Web bengali.cri.cn   
চীনের মিং রাজবংশের প্রথম রাজা হুবিলি সম্পর্কে
  2013-08-13 16:42:17  cri
চীনের দক্ষিণ সং রাজবংশের পতনের পর ইয়াং রাজবংশ দেশকে শাসন করতে শুরু করে। ইয়াং রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন হুবিলি। তিনি ছিলেন মঙ্গোলীয়। তিনি মঙ্গোলীয় অভিজাত সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ দমন করে চীনের ইতিহাসে সীমান্ত অঞ্চলের সবচেয়ে বড় রাজবংশ গড়ে তুলেছিলেন। তিনি অর্থনীতির উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিতেন। তিনি সবসময় দক্ষ ব্যক্তিদেরকে কাজে লাগাতেন। এর পাশাপাশি তিনি সীমান্ত অঞ্চলের ব্যবস্থাপনার ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করতেন। তার প্রচেষ্টায় চীন বহু জাতির ঐক্যবদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

হুবিলির বড় ভাই মঙ্গোলীয় জাতির তত্কালীন সর্বোচ্চ নেতা ছিলেন। হুবিলি ছিলেন তার বড় ভাইয়ের অধীনে একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা। সেসময় মঙ্গোলীয় জাতির সাথে মাঝে মাঝে দক্ষিণ সং রাজবংশের বাহিনীর লড়াই হতো। সেসব লড়াইয়ে হুবিলির নেতৃত্বে মঙ্গোলীয় বাহিনী বারবার জয়লাভ করছিল। ক্রমেই মঙ্গোলীয় সেনাবাহিনীতে হুবিলির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

একদিন যুদ্ধ চলাকালে হুবিলি খবর পেলেন যে, অন্য এক ফ্রন্টের যুদ্ধে তার বড় ভাই নিহত হয়েছেন। খবর শুনে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। তখন অন্য সামরিক কর্মকর্তারা তাকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বাড়ি ফিরে গিয়ে ভাইয়ের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দেয়ার পরার্মশ দিলেন। কিন্তু তিনি তাদেরকে বললেন: 'বড় ভাই মারা যাওয়ার খবর শুনে আমি অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে পড়েছি, এ কথা সত্য। আমি তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানেও অংশ নিতে চাই। কিন্তু যুদ্ধের এই জটিল মুহূর্তে আমি কীভাবে ময়দান ত্যাগ করি?" সেসময় ইয়াংসি নদীর ওপারে সং রাজবংশের সেনাবাহিনী অবস্থান নিয়ে বসেছিল। হুবিলি যুদ্ধের ময়দান পরিত্যাগতো করলেনই না, বরং মঙ্গোলীয় সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে ইয়াংসি নদী অতিক্রম করলেন এবং সং রাজবংশের সেনাবাহিনীকে পরাজিত করলেন।

ঠিক সেসময় হুবিলি তার স্ত্রীর কাছ থেকে দূতের মাধ্যমে একটি গোপন তথ্য পেলেন। তথ্য অনুসারে, হুবিলির বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পর তার ছোট ভাই রাজাকে উত্খাত করে নিজেই রাজা হবার পরিকল্পনা করছে; সে, এমনকি, হুবিলির ঘাঁটি দখলেরও চিন্তা করছে। স্ত্রীর গোপন চিঠি পড়ে হুবিলি খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি অবিলম্বে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরকে ডেকে পাঠালেন এবং সবার কাছে এ ব্যাপারে পরামর্শ চাইলেন। এ খবর শুনে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। একজন কর্মকর্তা দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন: 'স্যার, আপনি দ্রুত রাজধানীতে ফিরে যান। রাজার পতন যদি হয়ই, আমরা আপনাকে নতুন রাজা হিসেবে দেখতে চাই।' আরেক জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বললেন: 'গোটা সেনাবাহিনীতে আপনার জনপ্রিয়তা ও সমর্থন সবচেয়ে বেশী। মঙ্গোলীয় জাতির ভবিষ্যতের জন্য আপনাকে আমাদের রাজা হতেই হবে। অন্য কেউ রাজা হলে কষ্টার্জিত বিজয় নষ্ট হবে।' উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কথা শুনে হুবিলি মঙ্গোলীয় জাতির রাজার সিংহাসন দখল করার সিদ্ধান্ত নিলেন। পরে তার নেতৃত্বে একটি বাহিনী তার ছোট ভাইয়ের নেতৃত্বাধীন বাহিনীকে পরাজিত করে এবং হুবিলি মঙ্গোলীয় জাতির নতুন রাজা হিসেবে আবির্ভুত হন।

মঙ্গোলীয় জাতির রাজা হওয়ার দশ-বার বছর পর হুবিলি একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। হুবিলির দাদা চেঙ্গিস খান 'মহান মঙ্গোলিয়া' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। হুবিলিকে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বললেন: 'এখন মঙ্গোলিয়াকে ঐক্যবদ্ধ করার সময় এসেছে। মহারাজ, আপনাকে ভবিষ্যতের একীভূত দেশের একটি নতুন নামও দিতে হবে।' কর্মকর্তাদের পরামর্শ তার মনে ধরলো। তিনি মনে মনে ভাবলেন যে, তার নিজের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রের একটি নতুন নাম দেয়া দরকার। তিনি 'মহান মঙ্গোলিয়া' নামটি পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। ওই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পরার্মশ অনুষায়ী, তিনি দেশের নাম পরিবর্তন করে 'মহান ইউয়ান' রাখার কথা ঘোষণা করলেন। তখন থেকেই 'ইউয়ান রাজবংশ' প্রতিষ্ঠিত হয় এবং হুবিলি হন সে রাজবংশের প্রথম রাজা। পরে ইউয়ান রাজবংশ দক্ষিণ সং রাজবংশকে পরাজিত করে গোটা চীনকে ঐক্যবদ্ধ করে। দেশের নতুন নাম দেওয়ার পর নতুন রাজধানীর কথাও বিবেচনা করতে হয়। রাজদরবারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার পর রাজধানী হিসেবে 'পেইচিং'-কে বাছাই করেন হুবিলি।

ইউয়ান রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দশ-বারো বছর পর, নেইয়েন নামক একজন স্থানীয় মঙ্গোলীয় সামরিক কর্মকর্তা ইউয়ান রাজবংশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসে। একসময় তার নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী রাজধানী পেইচিংয়ের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তখন হুবিলি অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু এ খবর শুনে তিনি অসুস্থ শরীর নিয়েই যুদ্ধের ময়দানে যেতে চাইলেন। রাজদরবারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বললেন: 'মহারাজ, আপনার শরীর ভাল নয়। আপনি কিভাবে লড়াই করবেন?' হুবিলি বললেন: 'আমাকে পারতেই হবে। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল বিদ্রোহ দমন করা।' কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে হুবিলির বাহিনী পরাজিত হল। পরাজয়ের কারণ জিঙ্গেস করলে একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা হুবিলিকে বললেন: 'আমাদের সৈন্যদের অনেকেই নেইয়ানের অধীনে কাজ করছে অনেকদিন ধরে। আবার কেউ কেউ তার আত্মীয়। সুতরাং তারা কেউ লড়াই করেনি।' কর্মকর্তার কথা শুনে হুবিলি অবাক হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর তিনি বললেন: 'আমি ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছি। এখন আমি হ্যান জাতির সৈন্যদের নিয়ে গঠিত একটি সেনাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাবো।' পরের দিন হুবিলি হ্যান জাতির সৈন্যদের নিয়ে গঠিত একটি সেনাদল নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে গেলেন। পুরো দু'দিন লড়াই চলল। অবশেষে বিদ্রোহী বাহিনী পরাজিত হল। বিদ্রোহী নেতা নেইইয়ানকে হত্যা করা হল। বিদ্রোহ দমনের পর দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে এলো।

একদিন হুবিলি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেশের বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তিনি উপস্থিত সকলকে জিজ্ঞেস করলেন: 'তোমারা বল, একজন স্থানীয় কর্মকর্তা ভাল না মন্দ তা কিভাবে বোঝা যায়? তাদের কোন কোন গুণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ?' উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা কোনো জবাব দিতে পারলেন না। হুবিলি হাসিমুখে বললেন: 'আমার মনে হয়, যে কর্মকর্তার অধীনস্থ এলাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার স্থিতিশীল থাকে এবং পতিত জমি ক্রমবর্ধমান হারে আবাদী জমিতে পরিণত হয়, সেই কর্মকর্তাই ভালো কর্মকর্তা।' বলা বাহুল্য, যুদ্ধের কারণে বহু লোকের মৃত্যুর প্রেক্ষাপটে রাজার ওই কথা ছিল খুবই যুক্তিযুক্ত।

কৃষি উন্নয়নের জন্য হুবিলি অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি কৃষি ব্যবস্থাপনার জন্য একজন কর্মকর্তা নিয়োগ করেছিলেন। তার ইতিবাচক বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে কৃষিখাতে ব্যাপক উন্নতি ঘটে এবং দেশের জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া, জনসাধারণের জীবনমানও আগের চাইতে অনেক উন্নত হয়। কৃষির উন্নয়নের জন্য যেসব পদক্ষেপ রাজা গ্রহণ করেছিলেন, সেগুলোর মধ্যে জলসেচ ছিল অন্যতম। রাজা হুবিলির শাসনামলে 'মহান ইউয়ান' বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হয়। তখন বিদেশের অনেক ব্যবসায়ী ব্যবসার কৌশল শিখতে এদেশে আসতেন। ইতালির বিশ্ব বিখ্যাত মার্কোপোলা তাদের মধ্যে অন্যতম।

(চিয়াং/আলিম)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক