0226lvyou
|
আলিম. Angkor wat ক্যাম্বোডিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সিয়েম রিপ শহরে অবস্থিত। এটি একটি প্রাচীন মন্দির কমপ্লেক্স। শুরুতে এটি ছিল একটি হিন্দু মন্দির। পরে এটি বৌদ্ধ মন্দিরে পরিণত হয়। একসময় এর নাম ছিল 'ভিরাহ বিষ্ণুলোক'। দ্বাদশ শতাব্দীতে রাজা দ্বিতীয় সুরিয়াভার্মানের নির্দেশে পাথরের এই মন্দির নির্মাণ করা হয়। হাজার হাজার শ্রমিক ৩৫ বছর ধরে মন্দিরটি নির্মাণ করে। তখন অঞ্চলটির নাম ছিল 'ইয়াশোধারাপুরা'। ১৯৯২ সালে অ্যাঙ্কর ওয়াত বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে। বিশ্বের পর্যটকদের কাছে দারুণ আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয় দর্শণীয় স্থাপত্য এটি। অ্যাঙ্কর ওয়াত এখন ক্যাম্বোডিয়ার প্রতীক। আরেকটি কথা, অ্যাঙ্কর ওয়াত অর্থ 'মন্দির শহর' বা 'সিটি অব টেম্পলস'।
সুবর্ণা. প্রতি বছরের নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ক্যাম্বোডিয়ার শীতকাল। তখন তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে উঠানামা করে। তখন পর্যটনের মৌসুম। অ্যাঙ্কর ওয়াত ক্যাম্বোডিয়ার ঐতিহ্যিক স্থাপত্য শিল্পের সবচে চমত্কার নিদর্শন। ভারতীয় মহাকাব্যের গল্প অনুযায়ী এটি নির্মাণ করা হয়েছে। মন্দিরের পূজাবেদী তিন স্তরবিশিষ্ট। এটি ভারতের মহাকাব্যে বর্ণিত বিশ্বকেন্দ্র 'সুমেরু' পাহাড়ের প্রতীক। ১২৯৬ সালে চীনের ইউয়ান রাজবংশের কর্মকর্তা চৌ তা কুয়ান ক্যাম্বোডিয়া সফর করেছিলেন। তিনি তখন অ্যাঙ্কর ওয়াতও পরিদর্শন করেছিলেন। কর্মকর্তা সেখানে এক বছর বসবাস করেন এবং চীনে ফিরে আসার পর স্থানীয় অঞ্চলের রীতিনীতি সম্পর্কে একটি বই রচনা করেন। ১৫৮৬ সালে ইউরোপের একজন পর্যটনবিদ আনদোনিও অ্যাঙ্কর ওয়াত পরিদর্শন করেন। তার রিপোর্টেও এ চমত্কার স্থাপত্যের চমত্কার বর্ণনা স্থান পেয়েছিল। কিন্তু তখন সেটি তেমন করে কারোর নজর কাড়েনি। ১৮৬১ সালের জানুয়ারি মাসে ফরাসি জীববিজ্ঞানী হেনরি মুও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় পশুদের নিয়ে গবেষণা করার সময় ক্যাম্বোডিয়ার আদিম বনে এ সুন্দর ও মহান পুরাকীর্তি দেখতে পান এবং তাঁর বইয়ে মন্দিরের স্পষ্ট বর্ণনা দেন। এরপর থেকেই অ্যাঙ্কর ওয়াত বিশ্ববিখ্যাত হয়ে যায়। ১৮৬৬ সালে আলোকচিত্রশিল্পী এমিল দেল কিসেল (emil del kissel) নিজের ক্যামেরা দিয়ে অ্যাঙ্কর ওয়াতের ছবি তোলেন।
