130904china.m4a
|
সকাল ৮টা কুয়াং চৌর সবচেয়ে ব্যস্ত সময়। সুদানি নাগরিক আসাদ হামজা আহমাদ এলহাগ বাসের জন্য স্টপেজে ১৫ মিনিট অপেক্ষা করছিলেন। বাসে করে তার বাসা থেকে অফিস যেতে ১৫ মিনিট লাগে। গত ৯ বছর ধরে তিনি প্রতিদিন ২৯৭ নম্বর বাস ধরে অফিসে যান। তবে আজ সকালে একজন গুরুত্বপূর্ণ অতিথির সঙ্গে সাক্ষাত্ করতে হবে। তাই দেরি করা চলবে না। সেকারণে আসাদ ট্যাক্সি ধরার সিদ্ধান্ত নেন।
ব্যবসা করার জন্য কুয়াং চৌতে অবস্থানকারী আরব ব্যবসায়ীদের অধিকাংশ ইউয়ু সিউ এলাকার সিয়াও পেই সড়কে বাস করেন। তাই সিয়াও পেই সড়ককে 'আরব সড়ক'ও বলা হয়। অধিকাংশ আরব ব্যবসায়ীর মতো আসাদও সিয়াও পেই সড়কে তার অফিস খুলেছেন।
এগারো বছর আগে চীনা ভাষা শিখার জন্য চীনে আসেন আসাদ। স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের হওয়ার পর তিনি বন্ধুকে সাহায্য করার জন্য কুয়াং চৌ আসেন এবং সেই থেকে এখানে ৯ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন। কুয়াং চৌ তার মনে কেমন প্রভাবে ফেলেছে, সেটা জানতে চাইলে আসাদ বলেন:
"ব্যবসা করার জন্য খুব উপযুক্ত একটি শহর কুয়াং চৌ। এখানে বাজার উন্মুক্ত ও সার্বিক। ভিন্ন জাতি ও ভাষার মানুষ এখানে ব্যবসা করতে পারেন। কুয়াং চৌ অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি শহর।"
প্রাচীনকাল থেকে কুয়াং চৌ চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বন্দর। ১৯৭৮ সালে চীনে সংস্কার ও উন্মুক্ততার নীতি কার্যকর হওয়ার পর কুয়াং চৌ অনেক বিদেশি ব্যবসায়ীকে আকর্ষণ করেছে। পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, বর্তমানে কুয়াং চৌতে আরব ব্যবসায়ীর সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ। কুয়াং চৌ মুসলমান সমিতির প্রধান ওয়াং ওয়ান চে মনে করেন, আরব ব্যবসায়ীরা চীন ও আরব দেশের মধ্যে একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক পথ নির্মাণ করেছেন। তিনি বলেন:
"প্রতি বছর দুই দফা অনুষ্ঠিত কুয়াং চৌ বিনিময় মেলা বিপুল সংখ্যক আরব ব্যবসায়ীকে আকর্ষণ করে এবং অনেক আরব ব্যবসায়ী কুয়াং চৌতে কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তারা কুয়াং চৌ, চীন, এমনকি বিশ্বের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন।"
অফিসে কাজ করার পাশাপাশি রেডিও শোনা, কফি খাওয়া ও ইমেল পড়া আসাদের নিত্যদিনের কাজ। যদিও কুয়াং তুংয়ের ভাষা বুঝতে পারেন না, তবে তিনি কুয়াং তুংয়ের রীতিতে জীবনযাপন করতে পছন্দ করেন।
আজ সকালে আসাদকে একজন গুরুত্বপূর্ণ চীনা ক্লায়েন্টের সঙ্গে দেখা করতে হবে। হুয়াং চি নামের এ ক্লায়েন্ট এক বছর আগে থেকে আসাদের সঙ্গে পরিচিত। আসাদের অনুরাগ ও আন্তরিকতা তার মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। হুয়াং চি সংবাদদাতাকে বলেন:
"আমরা আসাদকে তুং তুং বলে ডাকতে পছন্দ করি। উনি একজন দারুণ ভদ্রলোক। তিনি আমাকে অনেক সাহায্য করেন এবং প্রতিটি উত্সবে আমাকে শুভেচ্ছা জানান। তিনিও আমাকে খাবার খাওয়ান। যদিও আমি তার ক্লায়েন্ট, তবুও আমার মনে হয় আমরা বন্ধুও।"
গত ৯ বছরে আসাদের ব্যবসায়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কাপড় থেকে নিত্যপণ্য, নির্মাণসামগ্রী এবং বিনিয়োগ পরামর্শ – তিনি নানা রকমের ব্যবসা করেন। চীন ও বিশ্ব পরিস্থিতির পরিবর্তন এবং আরও বেশি বিদেশি ব্যবসায়ী কুয়াং চৌ বাজারে প্রবেশ করার কারণে আসাদ প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হচ্ছেন।
তিনি বলেন:
"বিগত কয়েক বছরে ডলারের সঙ্গে সুদানি পাউন্ডের বিনিময় হার ২ পাউন্ড থেকে ৭ পাউন্ড হয়েছে। এটা বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর প্রভাব ফেলেছে। তা ছাড়া, সুদানের গৃহযুদ্ধের প্রভাবে আমদানিও কমে গেছে।"
চীনের অর্থনীতির দ্রুত উন্নয়ন, বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিতিশীলতা এবং সুদানের গৃহযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আরও বেশি সুদানি নাগরিক চীনে আসতে আগ্রহী। আসাদ চীনা ভাষা শেখার জন্য তার ছোট দু' ভাইকে পেইচিংয়ে পাঠতে চান। কারণ তিনি জানেন, চীনে বসবাস করতে চাইলে চীনা ভাষা জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
আসাদ বলেন:
"বর্তমানে চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক সত্তা এবং ৯৯ শতাংশ পণ্য চীনে তৈরি। সুদানে চীনা ভাষা খুব জনপ্রিয় এবং অনেক মানুষ চীনা ভাষা শিখতে চীনে আসতে চান। চীনা ভাষা বলতে পারলে চাকরি পাওয়ার সুযোগ বেশি।"
ভাল বাণিজ্যিক পরিবেশ, সুবিধাজনক পরিবহণ এবং উন্মুক্ত বায়ুমণ্ডল কুয়াং চৌকে বিদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য আদর্শ স্থানে পরিণত করেছে। আরব বণিক সমিতির উপ-প্রধান সামিহা সংবাদদাতাকে বলেন, চীন সরকারের কার্যকর উদ্যোগ ও তত্ত্বাবধান বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করে এবং অন্যদিকে বিদেশি বিনিয়োগ কুয়াং চৌয়ে নতুন প্রাণশক্তি যোগায়। সামিহা বলেন:
"আবাসিক পারমিট ও ব্যবস্থপনা লাইসেন্সের আবেদন, ক্রয় ও পরিবহনসহ বিভিন্ন বিষয়ে চীন সরকার বিদেশি ব্যবসায়ীদেরকে সুবিধা দেয়। বিদেশি ব্যবসায়ীদের জন্য কুয়াং চৌ নিরাপদ, গতিশীল ও স্বাচ্ছন্দ্যময় একটি বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ভবিষ্যতে চীন বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনৈতিক সত্তায় পরিণত হলে তা বিস্ময়কর কিছু হবে না।"
একা কুয়াং চৌয়ে বসবাসে আসাদের নিঃসঙ্গ লাগে না। কাজ শেষ হওয়ার পর তিনি সুদান থেকে আসা বন্ধুদের সঙ্গে গল্পগুজব করেন বা চীনা মানুষদের সঙ্গে মা চিয়াং খেলেন। বিশেষ করে কুয়াং চৌয়ে আরব রেস্তোরাঁ অনেক বেশি বলে তিনি সবসময় জন্মস্থানের খাবার খেতে পারেন।
আসাদ বলেন:
"কুয়াং চৌতে খাওয়া অত্যন্ত সুবিধাজনক একটি ব্যাপার। দেখুন আমরা যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি সেখানে মুসলিম, আমেরিকান, ব্রিটিশ এমনকি ব্রাজিলিয়ান রেস্তোরাঁও আছে।"
বসন্ত উত্সব চলাকালে অধিকাংশ চীনা নাগরিক ছুটিতে যায় বলে আসাদ ওই সময় দেশে ফিরে যান। আসাদ সংবাদদাতাকে জানান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিশর, ইথিওপিয়া, কাতার ও সৌদি আরবের এয়ারলাইনগুলোর প্রতিদিন কুয়াং চৌ থেকে খার্তুমগামী ফ্লাইট আছে। তাই তিনি কখনও বোধ করেন নি যে, জন্মস্থান দূরে।
দিনের কাজ শেষ করে সন্ধ্যা ৬টার পর আসাদ সুদানে থাকার সময়ের মতো একটি ক্যাফেতে বসেন। আরব বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আল-জাজিরা টেলিভিশন কেন্দ্রের অনুষ্ঠান দেখেন। আসাদের কাছে কুয়াং চৌ তার বাড়ির মতো এবং তিনি কখনো এ শহর ত্যাগ করতে পারবেন না।