Web bengali.cri.cn   
চীনের মিং রাজবংশ আমলের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম রাজা জু ইয়ান জান সম্পর্কে।
  2013-09-10 20:04:38  cri
চীনের ইউয়ান রাজবংশের পতনের পর মিং রাজবংশের আমল শুরু হয়। মিং রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জু ইয়ান জান। তিনি মিং রাজবংশের প্রথম রাজা। তার জন্মস্থান বতর্মান আনহুই প্রদেশের ফনইয়াং। তিনি একটি গরীব পরিবারের ছেলে ছিলেন। ছোটবেলায় তিনি তেমন কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেননি। বড় হওয়ার তিনি ইউয়ান রাজবংশের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিদ্রোহী বাহিনীতে যোগ দেন। পরে তিনি বিদ্রোহী বাহিনীর নেতায় পরিণত হয়। তার নেতৃত্বে বিদ্রোহী বাহিনী দক্ষিণ চীনের অনেক জায়গা দখল করে। অবশেষে ইউয়ান রাজবংশের পতন ঘটে এবং তিনি মিং রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনামলে সমাজ সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল ছিল; জনসাধারণের জীবনমান উন্নত ছিল।

ছোটবেলায় জু ইয়ান জানের নাম ছিল জু জং বা। তার দাদা ও বাবা সারাজীবন জমিদারের জন্য কাজ করেছেন। তাদের পরিবারে অভাব ছিল। তার বাবা-মার জন্য বাচ্চা লালনপালন করা কঠিন কাজ ছিল। তখন প্রতি বছর দুর্যোগ দেখা দিত। দেশের সর্বত্র হয় বন্যা, না নয় খরা দেখা দিত। উপরন্তু, তখন রাজদরবার ও স্থানীয় কর্মকর্তারা অত্যন্ত দুর্নীতিপরায়ণ ছিল। তারা নিষ্ঠুরভাবে জনসাধারণকে নির্যাতন করত। সুতরাং জনসাধারণের জীবন খুব শোচনীয় ছিল। জু ইয়ান জানের বাবা, মা ও বড় ভাই রোগাক্রান্ত হয়ে বিনা চিকিত্সায় মারা যান। জু ইয়ান জান অনাথে পরিণত হন। কোনো কোনো দিন তাকে না-খেয়ে থাকতে হতো। ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হয়ে কখনো কখনো তিনি ঘাস আর পাতা খেতেন। একসময় নিরুপায় হয়ে তিনি একটি মন্দিরে আশ্রয় নিলেন। সেখানে প্রতিদিন ভোরবেলায় মন্দির ঝাড়ু দিতেন। অন্যান্য সন্যাসীর জন্য দূর থেকে খাবার পানিও তাকে আনতে হতো। কিন্তু এ জীবন তার পছন্দ ছিল না। পছন্দ না-হলেও তিনি সেখানে থেকে গেলেন। কারণ, আর যা-ই হোক, সেখানে তিনি তিন বেলা ভরপেট খেতে পেতেন।

মন্দিরে তিন বছর থাকার পর তিনি স্থানীয় একটি বাহিনীতে যোগ দেন। তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে অস্ত্রচালনা শিখেছিলেন এবং একজন ভালো যোদ্ধায় পরিণত হন। প্রতিটি যুদ্ধেই তিনি চমত্কার নৈপুণ্য দেখাচ্ছিলেন। তা ছাড়া, তিনি ছিলেন একজন মেধাবী যুবক। মাঝে মাঝে তিনি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের পরামর্শ দিতেন। সেনাবাহিনীর একজন জেনারেল তাকে খুব পছন্দ করতেন। পরে এই জেনারেল তার একজন দূর সম্পর্কের আত্মীয়ার সঙ্গে জু ইয়ান জানের বিয়ে দেন। এক বছর পর জু ইয়ান জান একটি বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। তখন তার বয়স মাত্র ত্রিশ বছর। কিন্তু তার নেতৃত্বাধীন বাহিনী বেশ কয়েকটি যুদ্ধে জয়লাভ করে। ফলে জু ইয়ান জানের নাম সেনাবাহিনীতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

জু ইয়ান জান ছোটবেলায় আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া করেননি বললেই চলে। কিন্তু তিনি খুব মেধাবী ছিলেন। তিনি ভালভাবে জানতেন, আনুষ্ঠানিক জ্ঞান অর্জন করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই মন্দিরে বাসকালেই তিনি নিজে নিজে পড়াশুনা শুরু করেন। তখন দিনের বেলায় কাজের চাপের কারণে পড়াশুনার জন্য সময় বের করা কঠিন ছিল। তাই তিনি পড়াশুনার জন্য বেছে নেন রাতকে। রাতে মন্দিরের অন্যরা যখন গল্পগুজব করতেন, তখন তিনি নিজের ঘরে একা একা বসে বই পড়তেন। মন্দিরের তিন বছরের জীবনে তিনি অজস্র বই পড়েছেন। ইয়ান রাজবংশের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার ফাঁকে ফাঁকেও তিনি বই পড়তেন; সেগুলো ছিল সামরিক বিষয়ের ওপর। তখন থেকেই তিনি ইয়ান রাজবংশের পতন ও নিজে একটি নতুন রাজবংশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন। অবশেষে তার সে স্বপ্ন পূরণ হয় এবং তিনি মিং রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি হন মিং রাজবংশের প্রথম রাজা।

মিং রাজবংশ প্রতিষ্ঠার পর তিনি নানচিন-কে রাজ্যের রাজধানী হিসেবে বাছাই করেন। মিং রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেও দেশের উত্তরাঞ্চল ইয়ান রাজবংশের হাতে ছিল। জু ইয়ান জান সিদ্ধান্ত নিলেন যে ইয়ান রাজবংশ পুরোপুরি উত্খাত করতে হবে। রাজা হওয়ার প্রথম বছরেই তিনি দু'জন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাকে উত্তরাঞ্চলের ইয়ান রাজবংশের সেনাবাহিনীকে দমন করার নির্দেশ দেন। তারা উত্তরাঞ্চলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার আগে জু ইয়ান জান তাদের দু'জনকে ডেকে পাঠালেন। তিনি তাদেরকে বললেন: 'এবার তোমাদের উত্তরাঞ্চলের অভিযানের প্রধান লক্ষ্য হল জনসাধারণকে বাঁচানো। চীনকে একীভূত করা আমাদের অভিন্ন উদ্দেশ্য। প্রথমে তোমরা হোনান, সেনতংসহ কয়েকটি জায়গা দখল করবে। তারপর সরাসরি ইয়ান রাজবংশের রাজধানী দখল করবে।' উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা দু'জন মাথা নেড়ে বললেন: 'মহারাজ আপনি ঠিকই বলেছেন। আমরা আপনার নির্দেশ অনুসরণ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করবো। দেশকে একীভূত করা আমাদেরও আশা। আপনি আমাদের কাছ ভাল খবরের অপেক্ষা করুন।' তারপর জু ইয়ান জান আবার বললেন: 'মনে রাখতে হবে যে, তোমরা ইয়ান রাজবংশের দখলকৃত অঞ্চলের জনসাধারণের জিনিসপত্র লুঠপাট করতে পার না। জনসাধারণের বাড়িঘর ধ্বংস করতে পার না এবং মহিলাদের নির্যাতন করতে পার না।' এভাবে তিনি সেনাবাহিনীর জন্য কড়াকড়ি আইন করে দিলেন। সেনাবাহিনী তার এই কঠোর আইন মেনে চললো। ফলে, মিং রাজবংশের সেনাবাহিনী স্থানীয় জনসাধারণের সমর্থন পেল এবং তারা ইয়ান রাজবংশের রাজধানী দখল করল। এর সাথে ইয়ান রাজবংশের চূড়ান্ত পতন হল। দেশ একীভূত হল; জু ইয়ান জানের আশা পূরণ হলো।

একবার জু ইয়ান জান তার জন্মস্থান পরিদর্শনে যাচ্ছিলেন। পথে সাধারণ মানুষ তার কাছে এসে স্থানীয় কর্মকর্তাদের দুর্নীতি সম্পর্কে নানান অভিযোগ করল। তিনি মন দিয়ে তাদের কথা শুনলেন। পরে সেসব অভিযোগের ভিত্তিতে তিনি অনেক দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাকে শাস্তি দেন। ফলে অন্য স্থানীয় কর্মকর্তারা সাবধান হন এবং তাদের দুর্নীতি ও নির্যাতন থেকে সাধারণ মানুষ অনেকটা রেহাই পায়। এতে জনসাধারণের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা আরো বেড়ে যায়; তিনি পরিণত হন একজন অন্যতম জনপ্রিয় রাজায়।

কিন্তু ধীরে ধীরে রাজা সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠলেন। দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাদেরকে হত্যা করার পাশাপাশি তিনি অনেক অনুগত ও ভাল কর্মকর্তাকেও ভুল করে হত্যা করলেন। একসময় তিনি ভাবতে শুরু করলেন যে, রাজদরবারের অনেক কর্মকর্তা আর আগের মতো নির্ভরশীল ও বিশ্বাসযোগ্য নেই। তিনি ভয় পেতে শুরু করলেন যে, সুযোগ পেলে তারা বিদ্রোহ করবে ও তাকে উত্খাত করবে। সন্দেহপ্রবণ রাজা মাত্র কয়েক বছরে বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ৫০ হাজার সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করলেন। এভাবে তিনি নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইলেন। তার ছেলের শিক্ষক ছিলেন জু ইয়ান জানের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শিক্ষকের ওপর তার আস্থাও বেশী ছিল। একদিন শিক্ষক রাজাকে এভাবে নির্বিচারে মানুষ হত্যা না-করার পরামর্শ দিলেন। কিন্তু রাজা তার পরামর্শতো গ্রহণ করলেনই না, উল্টো তাকে রাজদরবার থেকে তাড়িয়ে দিলেন।

বস্তুত, চীনের ইতিহাসে মিং রাজবংশের প্রথম রাজা জু ইয়ান জান ছিলেন একজন বিতর্কিত রাজা। একদিকে যেমন দেশকে একীভূত করার ক্ষেত্রে তার অবদান চীনের মানুষের কাছে প্রশংসিত হয়েছে, অন্যদিকে স্রেফ সন্দেহের বশবর্তী হয়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে তিনি হয়েছেন নিন্দিত ও বিতর্কিত।

(চিয়াং/আলিম)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক