Web bengali.cri.cn   
চীনে নতুন শহরায়ন বাস্তবায়ন
  2014-01-22 15:33:29  cri

২০০১ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী জোসেফ ই স্টিগলিত্জ (Joseph E Stiglitz) পূর্বাভাস করেছিলেন, একবিংশ শতাব্দীতে মানবজাতির উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হবে যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং চীনের শহরায়ন। এর পাশাপাশি নতুন শতাব্দীতে চীনের জন্য তিনটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে প্রথমটিই শহরায়ন। গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বা চ্যালেঞ্জ - যাই হোক না কেন শহরায়ন বর্তমানে চীনের সবচেয়ে বেশি আলোচ্য বিষয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি উন্নয়ন লক্ষ্য।

সম্প্রতি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ১৮তম জাতীয় গণকংগ্রেসের তৃতীয় পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন এবং শহরায়ন কেন্দ্রীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে চীনের শহরায়ন উন্নয়নের কৌশল ও দিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। চীনের শহরায়নকে এগিয়ে নেওয়া দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি জরুরি বিষয়।

ছাব্বিশ বছর বয়সী মি. লি একজন গ্রামীণ শ্রমিক। ২০০৮ সালে তিনি পেইচিংয়ে আসেন এবং বিদ্যুত্-মিস্ত্রী হিসেবে নির্মাণস্থলে কাজ করেন। তিনি আমাদের সাংবাদিককে জানান, প্রতিদিন তিনি সাড়ে ৮ ঘন্টা কাজ করেন এবং সাধারণত ছুটি পান না। মি. লি বলেন, তিনি যেদিন যেদিন কাজ করেন, কেবলমাত্র সেই সব দিনের বেতন পান বলে তিনি ছুটি নিতে চান না। এভাবে ছুটিহীনভাবে কাজ করে প্রতি মাসে তিনি ৫ হাজার ইউয়ান আয় করতে পারেন। লি ও তার স্ত্রী একসাথে কাজ করতেন, কিন্তু সন্তানের যত্ন নেওয়ার জন্য এক বছর আগে তার স্ত্রী জন্মস্থানে ফিরে যান। বাড়িতে টাকা পাঠানোর জন্য লি নিজে যতটা সম্ভব কম ব্যয় করেন। আমাদের সংবাদিকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, প্রতি মাসে তিনি মাত্র ৩০০ ইউয়ান ব্যয় করেন। লি সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে পেইচিংয়ে বাস করতে চান, কিন্তু পেইচিংয়ে বাসা ভাড়া করা বা কেনা তার জন্য একটি অসম্ভব ব্যাপার।

মি. লি বলেন, বড় নগরে বসবাস করতে পছন্দ করলেও এখানে পারিবারিক ও সামাজিক নিশ্চয়তা নেই। ২০১১ সালে চীনে শহুরে লোকসংখ্যা ছিল ৬৯ কোটি ১০ লাখ এবং শহরায়নের হার ছিল ৫১.২৭ শতাংশ। ওই বছর প্রথম বারের মতো গ্রামীণ লোকসংখ্যাকে ছাড়িয়ে যায় শহরের লোকসংখ্যা। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ৬৯ কোটি ১০ লাখ শহুরে জনসংখ্যার মধ্যে ১৫ কোটি ৯০ লাখ গ্রামীণ শ্রমিক। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গ্রামীণ শ্রমিক শহরে বসবাস করে, তবে বাসস্থান, সমাজকল্যাণ ও শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের সমান অধিকার নেই।

নান চিং নোর্মল্ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী সি ছাং। এখান থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর সহপাঠিদের মতো তিনিও পেইচিং, শাংহাই ও কুয়াং চৌয়ের মতো বড় কোনো নগরে কাজ করতে চান। সি ছাং মনে করেন, বড় শহরে সুযোগও বেশি। তিনি বলেন:

"আমি একটি গ্রামীণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি এবং আমার পরিবার চায় যে, আমি নান চিংয়ের মতো বড় শহরে কাজ করি। আমার জন্মস্থানের চেয়ে নান চিংয়ে চাকরির সুযোগ বেশি। আমি যদি গ্রামে ফিরে যাই তাহলে আমি কেবল কোনো সাধারণ কাজ করতে পারবো, যার ভাল ভবিষ্যত নেই।"

চীনে চিকিত্সা ও শিক্ষা স্থাপনার অধিকাংশ শহরে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সারাদেশের চিকিত্সা স্থাপনার ৮০ শতাংশ বড় বড় শহরে এবং এর মধ্যে ৩০ শতাংশ বড় হাসপাতাল শহরে বলে মানুষ সেখানে বাস করতে চায়। পঞ্চাশ লাখ ও তার বেশি জনসংখ্যা-বিশিষ্ট অনেক বড় শহর রয়েছে চীনে। ২০১২ সালে রাজধানী পেইচিংয়ের জনসংখ্যা ছিল ২ কোটি ৬ লাখ ৯৩ হাজার। ছিংহুয়া লোকপ্রশাসন কলেজের প্রধান সিউয়ু লান এ বিষয়ে বলেন:

"মানুষ এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হলে পানিসহ বিভিন্ন সম্পদের চাহিদা বাড়ে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। এতে কুয়াশাসহ নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়। আমি মনে করি, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শহর শহরায়নের প্রধান অবস্থানে পরিণত হওয়া উচিত্।"

শহর-সমস্যা মানে বড় নগরে লোকসংখ্যা কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণে সৃষ্ট ধারাবাহিক সামাজিক সমস্যা। শহর নির্মাণ নির্বিচারে নিকটবর্তী অঞ্চলে প্রসারিত হয় এবং এতে অনেক আবাদী জমি দখল, জনসংখ্যা বিস্ফোরণ, যানজট, পরিবেশের অবনতি, বাসস্থানের সংকট এবং কর্মসংস্থান হ্রাসসহ নানা সমস্যার উদ্ভব হয়। আবার সমস্যাগুলো শহরের উন্নয়নের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বড় নগরে একদিকে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ হয় আর উল্টোদিকে মাঝারি ও ক্ষুদ্র শহরে অনেক ফাঁকা আবাসিক অঞ্চল পড়ে থাকে। উন্নত মানদণ্ড অনুযায়ী নির্মিত এসব বাড়িতে কোনো অধিবাসী থাকে না এবং রাতে সামান্য সংখ্যক আলো জ্বলার কারণে গোটা অঞ্চল অন্ধকারে ঢেকে যায়। সেকারণে মানুষ এ রকমের আবাসিক এলাকাগুলোকে প্রেতপুরীর শহর বলে। দক্ষিণ–পূর্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের শহর পরিকল্পনা ও নকশা গবেষণালয়ের উপ-পরিচালক তুয়ান চিন বলেন:

"আমার মনে হয়, শহরায়নের প্রক্রিয়ায় চীন আগে কিছুটা ভুল পথে চলেছে। আমরা সবসময় শহরায়নকে একটি মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করেছি এবং ভেবেছি শহরায়নের হার যত বেশি, তত উন্নত পর্যায়ে পৌঁছেছি। এ ভুল ধারণার কারণে চীনে বড় বা ছোট সব ধরনের শহরের আয়তন বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় শহরায়ন সম্মেলনে নতুন শহরায়নের জন্য প্রধান করণীয় উপস্থাপন করা হয়। এতে বলা হয়, ভবিষ্যত শহরয়ান হওয়া উচিত্ গণমুখী। শহরের মানোন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান স্থিতিশীল হওয়ার ভিত্তিতে ধীরে ধীরে নগরে বসবাসকারী মানুষ নাগরিকে পরিণত হয়। জ্বালানির ব্যবহার হার বৃদ্ধি এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন হ্রাস করার মাধ্যমে পরিবেশ-বান্ধব ও নিম্নকার্বন্ উন্নয়ন বাস্তবায়িত হয়। পরিবেশ সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব দিয়ে বন, হ্রদ ও জলাভূমিসহ সবুজ স্থানের আয়তন বাড়নোর কথা বলা হয় সম্মেলনে। ঐতিহ্য রক্ষা এবং স্থানীয় ও জাতীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সুন্দর শহর ও জেলা নির্মাণ এবং পাহাড় ও নদীর কোলে মানুষেদর বসবাসের কথাও বলা হয় এতে। তুয়ান চিন বলেন:

"আসল কথা হলো পাহাড় ও নদীর কোলে থাকা মানে আবাসিক অঞ্চল ও প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে সুন্দর ঐক্যতান।"

বর্তমানে চীন নতুন শহরায়ন পরিকল্পনা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। নতুন শহরায়ন মানে শুধু শহরের আয়তন বাড়ানো বা নতুন শহর নির্মাণ নয়; মানুষের উত্তম জীবনযাপনের চাহিদা মেটানোও। কৃষকদের স্বপ্ন হল শহরের অধিবাসীদের মতো বেশী আয় করা, ভাল চিকিত্সা সেবা পাওয়া, উন্নত মানের জীবনযাপন করা এবং সন্তানদের ভাল শিক্ষা ব্যবস্থা করা। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব প্রত্যাশা পূরণের জন্য মাঝারি ও ক্ষুদ্র শহর উন্নয়ন সবচেয়ে ভাল উপায়। মাঝারি ও ক্ষুদ্র শহরে জায়গা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি এবং সেখানে বিরাটাকারের স্থানান্তরের দরকার হয় না।

চীনের পরিকল্পনা হল ২০২০ সাল নাগাদ শহরায়নের হার ৬০ শতাংশ অতিক্রম করা। শহরায়নের হার ৩০ থেকে ৬০ শতাংশে উন্নীত করতে ব্রিটেনের লেগেছে ১৮০ বছর, যুক্তরাষ্ট্রের ৯০ বছর ও জাপানের ৬০ বছর। কিন্তু চীনের লাগবে মাত্র ৩০ বছর। বর্তমানে উন্নত দেশগুলোতে শহরায়নের হার ৮০ শতাংশ বা তার বেশি এবং তাদের তুলনায় চীনকে অনেক কিছু করতে হবে। চীনে জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশনের শহর ও জেলা উন্নয়ন কেন্দ্রের গবেষক উয়াং ইউয়ু বলেন:

"ইউরোপীয় ও আমেরিকান দেশ বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শহরায়ন প্রায় শেষ হয়েছে। বর্তমানে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক সংস্কার শহরায়নের ওপর নির্ভর করে না। তবে চীনে শহরায়ন চলছে দ্রুত গতিতে এবং এ প্রক্রিয়ায় চীনে অনেক পরিবর্তন হতে পারে।"

গত ৩০ বছরে চীনের ১০-১২ কোটি কৃষক শহরে এসেছে তবে যারা শহরে আসতে চায় তাদের সংখ্যা আরও বেশি। চীনের সমাজবিজ্ঞান একাডেমির এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, শহরে প্রবেশ করতে চায় চীনে এমন কৃষকের সংখ্যা ২০২০ সাল পর্যন্ত ছিল ৩০ কোটি এবং ২০৩০ সালে এ সংখ্যা হবে ৩৯ কোটি। এর মানে আগামী ১০-২০ বছরে চীনে যেসব কৃষক শহরে প্রবেশ করবে তাদের সংখ্যা হবে যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার সমান। শহরায়ন প্রক্রিয়ায় চীনের জন্য চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ সমান।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক