130814china.m4a
|
চীনে পানিসম্পদের প্রাচুর্য থাকলেও পানির প্রাপ্তিঅঞ্চল ভারসাম্যহীন। দেশের দক্ষিণাঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয় এশিয়ার বৃহত্তম কয়েকটি নদী। তবে উত্তরাঞ্চলের অবস্থা ভিন্ন। এখানে নদীর সংখ্যা ও বৃষ্টিপাত কম এবং বেশিরভাগই প্রাকৃতিক বৃষ্টিহীন অঞ্চল। উত্তরের কয়েকটি অঞ্চলের মাথাপিছু পানিসম্পদ বিশ্বের গড় পরিমাণের এক-ষষ্ঠদশাংশ।
দক্ষিণ থেকে উত্তরে পানি পরিবহণ প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী সেন ফেং সেং বলেন:
"চীনের উত্তরাঞ্চলের আবহাওয়া শুষ্ক ও বৃষ্টিহীন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের কারণে পানিসম্পদের অভাব গুরুতর।"
গত আশির দশক থেকে চীনের উত্তরাঞ্চলে গড় বৃষ্টিপাত প্রতিবছর কমে যাচ্ছে। শুষ্ক আবহাওয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির মজুদও কমে যাচ্ছে। ঘন কৃষি, দ্রুত শহরায়ন এবং পানিদূষণের প্রভাবে উত্তরঞ্চলের পানি সরবরাহ জটিল হয়ে পড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন, এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যবস্থা না নেওয়া হলে, ২০৩০ সালে চীনের উত্তরাঞ্চলে পানি সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে। হুয়া পেই বিদ্যুত্শক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছাং হুয়া ইং বলেন:
"চীনের উত্তরাঞ্চলে পানিসম্পদের অভাব অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সীমাবদ্ধ করবে এবং এ সমস্যা সমাধান করতে হবে।"
২০০২ সালে ২৩ ডিসেম্বরে দক্ষিণ থেকে উত্তরে পানি পরিবহণ প্রকল্প চালু হয়। এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য একটি কৃত্রিম নেটওয়ার্কের মাধ্যমে চীনের দক্ষিণাঞ্চলের হাজার কোটি টন পানি উত্তরাঞ্চলে পরিবহণ করা। এ প্রকল্পে তিনটি রুট আছে। পশ্চিম রুটের লক্ষ্য ইয়াং চি নদীর উত্স থেকে পানি হুয়াং হে নদীতে নিয়ে যাওয়া। মধ্য রুটের উদ্দেশ্য হান নদীর পানি পেইচিং ও থিয়ান চিন শহরে নিয়ে যাওয়া এবং পূর্ব রুটের লক্ষ্য পেইচিং-হাংচৌ মহাখালের মাধ্যমে ইয়াং চি নদীর পানি চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পরিবহণ করা। প্রতিটি রুটের মাধ্যমে যে পরিমাণ পানি পরিবহণ করা হবে, তা বিশ্বের বৃহত্তম হ্রদের পানির পরিমাণের ৫৭০ গুণ।
তবে চীনের দক্ষিণ থেকে উত্তরে পানি পরিবহণ প্রকল্প নিয়ে দেশে অনেক বিতর্ক রয়েছে। বিরোধীরা মনে করেন, এ প্রকল্পে ব্যয় অনেক বেশি এবং কেউ এ প্রকল্পের অর্থনৈতিক ফল সম্পর্কে নিশ্চিত নয়। তাদের মতে, অল্প পানি পরিবহণ করলে প্রকল্পের ফলপ্রসূতা অর্জিত হবে না। আবার বেশি পানি পরিবহণ করলে ইয়াং চি নদীতে নৌচলাচলের ওপর প্রভাব পড়বে। তাছাড়া, এতে ইয়াং চি নদীর অববাহিকার প্রাকৃতিক পরিবেশও নষ্ট হতে পারে।
চীনের বিখ্যাত জলসেচ বিশেষজ্ঞ ছাং কুয়াং তো মনে করেন, দক্ষিণ চীনের পানি উত্তরে পরিবহণ প্রকল্প খুব প্রয়োজনীয়। তিনি বলেন:
"এ প্রকল্প জনগণের চাহিদা এবং এ প্রকল্পের প্রক্রিয়াও বড় ও জটিল। তবে উত্তর চীনের জনগণের জীবনযাপনের জন্য এটা বাস্তবায়ন করতে হবে।"
