Web bengali.cri.cn   
চীনের পুর্ব হ্যাং রাজবংশ আমলের আবিষ্কারক ছেই লেন সম্পর্কে।
  2013-09-17 18:51:21  cri
ছেই লেনের জন্ম বতর্মান হুনান প্রদেশে। তিনি ছিলেন চীনের পুর্ব হ্যাং রাজবংশ আমলের আবিষ্কারক। ভালো মানের কাগজ তৈরির কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন তিনি। তার প্রচেষ্টায় গুণগতমানসম্পন্ন যে-কাগজ সে-আমলে উত্পন্ন হতো, তার নাম ছিল 'ছেইহো কাগজ'।

তখন হ্যাহোডি ছিলেন পূর্ব হ্যান রাজবংশের রাজা। তার শাসনামলে সমাজ ছিল অত্যন্ত বিশৃংখল; জনসাধারণের জীবনমান ছিল অত্যন্ত খারাপ। বাচ্চা বিক্রি করা তো সাধারণ ব্যাপার ছিল। একদিন রাতে লোইয়ান শহরের রাজপ্রাসাদের এক কোণে একটি দশ-বারো বছরের বালক গুটিশুটি মেরে বসে ছিল আর কাঁদছিল। সে বালকটি ছিলেন ছেই লেন। সেসময় একজন বুড়ো লোক তার কাছে এলেন এবঙ ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন: 'তোমার নাম কী?' 'আমার নাম ছেই লেন।' উত্তর দিল বালক। 'তুমি কেন এখানে এভাবে বসে আছ?' জিজ্ঞেস করলেন সেই বুড়ো লোক। 'আমি বাসায় ফিরে যেতে চাই। বাবা-মার কথা আমার খুব মনে পড়ছে।' উত্তর দিলেন ছেই লেন। 'বোকা ছেলে কোথাকার! রাজপ্রাসাদে একবার এলে আর বের হওয়া যায় না।' লোকটি বললেন। বুড়ো লোক আরো বললেন: 'তুমি আর কাঁদবে না। আমিও তোমার বয়সে রাজপ্রাসাদে সেবক হিসেবে এসেছিলাম। সে প্রায় ৪০ বছর আগের কথা। তুমি তোমার মনের কথা আমাকে বলতে পার।' ছেই লেন বুড়ো লোকটিকে তার শোচনীয় জীবন সম্পর্কে বলতে শুরু করলেন। বছর খানেক আগে তার জন্মস্থান খরায় আক্রান্ত হয়। সেবছর জমিতে কোনো ফসল হয়নি। অনেক লোক না-খেয়ে মারা গেল। নিরুপায় হয়ে তার বাবা তাকে একজন এজেন্টের কাছে বিক্রি করে দিলেন। ওই এজেন্ট আবার বেশি টাকার বিনিময়ে তাকে বিক্রি করে দেয় রাজপ্রাসাদের কাছে। তখন থেকেই তিনি রাজপ্রাসাদে একজন সেবক হয়ে আছেন। প্রতিদিন ভোরবেলায় তাকে ঝাড়ু দিতে হয়; তারপর সারাদিন কাজ করতে হয়। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বুড়োকে বললেন: ‍'এখানে আমাকে প্রতিদিন রাতে কাজ করতে হয়। তাই আমি দিনের বেলা অত্যন্ত ক্লান্ত বোধ করি। রাজপ্রাসাদের কর্মকর্তা বা তাদের পরিবারের সদস্যরা মাঝে মাঝে আমাকে ধমক দেয় বা নিযার্তন করে। আমি বাঁচতে চাই না।' 'বাজে কথা! আমরা কেন অযথা মরতে যাব? আমাদের মনে আশা থাকা উচিত। তুমি সি মা ছিয়েনের কাহিনী শোনোনি? তিনিও আমাদের মতো ছিলেন। অথচ পরে তিনিই ইতিহাসের বিখ্যাত বই সম্পাদনা করেছিলেন।' বুড়ো লোকের কথায় ছেই লেন মনে সান্ত্বনা পেলেন। তিনি মনে মনে সি মা ছিয়েনের মতো মানুষ হতে চাইলেন।

বুড়ো লোকটি ছিল অত্যন্ত দয়ালু। পরের দিন তিনি কিছু বই এনে ছেই লেনের সামনে রেখে বললেন: 'বাবা, তুমি এ বইগুলো সময় করে পড়বে। বইগুলোতে অনেক জ্ঞানের কথা আছে। জানলে তোমার উপকার হবে।' 'আহা, বইগুলোর এতো ওজন কেন?' ছেই লেন জানতে চাইলেন। বুড়ো লোকটি তাকে বললেন: 'কারণ, এগুলো বাঁশ দিয়ে তৈরি। শুনেছি, একবার একজন স্থানীয় কর্মকর্তা রাজাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিটা লিখতে তিন হাজার বাঁশ লেগেছিল। আর চিঠিটি পড়তে রাজার সময় লেগেছিল পাক্কা দু'মাস। দেখ, এটা মোটেই সহজ কাজ নয়।' বুড়ো লোকের কথা শুনে ছেই লেন জিজ্ঞেস করলেন: 'এ পযর্ন্ত কি কোনো হালকা ধরনের বই লেখা হয়নি?' বুড়ো উত্তর দিলেন: 'বাঁশের তৈরি বই ছাড়া আরও এক ধরনের কাপড়ের তৈরি বই আছে। কাপড়ের তৈরি বইয়ের ওজন তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু কাপড়ের দাম বেশি বলে খুব কম লোক তা ব্যবহার করে।' বুড়ো লোক চলে যাওয়ার পর, ছেই লেন গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। তিনি মনে মনে ভাবলেন: 'বাঁশে লেখা বইয়ের ওজন অত্যন্ত ভারী, পড়তে অনেক অসুবিধা। অন্যদিকে, কাপড়ে লেখা বইয়ের ওজন হালকা হলেও, দাম বেশি। খুব কম লোকই তা ব্যবহার করতে পারে। যদি এমন কোনো জিনিস থাকতো যার ওপর লেখা যায় অথচ তা ভারী নয়, তাহলে কত ভাল হতো!'