আলিম. ১৯০৭ সালে থাইল্যান্ড সিয়েম রিপসহ বিভিন্ন দখলকৃত ভূমি ক্যাম্বোডিয়ার কাছে ফেরত দেয়। ১৯০৮ সালে ফ্রান্সের দূরপ্রাচ্য ইনস্টিডিউট অ্যাঙ্কর ওয়াত পুরাকীর্তি উদ্ধারের কাজ শুরু করে এবং ১৯১১ সালে সেকাজ সম্পন্ন হয়। এসময় মূলত মন্দির কমপ্লেক্সের ওপর বছরের পর বছর ধরে জমে ওঠা মাটি আর লতাপাতা অপসারণের কাজ করা হয়। বিংশ শতাব্দীর ৩০-এর দশকে অ্যাঙ্কর ওয়াতের সংস্কারকাজ শুরু হয়। স্থাপত্যে ব্যবহৃত একই ধরনের কাঁচামাল দিয়ে অ্যাঙ্কর ওয়াত মেরামতের কাজটি ছিল খুবই সময়সাপেক্ষ আর কঠিন। ৬০-এর দশকে ক্যাম্বোডিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে মেরামত কাজ বন্ধ থাকে এবং নব্বইয়ের দশকে তা পুনরায় শুরু হয়।
সুবর্ণা. অ্যাঙ্কর ওয়াতের চারদিকে ১৯০ মিটার প্রস্থের একটি জলপূর্ণ পরিখা বা খাল আছে। পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে এর দৈর্ঘ্য ১৫০০ মিটার এবং দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে দৈর্ঘ্য ১৩৫০ মিটার। সবমিলিয়ে পরিখাটির দৈর্ঘ্য ৫৭০০ মিটার। অ্যাঙ্কর ওয়াতের চার পাশে লাল রঙয়ের পাথর দিয়ে সাজানো দেয়াল আছে। পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে দেয়ালের দৈর্ঘ্য ১০২৫ মিটার এবং দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে এর দৈর্ঘ্য ৮০২ মিটার; দেয়ালের উচ্চতা ৪.৫ মিটার। দেয়ালের তিন দিকে মাঝবরাবর তিনটি বড় আকারের সিংহতোরণ আছে। তিনটি তোরণের কাছেই আছে লম্বা ও বিস্তৃত রাস্তা। প্রাচীনকালে এ রাস্তা দিয়ে হাতি চলাচল করতো বলে অনুমান করা হয়।
আলিম. অ্যাঙ্কর ওয়াতের দক্ষিণ দিকে একটি দেবীর ভাষ্কর্য্য আছে। দেবী তার সুন্দর দাঁত বের করে হাসছেন। এ ধরনের ভাষ্কর্য্য আছে এই একটিই। মন্দির চত্বরের মোট আয়তন ৮২ হেক্টর। মাঝখানের মন্দির ছাড়া এ চত্বরে প্রাচীনকালে অন্যান্য স্থাপনা ও রাজপ্রাসাদ ছিল। কিন্ত সেসব ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এখন সেসগুলোর জায়গা দখল করেছে ঘন জঙ্গল। তবে ওসব স্থাপনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা রাস্তার চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে। মন্দিরের স্তম্ভ,পাথর দেয়াল, জানালাসহ বিভিন্ন স্থানে সুন্দর ও চমত্কার খোদাই-এর কাজ দেখা যায়। এসব খোদাইকাজের মাধ্যমে মূলত হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর কাহিনী ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ভারতের মহাকাব্য 'মহাভারত' ও 'রামায়ণে' বর্ণিত যুদ্ধ, রাজপরিবারের কর্মকাণ্ড, রান্না ও কৃষি কাজসহ বিভিন্ন দৃশ্য ফুটে উঠেছে এসব খোদাইকর্মে। এসব খোদাই শিল্পকর্ম অত্যন্ত সূক্ষ্ম। বিভিন্ন দেবতার ভঙ্গি ও চরিত্র স্পষ্টভাবে এতে ফুটে উঠেছে। বিশ্বের পাথর খোদাই শিল্পকর্মের চমত্কার প্রতীক এগুলো।
সুবর্ণা. আচ্ছা, অ্যাঙ্কর ওয়াতের কিছু তথ্য তুলে ধরার পর এখন স্থানটি পরিদর্শনসম্পর্কিত কিছু টিপস জানিয়ে দিই। দুপুর বেলায় সেখানকার আবহাওয়া অতি গরম থাকে। তাই অ্যাঙ্কর ওয়াত পরিদর্শনের কাজটি ভোরবেলায় শুরু করলে ভালো। সঙ্গে নিতে হবে সানস্ক্রিন, টুপি ও ছাতা। স্থানীয় অঞ্চলের রীতিনীতি অনুসরণ করে লম্বা টিসার্ট ও পায়জামা পড়ে মন্দির পরিদর্শনে যেতে হবে।
আলিম. অ্যাঙ্কর ওয়াত-এর আশেপাশেও অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। এর মধ্যে বাখেং (bakheng) পাহাড় খুবই জনপ্রিয়। এটি অ্যাঙ্কর ওয়াতের উত্তর-পশ্চিমে ১.৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এর উচ্চতা মাত্র ৬৭ মিটার। পর্যটকরা পাহাড়ের চূড়ায় উঠে অ্যাঙ্কর ওয়াতের পুরো দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন। সূর্যাস্তের সময় অনেক পর্যটক পাহাড়ের চূড়া থেকে অ্যাঙ্কর ওয়াতের সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করতে পছন্দ করেন। চাইলে হাতির পিঠে চড়েও পাহাড়ে উঠা যায়। পাহাড়ে একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আছে, এর নাম 'নম বাখেং' (Phnom bakheng)। বিধ্বংস্ত এই মন্দিরটিই এতদঞ্চলের প্রথম মন্দির। মন্দিরের উত্তরে ক্যাম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের সীমান্ত।
সুবর্ণা. ক্যাম্বোডিয়ার এ অঞ্চলের হাজার হাজার মন্দিরের মধ্যে একটি লাল রঙয়ের মন্দির দারুণ সুন্দর ও বৈশিষ্ট্যময়; এর আরেক নাম 'নারীর কেল্লা'। সিয়েম রিপের পশ্চিম দিকে অবস্থিত এ মন্দিরের পুরনো নাম 'বানদেরেস'; ক্যাম্বোডিয়ার স্থানীয় ভাষায় যার অর্থ 'সুখ খুঁজে পাওয়া'। স্থানীয় অঞ্চলের লোকেরা এ মন্দিরকে 'রাণীর প্রাসাদ' বলে ডাকে। কারণ, মন্দিরের মাঝখানে আছে দেবী অপ্সরার মূর্তি। মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল ৯৬৭ সালে। শত শত বছর ধরে এটি গভীর বনে লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিল। ১৯১৪ সালে মন্দিরটি এক ফরাসি সৈন্যের নজরে আসে।
আলিম. প্রিয় শ্রোতা, আমার মনে হয়, শুধু আমাদের বর্ণনার মাধ্যমে আপনারা এ চমত্কার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাবেন না। সে জন্য নিজের চোখে দেখা প্রয়োজন। সুযোগ পেলে আপনারা সেখানে বেড়াতে যাবেন বলে আশা করি। অ্যাঙ্কর ওয়াতের পরিদর্শনের জন্য টিকিট কাটতে হয়। একদিনের জন্য ২০ মার্কিন ডলার, ৩ দিনের জন্য ৪০ মার্কিন ডলার এবং ৭ দিনের জন্য আপনাকে কাটতে হবে ৬০ মার্কিন ডলারের টিকিট। আপনি যে কয়দিনের টিকিট কাটবেন, সে কয়দিন এ অঞ্চলের বিভিন্ন দর্শণীয় স্থান পরিদর্শনে যেতে পারবেন।