বিশেষজ্ঞরা বিশ্লেষণ করে বলেন, দক্ষিণের পানি উত্তরে পরিবহণের পাশাপাশি জলসেচ স্থাপনা এবং পানি, ভূমি ও পরিবেশ সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পানি সাশ্রয়, দুষণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ সংরক্ষণ করার পর পানি পরিবহণ করতে হবে। দক্ষিণের পানি উত্তরে পরিবহণ প্রকল্পের পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান ছাং কুও লিয়াং বলেন:
"দক্ষিণ চীনের পানি উত্তর চীনে পরিবহণ প্রকল্প পানিসম্পদের অভাব মোকাবিলার একটি কৌশলগত প্রকল্প। পানিসাশ্রয় ও পানিদুষণ নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি পানিসম্পদের সদ্ব্যবহার এ প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ দিক।"
দক্ষিণের পানি উত্তরে পরিবহণ প্রকল্পের পূর্ব রুটের প্রথম অংশ ২০০২ সালের শেষ দিকে চালু হয়েছে। পেইচিং-হাংচৌ মহাখাল ও অন্য সমান্তরাল নদীগুলোর মাধ্যমে দক্ষিণ চীনের পানি সান তুং প্রদেশের তে চৌ শহরে ও সান তুং উপদ্বীপে আনা হয়। এ রুটের পাশে অবস্থিত শহরগুলোতে মানুষের জীবনযাপনে ও শিল্পে যে পানি ব্যবহার করা হয়, তা এ রুট থেকে নেওয়া হয়। গত ১০ বছরে রুটের নিকটবর্তী অঞ্চলে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। মহাখালের পাশে ৬০ বছর বসবাসকারী অবসরপ্রাপ্ত কর্মী সেন ইউয়ু লিয়াং বলেন, কয়েক বছরে নদীর আবর্জনা বিলীন হয়ে গেছে এবং তিনি জানালা খুললে পরিষ্কার নদী দেখতে পান। তিনি বলেন:
"পরিবেশ ভাল হয়ে গেছে। পানিও পরিষ্কার। এমন কি বোধ করি বায়ুও ভাল হয়ে গেছে।"
ভারী শিল্প ও কৃষি উন্নয়নের কারণে চীনের পূর্বাঞ্চলের নদীতে দুষণ হয়েছে এবং মানুষ এ পানি খেতে পারে না। সরকার দশ-বারো বিলিয়ন ইউয়ান অর্থ ব্যয় করে পানিদুষণ নিয়ন্ত্রণ করেছে। পূর্ব রুট ৯০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং শুধু চিয়াং সু অঞ্চলে পানিদূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য ৫৯০ কোটি ইউয়ান ব্যয় করা হয়েছে। এছাড়া কয়েক শতাধিক সিমেন্ট ও কাগজ কারখানা বন্ধ করা হয়েছে।
চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদে দক্ষিণ চীনের পানি উত্তর চীনে পরিবহণ প্রকল্পের পরিবেশ সংরক্ষণ বিভাগের প্রধান সি ছুন সিয়ান বলেন:
"পেইচিং-হাংচৌ মহাখালের দু'পাশে রয়েছে দশ বারোটি বর্জ্য নিঃসরণ কেন্দ্র এবং নদীর প্রতিটি জাহাজকে প্রতি তিন দিনে অন্তত একবার ওখানে আবর্জনা নিঃসরণ করতে হয়। আবর্জনা নিঃসরণের রের্কড অনুযায়ী জাহাজ পরিচালনার অনুমোদন দেওয়া হয়।"
পানির মান ভাল হওয়া ছাড়াও, রুটের দু পাশের বন্যা ও খরা কমে গেছে। পূর্ব রুটের পাশে সু ছিয়ান শহরের ইয়ান চি গ্রাম নিচু এলাকায় অবস্থিত হওয়ার কারণে সবসময় বন্যার কবলে পড়তো। তবে এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। গ্রামের একজন অধিবাসী বলেন:
"আমরা দক্ষিণ চীনের পানি উত্তর চীনে পরিবহণ প্রকল্প থেকে উপকৃত হয়েছি। যখন বন্যা বা খরা হয় তখন আমরা পানির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।"
তাছাড়া, দক্ষিণ চীনের পানি উত্তর চীনে পরিবহণ প্রকল্পর প্রভাবে হাজার বছর বয়সী পেইচিং-হাংচৌ মহাখালের কয়েকটি অঞ্চলে নৌপরিবহণ আবার শুরু হয়েছে। পেইচিং-হাংচৌ মহাখালের নতুন বন্দরে মাল বোঝাই ও খালাসের পরিমাণ এখন ১ কোটি ৩৫০ লাখ টন। এর মধ্য দিয়ে এ খাল চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদীপথে পরিণত হয়েছে।