তারপর অনেক বছর পার হয়ে গেল। এ কয়েক বছরে ছেই লেন অনেক বই পড়েছেন এবং হয়ে উঠেছেন একজন জ্ঞানী যুবক। পরে একদিন তিনি রাজদরবারের একজন কর্মকর্তার পদে নিয়োগ পেলেন। তার দায়িত্ব ছিল রাজার পক্ষে নির্দেশ লেখা। আসলে তিনি ছিলেন রাজার ব্যক্তিগত সচিব। এই পদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার ক্ষমতাও বেশী। কারণ তিনি প্রতিদিন রাজার সঙ্গে দেখা করতে পারেন। সুতরাং অনেকে তাকে তোষামোদ করতো এবং তাদের হয়ে রাজাকে সুপারিশ করতে বলতো। কিন্তু তিনি কোনোদিন রাজার কাছে তাদের জন্য সুপারিশ করেননি।

রাজদরবারের কর্মকর্তা হওয়ার পর তিনি হালকা কাগজ তৈরির উপায় নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করলেন। একদিন তিনি কয়েকজন মিস্ত্রীকে ডেকে পাঠালেন। তিনি তাদেরকে বললেন: 'কয়েক বছর ধরে আমি এক ধরনের কাগজ তৈরি করার কথা চিন্তা করে আসছি। বতর্মানে লেখার উপাদান হল বাঁশ ও কাপড়। বাঁশের ওজন বেশী এবং বেশী শব্দ লেখা যায় না। কাপড় ভাল কিন্তু অনেক দামী। আমি মনে করি যে, পাট দিয়ে এক ধরনের কাগজ তৈরি করা যায়। তোমরা এখন থেকে একটু পরীক্ষামূলক কাজ শুরু কর। দেখবে পাট দিয়ে লেখার কাগজ তৈরি করা যায় কি না?' ছেই লেনের নিদের্শ অনুসরণ করে তারা পরীক্ষামূলক কাজ চালাতে শুরু করল। ছেই লেন তাদেরকে পরামর্শ দিয়ে গেলেন। প্রচেষ্টা কয়েকবার ব্যর্থ হল। পরীক্ষামূলক কাজের চূড়ান্ত পর্যায়ে ছেই লেন দিনরাত মিস্ত্রীদের সঙ্গে থাকতেন। অবশেষে পাট থেকে কাগজ আবিস্কৃত হল। কিন্তু শুরুতে কাগজের মান তেমন ভালো ছিল না। তখন শুরু হলো কাগজকে আরো মানসম্পন্ন করা প্রচেষ্টা। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ভালো মানের কাগজ তৈরি হল। সেই কাগজ রাজার সামনে উপস্থাপন করা হলো। রাজা এই সাদা রংয়ের কাগজ দেখে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি ছেই লেনকে জিজ্ঞেস করলেন: 'এই সাদা রংয়ের কাগজ কি পাটের তেরী?' 'জি', উত্তর দিলেন ছেই লেই। রাজা একটি কলম দিয়ে এই কাগজের ওপরে " চমত্কার" শব্দটি লিখলেন। রাজা বললেন: 'আমি চাই পৃথিবীর সকল মানুষ এ ধরনের কাগজ ব্যবহার করবে।'

ছেই লেনের আবিস্কৃত কাগজ অল্প সময়ের মধ্যে সারা দেশে ব্যবহার শুরু হয়। ছেই লেনের নামও দ্রুত চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তার আবিস্কৃত কাগজ দেখতে সুন্দর; লেখাও হয় ভালো। রাজা ছেই লেনের নামে কাগজটির নামকরণ করলেন। আর সাধারণ মানুষ তাকে 'কাগজের দেবতা' বলে ডাকতে শুরু করলো। পরে এই কাগজের ভিত্তিতে আরও ভালমানের কাগজ আবিস্কৃত হয়। ধীরে ধীরে চীনের কাগজ তৈরির কৌশল বিশ্বের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ল।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় যে, কাগজ তৈরির কৌশল চীনাদের চাঁরটি বড় আবিস্কারের অন্যতম। তাই, ছেই লেনের নাম চিরকাল চীনা মানুষের মনে থাকবে।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক