Web bengali.cri.cn   
চীনের মিং রাজ্য আমলের শেষ দিকের বিখ্যাত কৃষি বিজ্ঞানী শিউ গুওয়াং ছি সম্পর্কে
  2013-11-26 16:24:22  cri
শিউ গুওয়াংয় ছির জন্মস্থান বতর্মান শাংহাই শহরের উপকন্ঠে। পাশ্চাত্য দেশগুলোর প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সাথে দেশকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং চীনের কৃষি, জলসেচসহ বিজ্ঞান ও কারিগরি উন্নয়নের ক্ষেত্রে তিনি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন চীনের মিং রাজবংশ আমলের শেষ দিকের একজন বিখ্যাত কৃষি বিজ্ঞানী।

শিউ গুওয়াং ছি একটি ব্যবসায়ী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। একসময় তার দাদা একজন নাম-করা ব্যবসায়ী ছিলেন। কিন্তু তার বাবা ব্যবসা জানতেন না। সুতরাং শিউ গুয়াং ছির জন্মের পর তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়ে গেল। তাই শিশু শিউ গুওয়াং ছিকে পড়াশুনার পাশাপাশি পারিবারিক কাজ করতে হতো। তবে তিনি মেধাবী ছেলে ছিলেন। মন দিয়ে পড়াশুনা করতেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি বিভিন্ন বই পড়তে শুরু করেন। অল্প বয়সে তিনি ভাল নিবন্ধ ও কবিতা লিখতে পারতেন। নিবন্ধে তার নিজের ধারণা থাকতো। খুব তাড়াতাড়ি তার খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

শিউ গুওয়াং ছির বয়স ২০ বছর বয়সে রাজদরবারের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন। তিন্তু তিনি বারবার পরীক্ষায় ব্যর্থ হচ্ছিলেন। কারণ, নিয়োগ পরীক্ষায় নিজের পছন্দের একটি বিষয়ের ওপর নিবন্ধ লিখতে হতো। শিউ গুয়াং ছি প্রতিবারই লিখতেন সমাজ ও সমাজের মানুষ নিয়ে। কিন্তু তার সেইসব সুচিন্তিত লেখা কর্তৃপক্ষের পছন্দ হতো না। এই জন্য তিনি বারবার রাজদরবারের নিয়োগ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হচ্ছিলেন। পরে তিনি বুঝতে পারলেন যে, কর্মকর্তা হওয়া তার পক্ষে কঠিন। তিনি তখন শিক্ষকতা পেশা বেছে নিলেন। শিক্ষাদানের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন বই পড়ে নানা ধরনের জ্ঞান আহরণ করতে শুরু করেন। একবার তিনি সুদূর গুওয়াংসি অঞ্চলে শিক্ষকতা করতে গিয়েছিলেন। সেখানে দু'বছর শিক্ষাদানের পর তার চিন্তার ক্ষেত্রে অনেক পরিপক্ক হয়।

যখন তার বয়স ৩৫ বছর তখন তিনি আরেকবার রাজদরবারের আয়োজিত নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিলেন। এবার পরীক্ষার প্রধান পরীক্ষক ছিলেন তত্কালীন নাম-করা পন্ডিত জিও হং। শিউ গুওয়াং ছির লেখা নিবন্ধ পড়ে তিনি মুগ্ধ হলেন। তিনি অবাক হলেন। তিনি বেশ কয়েকবার শিউ গুওয়াং ছির নিবন্ধ পড়লেন। অবশেষে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন: " কী চমত্কার নিবন্ধ! আমি তো এর আগে কখনো এত সুন্দর নিবন্ধ পড়িনি! এই নিবন্ধের লেখকেরই এবার পরীক্ষায় প্রথম হওয়া উচিত।" অবশেষে শিউ গুওয়াং ছি রাজদরবারের আয়োজিত নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান।

শিউ গুওয়াং ছির পদ ছিল বতর্মান সমাজ বিজ্ঞান একাডেমির একজন গবেষকের সমান। তার দায়িত্ব ছিল ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করা। তিনি ছিলেন এই গবেষণা গ্রুপের একজন নেতা। শিউ ছি গুওয়াং ইতিহাস ভালোই জানতেন। কিন্তু তার মন সবসময় পড়ে থাকতো প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের কাছে। তিনি প্রাচীনকালের অনেক বই পড়তেন। কিন্তু অন্ধভাবে প্রাচীনকালের মানুষের কথা বিশ্বাস করতেন না। কোনো তত্ত্ব বা তথ্যকে সত্য বলে ধরে নেওয়ার আগে তিনি নিজে সেটি কয়েকবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতেন।

মিং রাজবংশ আমলের শেষ দিকে ইউরোপের অনেক মিশনারি চীনে ধর্ম প্রচার করতে আসেন। এ সব মিশনারির মধ্যে একজন ইতালীয় মিশনারি ছিলেন। তার নাম ছিল লিমাডো। গণিত বিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, জলসেচসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার পড়াশোনা ছিল। ১৬০০ সালে এই ইতালীয় মিশনারির সঙ্গে শিউ ছি গুওয়াংয়ের পরিচয় হয়। দু'জন খুব তাড়াতাড়ি বন্ধুও হলেন। শিউ গুওয়াং ছি মাঝে মাঝে এই মিশনারির কাছে যেতেন। সেখানে তিনি অনেক বই পড়তেন। এসব বই এর আগে শিউ ছি গুওয়াং পড়েননি। একদিন শিউ গুওয়াং ছি লিমাডোকে বললেন: "ফাদার, আপনার কাছ থেকে নিয়ে আমি যেসব বই পড়েছি, সেগুলোর কোনো কোনোটি খুব ভাল। আমি চীনা ভাষায় অনুবাদ করতে চাই। আপনি যদি অনুমতি দেন তো।" ফাদার লিমাডো বললেন: "আপনি কী কী ধরনের বই চীনা ভাষায় অনুবাদ করতে চান?" "গণিতবিদ্যা তো সব বিজ্ঞানের ভিত্তি। আমি প্রথমে গণিতবিদ্যার বই অনুবাদ করবো।" শিউ গুওয়াং ছি উত্তর দিলেন।

