খুয়ে শিয়ান জন্মগ্রহণ করেন বতর্মান চীনের চিয়াংসু প্রদেশের উ জেলায়। ছোটবেলা থেকে তিনি তার বাবার কাছ থেকে ছুতার কৌশল শিখতে শুরু করেন। তার বাবা একজন নাম-করা ছুতার মিস্ত্রী ছিলেন। খুয়ে শিয়ান খুব মেধাবী ছিলেন। তিনি ছুতার কৌশল খুব তাড়াতাড়ি শিখে ফেললেন। যখন তার বয়স ১৫ বছর তখন, চারদিকে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়লো। স্থানীয় লোকজন খুয়ে শিয়ানের কাজের অত্যন্ত প্রশংসা করতেন।
একবার তত্কালীন রাজা মিং জেন জু পেইচিং পরিদর্শন করলেন। পেইচিং রাজার পছন্দ হল। তিনি রাজধানী নানচিং থেকে পেইচিংয়ে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। রাজা সারা দেশ থেকে দক্ষ ছুতার ও রাজমিস্ত্রি বাছাই করার নির্দেশ দিলেন। তিনি পেইচিংয়ে রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করতে চান। সেই রাজপ্রাসাদই হল বতর্মানের পেইচিং নিষিদ্ধ নগর। সে যাই হোক, রাজার কর্মকর্তারা খুয়ে শিয়ানকেও দক্ষ ছুতার মিস্ত্রী হিসেবে বাছাই করলেন। যাদের বাছাই করা হয়েছে তাদের মধ্যে অধিকাংশের বয়স বেশী ছিল। তাদের মধ্যে শিয়ানের বয়স সবচে কম। তখন তার বয়স মাত্র ২০ বছর। একজন প্রবীণ ছুতার খুয়ে শিয়ানকে উপহাস করে বললেন: "যুবক, তুমি কী ধরনের কাজ করতে পার? তোমার কি রাজপ্রসাদ নির্মাণের সাহস আছে?" "আমি আপনার মতো দক্ষ লোকের কাছ থেকে শিখতে এসেছি মাত্র।" উত্তর দিলেন খুয়ে শিয়ান। বৃদ্ধ ছুতার মিস্ত্রী অবাক হলেন।
এক সময় রাজপ্রাসাদের নির্মাণ কাজ শুরু হলো। প্রতিদিন খুয়ে শিয়ান ওই প্রবীণ মিস্ত্রীর সঙ্গে কাজ করেন। তাদের কাজ ছিল বাড়ির কাঠে ড্রাগনের ছবি আঁকা। এই কাজ অত্যন্ত সূক্ষ্ম। বিন্দুমাত্র ভুল হতে পারবে না। কয়েক দিন পর দেখা গেল, প্রবীণ মিস্ত্রীর চেয়ে খুয়ে শিয়ান দ্বিগুণ কাজ সম্পন্ন করেছেন। খুয়ে শিয়ানের কাজ দেখে এই প্রবীণ ছুতার মিস্ত্রী অবাক হয়ে গেলেন। কারণ খুয়ে শিয়ানের আঁকা ড্রাগন ছিল অত্যন্ত জীবন্ত। দেখে মনে হয় ড্রাগন আকাশে উড়ছে। তিনি আপনমনে বললেন: "চমত্কার কাজ! আমি এর আগে কোনোদিন এত সুন্দর ছবি দেখিনি।" তারপর তিনি খুয়ে শিয়ানের হাত ধরে বললেন: "তোমার আঁকা ছবি সত্যিই খুব ভাল। তুমি কীভাবে এত তাড়াতাড়ি আঁকতে পার? তোমার কোনো বিশেষ কৌশল আছে কি?" খুয়ে শিয়ান উত্তর দিলেন: "আসলে আমার কোনো বিশেষ কৌশল নেই। আমাদের দু'জনের মধ্যে পাথর্ক্য এই যে, আপনি একটি হাত দিয়ে ছবি এঁকেছেন, কিন্তু আমি দু'ই হাত দিয়ে এঁকেছি। সুতরাং আপনার চাইতে আমি বেশী তাড়াতাড়ি আঁকতে পারি।" খুয়ে শিয়ান দু'হাতে ছবি আঁকতে পারেন জেনে অনেকেই তার কাছে এসে বললেন: "দয়া করে আমাদের সামনে দু'হাত দিয়ে ছবি আঁকুন। আমরা সবাই দেখতে চাই।" খুয়ে শিয়ান বিনয়ের সঙ্গে বললেন: "আমার কৌশল বেশী পরিপক্ক নয়। কোন ভুল হলে মাফ করবে।" তারপর তিনি দু'হাত দিয়ে সবার সামনে ছবি আঁকতে শুরু করলেন। তার কাজ দেখে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে গেলেন। এরপর খুয়ে শিয়ানের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। কিন্তু তিনি সবসময় প্রবীণদের সামনে বিনয় প্রকাশ করতেন, তাদেরকে শ্রদ্ধা করতেন। প্রবীণরাও তার আচার-ব্যবহারের প্রশংসা করতেন। পরে রাজাও খুয়ে শিয়ানের দক্ষতা সম্পর্কে অবগত হলেন। একদিন রাজা খুয়ে শিয়ানকে ডেকে পাঠালেন। তিনি খুয়ে শিয়ানকে রাজপ্রাসাদ নির্মাণ কাজের একজন কর্মকতা নিয়োগ করলেন। তখন থেকে খুয়ে শিয়ান গোটা রাজপ্রাসাদের নকশার দায়িত্ব পান।
রাজপ্রাসাদ নির্মাণদলের একজন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর তিনি রাজপ্রাসাদের তিনটি বড় ভবন ও প্রধান দ্বারকে বতর্মান তিয়েন আন মেনের অংশ হিসেবে চিন্তা করেন। এই চিন্তা মাথায় রেখে তিনি বর্তমান তিয়েন আন মেনের নকশা করেন। তিয়েন আন মেনের নকশায় তিনি দক্ষিণ চীন ও উত্তর চীনের স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ ঘটান। তার নকশা শেষ হওয়ার পর তিনি অন্যদের কাছ থেকে পরামর্শ জানতে চেয়েছিলেন। তার নকশা দেখে সবাই প্রশংসা করলেন। তারপর তিনি তিয়েন আন মেনের নকশা রাজাকে দিলেন। রাজা নকশা দেখে সন্তুষ্ট হন। তিনি নকশার আলোকে তিয়েন আন মেন চত্ত্বর গড়ে তুলতে সম্মত হন।
রাজপ্রাসাদের নির্মাণ কাজ তো বিরাট প্রকল্প। নকশা করা কঠিন। কিন্তু নকশা অনুসারে নির্মাণ করা তো আরও কঠিন ব্যাপার। অনেক মূল্যবান কাঠ চীনের বিভিন্ন জায়গা থেকে আনতে হলো। সি ছুয়েন, গুওয়াসি ও ইউয়েন্নানের বিভিন্ন জায়গা থেকে পেইচিংয়ে কাঠ এলো। রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করতে বিশেষ ধরনের পাথর দরকার। পেইচিংয়ের নিকটবর্তী জায়গায় এ ধরনের পাথর ছিল না। এ সব পাথর সেনসি ও হোনান প্রদেশের কোন কোন জায়গা থেকে আনতে হয়। এতদূর থেকে এ সব পাথর পরিবহন করা সহজ কাজ ছিল না। দু:খের ব্যাপার এই যে, এসব কাঠ ও পাথর পেইচিংয়ে আনার পথে অনেক শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছিল। খুয়ে শিয়ান ও অন্যান্য কর্মীর প্রচেষ্টায় কয়েক বছর পর রাজপ্রাসাদ তথা বর্তমানের নিষিদ্ধ নগরের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। এই স্থাপত্য বিশ্বের ইতিহাসে একটি বিষ্ময় বলে গণ্য করা হয়।
জীবনের ষাট বছরের বেশী সময় খুয়ে শিয়ান পেইচিংয়ে অনেক রাজকীয় ভবনের নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে তার অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তার কীর্তির পুরস্কারস্বরূপ রাজা খুয়ে শিয়ানকে রাজদরবারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নিয়োগ করেছিলেন। তার পদ ছিল বতর্মানের নির্মাণ মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রীর সমান। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হওয়ার পর খুয়ে শিয়ানের আচার-ব্যবহার ঠিক আগের মতোই ছিল। তিনি কোনসময় অহংকার করতেন না।তিনি সবসময় ছুতারের যন্ত্রপাতি সঙ্গে রাখতেন। একদিন একজন কর্মকর্তা তাকে জিজ্ঞেস করলেন: "স্যার, আপনি এখন তো অনেক সম্মানিত ব্যক্তি। আপনি কেন ছুতারের যন্ত্রপাতি সঙ্গে রাখেন?" খুয়ে শিয়ান উত্তর দিলেন: "আমি কোনদিন নিজেকে বড় মনে করি না। আমি আসলে একজন সাধারণ ছুতার। ছুতারের কাজই আমার সারা জীবনের কাজ। আমি কোনোদিন ছুতারের কাজ ছাড়তে পারবো না। আমাকে একজন সাধারণ ছুতার মনে করলে খুশি হবো।" খুয়ে শিয়ানের কথা শুনে এই কর্মকর্তা মুগ্ধ হলেন।
রাজদরবারের সবাই খুয়ে শিয়ানকে সম্মান করতো। এমনকি রাজাও তার ওপর খুব সন্তুষ্ট ছিলেন। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, পরে খুয়ে শিয়ানের বংশধরের মধ্যে অনেকেই বিখ্যাত ছুতার মিস্ত্রী হয়েছিলেন। মিং ও ছিং রাজবংশ আমলে খুয়ে শিয়ানের জম্মস্থান চিয়ানসু প্রদেশের উ জেলায় অনেক বিখ্যাত ছুতারের জন্ম হয়েছিল।