Web bengali.cri.cn   
চীনের পশ্চিম হান রাজ্য আমলের মহিলা রাজনীতিবিদ জু উয়েন জুয়েন সম্পর্কে
  2013-11-05 14:10:22  cri
জু উয়েন জুয়েন চীনের পশ্চিম হান রাজ্য আমলের একটি বড় ব্যবসায়ী পরিবারের মেয়ে ছিলেন। ১৭ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। কিন্তু তার স্বামী বেশিদিন বাঁচেননি। পরে বিখ্যাত সাহিত্যিক সি মা শিয়েনলুর সঙ্গে তার প্রেম হয়েছিল। তিনি সাহসের সঙ্গে তত্কালীন সামন্ততান্ত্রিক প্রথা-রেওয়াজ ভেঙ্গে সি মা শিয়েনলুকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তাদের জীবনে অনেক দু:খ-কষ্ট এলেও, তিনি কোনোদিন স্বামীর কাছে তা নিয়ে অভিযোগ করেননি। পরে তিনি হয়ে ওঠেন চীনের ইতিহাসের একজন অন্যতম জ্ঞানী ও সাহসী নারী।

ছোটবেলায় জু উয়েন জুয়েন ছিলেন খুব মেধাবী। তিনি দেখতেও খুব সুন্দর ছিলেন। তার বাবা তাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি জু উয়েন জুয়েনের জন্য একজন গৃহশিক্ষক নিয়োগ করেছিলেন। গৃহশিক্ষক প্রতিদিন তার বাসায় এসে জু উয়েন জুয়েনকে কবিতা পড়াতেন। জু উয়েন জুয়েন দ্রুত শিখতে পারতেন। কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি জেলার অন্যতম জ্ঞানী মেয়ে হিসেবে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। সবাই তার যোগ্যতা সম্পর্কে জানতেন। তিনি চমত্কার বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন। একদিন যখন জু উয়েন জুয়েন বাড়ির দোতলায় একটি বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছিলেন, তখন তার বাবা বাইরে থেকে তার কক্ষে ঢুকলেন। তিনি হাসিমুখে মেয়েকে বললেন: "তোমাকে একটি সুখবর দেব।" জু উয়েন জুয়েন বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন: "কী সুখবর, বাবা? তোমাকে এত খুশি খুশি লাগছে কেন?" বাবা পকেট থেকে একটি লাল রঙয়ের কাগজ বের করে আবেগের সঙ্গে মেয়েকে বললেন: "জেলা শহরের ধনী ব্যবসায়ী ছেনছেনের ছেলে তোমাকে বিয়ে করতে চায়। আমিও রাজি হয়েছি। কারণ, তার পরিবার কেবল ধনী তা নয়, খুব প্রভাবশালীও বটে।" বাবার কথা শুনে জু উয়েন জুয়েন বললেন: "আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। কারণ আমার বয়স কম। আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই।" "বোকা মেয়ে কোথাকার! তুমি বড় হয়েছ। মেয়েরা চিরকাল বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে না।" জু উয়েন জুয়েনের বাবা কথা শেষ করে নিচের তলায় নেমে যাওয়া জন্য রওয়ানা হলেন। জু উয়েন জুয়েন চট করে বাবার হাত ধরে বললেন: "বাবা, শুনেছি ছেলেটি মন দিয়ে পড়াশুনা করে না। সারাদিন সে কেবল আমোদ-প্রমোদ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমি কোনদিন এ ধরনের ছেলেকে বিয়ে করব না।' বাবা বললেন: "তার পড়াশুনার সাথে তোমার ভালো থাকা বা না-থাকার কোনো সম্পর্ক নেই। তার পরিবারের অনেক টাকা। তার সঙ্গে বিয়ে হলে সারাজীবনের জন্য তোমার থাকা-খাওয়ার কোনো চিন্তা থাকবে না।" জু উয়েন তখন একটু কঠিন কণ্ঠে বললেন: "এর মানে, তোমার মেয়ের বিয়ে হবে অর্থের সঙ্গে, কোনো মানুষের সঙ্গে নয়!" এবার বাবা খুব রেগে গেলেন। তিনি বললেন: "চুপ কর! প্রাচীনকাল থেকে এ পযর্ন্ত বাবা-মাই মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে এসেছে। তুমি রাজি থাক বা না-থাক, এই ছেলের সঙ্গেই তোমার বিয়ে হবে। আমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।" অবশেষে ওই ধনী পরিবারের ছেলের সঙ্গেই জু উয়েন জুয়েনের বিয়ে হল। কিন্তু বিয়ের মাত্র এক বছর পর তার স্বামী মারা যান। তখন তার বয়স মাত্র ১৮ বছর। স্বামীর মৃত্যুর পর শ্বশুরবাড়িতে তার ওপর নির্যাতন চালানো হতো। কারণে-অকারণে তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি তাকে ধমক দিতেন। এই ধরনের নির্যাতন সইতে না-পেরে জু উয়েন জুয়েন বাবার কাছে ফিরে আসেন।

বাবার কাছে ফিরে আসার পর শ্বশুর-শ্বাশুড়ি বেশ কয়েকবার লোক পাঠিয়ে তাকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন। কিন্তু জু ফিরে যেতে রাজি হননি। একদিন তার বাবার আমন্ত্রণে অনেক নাম-করা পন্ডিত তাদের বাসায় হাজির হলেন। তার বাবা সমাজের জ্ঞানী লোকদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পছন্দ করতেন। সেদিন স্থানীয় প্রায় সকল নাম-করা পন্ডিত এসেছিলেন। তাদের মধ্যে তত্কালীন দেশবিখ্যাত পন্ডিত সি মা শিয়েনলুও ছিলেন। যখন সব অতিথিরা বাসায় উপস্থিত হলেন তখন জু উয়েন জুয়েন দুই তলায় তার নিজের কক্ষে বসে বই পড়ছিলেন। তার বাবা এসে মেয়েকে বললেন: "উয়েন জুয়েন, তুমি কি জান আজকে স্থানীয় কর্মকর্তা ও পন্ডিত ছাড়া আর কে আমাদের বাসায় এসেছেন?" "আর কে আমাদের বাসায় আসতে পারেন?" উয়েন জুয়েন গম্ভীর কন্ঠে উত্তর দিলেন। "বিখ্যাত পন্ডিত সি মা শিয়েনলু আজকে বিশেষ অতিথি হিসেবে আমাদের বাসায় এসেছেন।" বাবা গর্বিতভাবে বললেন। "সি মা শিয়েনলু! যিনি ইতিহাস সম্পর্কে বিখ্যাত বিখ্যাত সব বই লিখেছেন? তিনি আজকে আমাদের বাসায় এসেছেন!?" উয়েন জুয়েন বিষ্ময় ও আনন্দের সঙ্গে বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন। "অবশ্যই। বতর্মান রাজাও সি মা শিয়েনলুর লেখার প্রশংসা করেন।" উয়েন জুয়েন সি মা শিয়েনলুর বই পড়েছেন। তিনি সি মা শিয়েনলুর বুদ্ধি ও জ্ঞানেরও ভক্ত ছিলেন। তিনি কল্পনা করতে পারেননি যে, এই মহাপণ্ডিত ব্যক্তি একদিন তাদের বাসায় বেড়াতে আসবেন। তিনি দ্রুত বাবার সঙ্গে নিচ তলায় আসলেন এবং উপস্থিত অতিথিদের আপ্যায়ন করতে লাগলেন। একসময় উয়েন জুয়েনের বাবা সবার সমানে ঘোষণা করলেন: "শুনুন, আজকে আমাদের মাননীয় বিশেষ অতিথি সি মা শিয়েনলু সকলের জন্য বাদ্যযন্ত্র বাজাবেন। সবাই জানেন, সি মা শিয়েনলু কেবল ভাল নিবন্ধ ও কবিতা লিখতে পারেন তাই নয়, তিনি ভালো বাদ্যযন্ত্রও বাজাতে পারেন।" বাড়ির দোতলা থেকে বাদ্যযন্ত্র এনে উপস্থিত সুধীমণ্ডলীর সামনে রাখা হল। সবাই হাততালি দিলেন। সি মা শিয়েনলু দাঁড়িয়ে বললেন: "আজকে আমি আসলে এখানে স্রেফ দাওয়াত খেতে আসিনি, এসেছি মনের মতো একজন বন্ধুর খোঁজেও। যেহেতু সবাই আমাকে বাদ্যযন্ত্র বাজানোর অনুরোধ করেছেন, আমি আমার সেই মনের মানুষের জন্য বাজাবো।" তারপর তিনি বসে বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শুরু করলেন। উয়েন জুয়েন তখন সি মা শিয়েনলুর কথা বুঝতে পারেননি। ব্যাপার ছিল এই যে, আসলে সি মা শিয়েনলু জেলার গভর্নরের কাছ থেকে শুনেছেন যে, এই পরিবারে একজন জ্ঞানী মেয়ে আছে। তিনি শুনেছেন যে, মেয়েটি ভাল কবিতা লিখতে পারে এবং বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারে। এসব শুনে তিনি মনে মনে মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেলেছিলেন। আর অনুষ্ঠানে এসে তাকে দেখে তার পছন্দও হল। তিনি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শুরু করলেন। তিনি বাদ্যযন্ত্র বাজানোর পাশাপাশি গানও গাইছিলেন। গানের কথাগুলো ছিল মোটামুটি এমন: "বসন্তের বাতাসের জন্মস্থানে ফিরে এসেছি আমি ভালবাসার খোঁজে/ একটি সুন্দর এবং জ্ঞানী মেয়ে এখন একলাই থাকে/ সে এখন ঠিক আমার সামনে দাঁড়িয়ে, অথচ মনে হয় কতো দূরে/ আমি তাকে আমার জীবনসঙ্গীনী হিসেবে বাছাই করতে চাই/ তাকে কোনোদিন ছেড়ে যেতে চাই না..."। উয়েন জুয়েন কিন্তু সি মা শিয়েনলুর গাওয়া গানের অর্থ বুঝে ফেললেন। গানটি যে তাকে উদ্দেশ্য করেই গাওয়া হয়েছে, তা বুঝতে পেরে উয়েন জুয়েনের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। তিনি দ্রুত দোতলায় নিজের ঘরে চলে গেলেন।

ভোজনপর্ব শেষ হওয়ার পর অতিথিরা চলে গেলেন। উয়েন জুয়েনের বাবা দোতলায় তার ঘরে আসলেন। তিনি মেয়েকে জিঙ্গেস বললেন: "আশ্চর্য ব্যাপার! জেলার গভর্নরের মাধ্যমে সি মা শিয়েনলু তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন! তুমি কি রাজি আছ?" উত্তরের জন্য অপেক্ষা না-করে বাবা আরো বললেন: "দেখ মা, তোমার একবার বিয়ে হয়েছিল। তোমার আবার বিয়ে হওয়া সম্ভব নয়।" "আমাকে কি আজীবন একা থাকতে হবে?" জিজ্ঞেস করলেন উয়েন জুয়েন। "অবশ্যই। এটাই নিয়ম। বিয়ের পর স্বামী মারা গেলে একটি মেয়েকে তার বাকি জীবন একাই থাকতে হয়। শোনো, এখন থেকে কোনোদিন তুমি সি মা শিয়েনলুর নাম উচ্চারণ করবে না। তার সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই তোমার বিয়ে হতে পারে না" বাবা কথা শেষ করে দ্রুত চলে গেলেন।

বাবা চলে যাওয়ার পর উয়েন জুয়েন অনেকক্ষণ কাঁদলেন। তিনি মনে মনে ভাবছিলেন, "আমাকে কেন এভাবে একাকী সারাজীবন কাটাতে হবে? এটা কেমন নিয়ম?!" ঠিক সে-সময় তিনি জানালা দিয়ে একটি উড়ন্ত পাখি দেখলেন। পাখিটি স্বাধীনভাবে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। তিনি মনে মনে পাখির প্রশংসা করলেন। হঠাত তার মনে একটি ধারণার উদয় হলো: "আমি কেন পাখির মত হবো না? আমিও বাসা থেকে বাইরে চলে যেতে পারি। আজ রাতেই আমি সি মা শিয়েনলুর কাছে চলে যাবো। আজীবন তার সঙ্গে থাকবো।"

সেদিন রাতে বাড়ির কাজের মেয়ের সাহায্যে উয়েন জুয়েন বাসা থেকে পালিয়ে গেলেন। তিনি সি মা শিয়েনলুর বাসায় আসলেন। উয়েন জুয়েনকে দেখে সি মা শিয়েনলু হতভম্ব হয়ে গেলেন। প্রথমে তিনি একটি কথাও বলতে পারলেন না। পরে উয়েন জুয়েনের কথা শোনার পর সি মা শিয়েনলু অভিভূত হয়ে পড়লেন।

জু উয়েন জুয়েন ও সি মা শিয়েনলুর ভালোবাসার গল্প ও দীর্ঘকালের প্রথা-রেওয়াজ ভেঙ্গে তাদের বেড়িয়ে আসার কাহিনী পরবর্তীকালে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাসে তারা দু'জন বিখ্যাত হয়ে যান। পরবর্তীকালে এই কাহিনী নিয়ে অপেরাও তৈরি হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক