে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হঠাত্ মুরগীর আতঙ্কে ডানা ঝাপটানো আর কুকুরের অস্থির ও বিকট ঘেউ ঘেউ শব্দ শোনা গেল। বাড়িতে প্রবেশ করলো একদল সৈন্য,কোন কিছু না-বলেই লোহার শেকলে বন্দী করে ফান সি লিয়াংকে নিয়ে গেল প্রাচীর নির্মাণে শ্রমিক হিসেবে কাজ করানোর জন্য। বিয়েবাড়ির আনন্দমুখর পরিবেশে নিমেষেই নেমে আসে শোকের ছায়া। নববধু স্বামীর দুঃখে আর বিরহে কাতর হয়ে পরে। হঠাত্ সে ভাবল, বাড়িতে বসে দুশ্চিন্তা না-করে আমি নিজেই মহাপ্রাচীরে তাকে খুঁজতে যাই না কেন! যেই ভাবা সেই কাজ। মং চিয়াং নূ জিনিসপত্র গুছিয়ে পথে নেমে পড়লো। পথে শত বাঁধা-বিপত্তি,ঝড়-বৃষ্টি,তুষারপাত উপেক্ষা করে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো, কোন কষ্টকে কষ্ট না মনে করে, এক ফোঁটা চোখের পানি না ফেলে, স্বামীর প্রতি গভীর ভালবাসায় উদ্দীপ্ত হয়ে দৃঢ় মনোবল নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকলো তার গন্তব্যের দিকে। অবশেষে মহা প্রাচীর নির্মাণ স্থলে পৌঁছে দেখতে পেল বিভিন্ন দল বিভিন্ন অংশে বিভক্ত হয়ে প্রাচীরের দেয়াল নির্মাণ করছে। সে প্রতিটি অংশে খুঁজতে লাগলো ফান সি লিয়াং কে। কিন্তু কোথাও তার ছায়াও দেখতে পেলনা। অবশেষে সাহস সঞ্চয় করে একদল শ্রমিককে জিজ্ঞেস করলো, 'তোমাদের এখানে ফান সি লিয়াং নামে কেউ আছে? আছে, নতুন এসেছে। উত্তর দিল একজন। মং চিয়াং নূ খুশিতে আত্মহারা হয়ে সাথে সাথে জানতে চাইল, ' কোথায় সে? শ্রমিক উত্তর দিল, সেতো বেঁচে নেই! প্রাচীরের দেয়ালের নীচে তাকে সমাধিস্থ করা হয়েছে।এ খবর শুনে মং চিয়াং নূ'র মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল, চোখের সামনে আঁধার নেমে আসলো, ব্যাথিত হৃদয়ে সে কাঁদতে শুরু করল, কাঁদল তিনদিন তিন রাত ধরে,কাঁদল সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত। তার হৃদয়বিদারক কান্নায় আওয়াজ শুনে আকাশের মনও যেন ভারি হয়ে গেল। আকাশ ধীরে ধীরে মেঘাচ্ছন্ন হয়ে গেল, ভয়ংকর ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু করলো। হঠাত্ বিকট শব্দে ধসে পড়লো প্রাচীরের একটি অংশ, দেয়ালের নীচে উন্মুক্ত হল ফান সি লিয়াঙ্গের শবদেহ। তার রক্তাক্ত চেহারা ভেসে গেল তার প্রিয়তমা স্ত্রীর চোখের পানিতে। এতো কষ্ট আর অপেক্ষার পর অবশেষে স্বামীর দেখা পেল সে, কিন্তু ফান সি লিয়াং দেখতে পেল না তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে!
চীনের মহাপ্রাচীর মানুষের হাতে তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থাপত্য। এই প্রাচীর প্রায় ৫ থেকে ৮ মিটার উঁচু এবং ৮৮৫১.৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ। এটিশুরু হয়েছে সানহাই পাস থেকে এবং শেষ হয়েছে লোপনুর নামক স্থানে। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী থেকে শুরু করে প্রায় ২০০০ বছর পর্যন্ত এর নির্মাণ,সংস্কার, পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের কাজ চলতে থাকে। এর মূল অংশের নির্মাণ শুরু হয়েছিল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২২১ সালে। চীনের প্রথম সম্রাট ছিন শি হুয়াং বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে তাঁর নবনির্মিত সাম্রাজ্য নিরাপদ রাখতে নির্মাণ করেন মহাপ্রাচীরের বিভিন্ন অংশ। তবে সেই সময়ে নির্মিত প্রাচীরের তেমন কিছুই আজ আর অবশিষ্ট নেই। পরবর্তী ডাইন্যাস্টিগুলোতে এর নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ অব্যাহত থাকে। তবে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ছিন,হান এবং মিং ডাইন্যাস্টি। এই তিনটি ডাইন্যাস্টি মিলে নির্মিত প্রাচীরের দ্যৈর্ঘ প্রায় ১০০০০ কিলোমিটারের অধিক। বর্তমানে চীনের সিনচিয়াং, কানসু, নিনশিয়া, চিয়াংশি, ইনার মঙ্গোলিয়া, শানসি, হোপেই, পেইচিং, থিয়েনচিন, লিয়াওনিং, চিলিন, হোইলুংচিয়াং, হোনান, শান্তুং, হুপেই ইত্যাদি অঞ্চলে মহাপ্রাচীরেরপ্রাচীনঅংশেরধ্বংসাবশেষরয়েছে।
এই মহা প্রাচীর নির্মাণের স্বর্ণযুগ হচ্ছে মিং ডাইন্যাসটি (১৩৬৮-১৬৪৪)। বর্তমানে আমরা মহা প্রাচীরের যে অংশগুলো দেখতে পাই, তা মূলত মিং ডাইন্যাস্টিতে নির্মিত। এই সময়ে নির্মিত অংশ ৩৭৩ মাইলের বেশি দীর্ঘ। এতে রয়েছে ৮২৭ টি শহর প্রাচীর প্ল্যাটফর্ম,৭১টি গিরিপথ এবং অগুনিত দুর্গ। মিং রাজার সময়ে নির্মিত প্রাচীরের যে অংশগুলো মোটামুটি ভালোভাবে সংরক্ষিত রয়েছে সেগুলো হচ্ছে: পাতালিং, মুথিয়ানাইয়ু, সিশাথাই, চিনশানলিং, হুয়াং হুয়া চং, কুপেইখৌও, চিয়ানখৌও ইত্যাদি।
তবে এর মধ্যে দেশি বিদেশি পর্যটকদের মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয় হচ্ছে 'পাতালিং' । মহা প্রাচীরের এই অংশটিই প্রথম সাধারণ পর্যটকদের জন্যে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল। বেইজিং শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার উত্তরে ইয়ানছিং কাউন্টিতে এর অবস্থান। মিং ডাইন্যাস্টিতে এটি ভৌগোলিক ও সামরিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দুপাশের অপরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ এর সৌন্দর্যে যোগ করেছে বাড়তি মাত্রা। র বছরের ৪টি ঋতুতে উপভোগ করা যায় চার ধরনের সৌন্দর্য। শীতকালে শুভ্র তুষারে ঢাকা প্রাচীর যেমন আপনার মনে এনে দিতে পারে এক ধরনের পবিত্র প্রশান্তি,তেমনি বসন্তের রঙবেরঙের ফুল আপনার মনকে করে তুলবে উত্ফুল্ল। গ্রীষ্মকালে গ্রেট ওয়ালের চারপাশের সবুজ স্নিগ্ধ পরিবেশ আর ঝিরিঝিরি বাতাস প্রশান্ত করবে আপনার মন ও হৃদয়কে।