কিন্তু গণিতবিদ্যার বই অনুবাদ করা সহজ কাজ ছিল না। অনুবাদের সময় তাকে অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। মাঝে মাঝে ফাদার লিমাডো ভাঙ্গা ভাঙ্গা চীনা ভাষায় শিউ ছি গুওয়াংকে বইএর বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা করতেন। সাধারণত দিনের বেলায় তারা দু'জন একসঙ্গে থাকতেন। তারপর রাতের বেলায় শিউ ছি গুওয়াং তার অনুবাদ কাজ করতেন। কোনো কোনো একটি শব্দে অর্থ নিয়ে তিনি সারারাত চিন্তা করতেন। তার স্ত্রী শিউ ছি গুওয়াংয়ের পরিশ্রম দেখে একদিন বললেন: "চীনের কত বই আছে! এসব বিদেশি বই চীনা ভাষায় অনুবাদ করার কী দরকার! দেখ, বইটি অনুবাদ করতে তুমি কী পরিশ্রমটাই না করছ!" শিউ গুওয়াং ছি তার স্ত্রীকে বললেন: "তুমি জান না। এই বিদেশি বই একটি অত্যন্ত মূল্যবান বই। যদি আমি অনুবাদ না-করি তাহলে চীনের অনেক লোক এর জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হবে।" তারপর তিনি বইটির মূল বিষয় তার স্ত্রীকে ব্যাখ্যা করলেন। শিউ ছি গুওয়াংয়ের প্রচেষ্টায় দুই বছর পর এই গণিতবিদ্যা বই-এর অনুবাদ কাজ সম্পন্ন হল। এই অনূদিত বই এখন পযর্ন্ত চীনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যবহার করা হচ্ছে।

মিং রাজবংশের শেষ দিকে পাশ্চাত্য দেশগুলো চীনের ওপর আক্রমণ করতে শুরু করে। প্রথমে পতুর্গাল চীনের ম্যাকাও দখল করে নেয়। পরে নেদারল্যান্ডস দখল করে নেয় চীনের তাইওয়ান। শিউ গুওয়াং ছি এই অবস্থা দেখে অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। তিনি বেশ কয়েকবার রাজাকে চিঠি লিখে দেশকে শক্তিশালী করে তোলার প্রস্তাব দিলেন। একদিন শিউ ছি গুওয়াং তার বাসায় কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছিলেন। বন্ধুরা প্রায় একসঙ্গে তাকে জিজ্ঞেস করলেন: "আজকাল আপনি মাঝে মাঝে আমাদের সঙ্গে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। আমাদের বলুন, বতর্মানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ কী? আমাদের কী করা উচিত?" শিউ গুওয়াং ছি উত্তর দিলেন: "একটি দেশকে সমৃদ্ধ করতে হলে প্রথমে কৃষি উন্নয়ন করতে হবে। দেশকে শক্তিশালী করে তুলতে হলে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ জোরদার করা উচিত। কিন্তু ঠাং রাজবংশ থেকে বিভিন্ন রাজবংশ কৃষির প্রতি গুরুত্ব দেয়নি। রাজদরবারে কৃষিবিষয়ক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাও ছিল না। কারণ, যারা জ্ঞানী লোক তারা কৃষি সম্পর্কে শিখতে চান না। এমনকি, অনেক কৃষকও কৃষি কাজ ছেড়ে ব্যবসা করতে পছন্দ করেন। এটি সত্যই শোচনীয় এক পরিস্থিতি।" তার কথা শুনে বন্ধুদের মধ্যে একজন বললেন: "আপনি ঠিকই বলেছেন। একটি দেশের জন্য কৃষি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কৃষি সম্পর্কে আমাদের কোন জ্ঞান নেই। এ সম্পর্কে আপনার কোনো ভাল ধারণা আছে?" শিউ গুওয়াং ছি বললেন: "অনেকদিন আগে থেকেই আমি কৃষি বিষয়ক একটি বই লিখতে চেয়েছি। এই বইতে আমি কৃষি সম্পর্কে জ্ঞানের সারসংকলন করবো। আমি যে বই লিখবো তাতে চাষবাসের পদ্ধতি, ঋতু, জলবায়ু, জলসেচ ও কৃষি যন্ত্রপাতিসহ নানা ধরনের জ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তা ছাড়া, বইটিতে জলসেচ সম্পর্কে পাশ্চাত্য দেশগুলোর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার কথাও বর্ণনা করা হবে।"

শিউ গুওয়ং ছির লেখা কৃষিবিষয়ক বইটির মোট ৬০ খণ্ডে বিভক্ত ছিল। তিনি প্রায় সারা জীবন ব্যয় করে গেছেন বইটি রচনা করতে। এই বই ছিল চীনের ইতিহাসে প্রথম কৃষিবিজ্ঞান সম্পর্কিত বই। বলা বাহুল্য, চীনের কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিউ ছি গুওয়াংয়ের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক