Web bengali.cri.cn   
চীনের পূর্ব হ্যান  রাজবংশ আমলের বিখ্যাত চিকিত্সক হুয়াঠো সস্পর্কে
  2013-06-25 19:50:05  cri
হুয়াঠো চীনের পূর্ব হ্যান রাজবংশ আমলের শেষ দিকের একজন বিখ্যাত চিকিত্সক। তিনি ছিলেন একজন সার্জন এবং শিশু ও নারী রোগ বিশেষজ্ঞ। তিনি আকুপাংচারেও একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন। বিশ্বে তিনিই প্রথম চিকিত্সক যিনি, চিকিত্সার সময় চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করা শুরু করেন। চীন তথা বিশ্বের চিকিত্সা ক্ষেত্রে হুয়াঠো লক্ষ্যণীয় অবদান রেখেছেন। চীনের মানুষ তাকে চিরকাল স্মরণ করবে।

যখন হুয়াঠো জন্মগ্রহণ করেন তখনকার সমাজ ছিল অস্থির। সেসময় বছরের পর বছর ধরে চলছিল গৃহযুদ্ধ। ছোটবেলায় হুয়াঠো মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি তত্কালীন রাজবংশের দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাদের পছন্দ করতেন না। ছোটবেলা থেকেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, বড় হয়ে তিনি রাজদরবারের কর্মকর্তা হবেন না। তিনি পছন্দ করতেন চিকিত্সা-বিদ্যা। বড় হয়ে তিনি হলেন একজন চিকিত্সক। তিনি খুবই দক্ষ চিকিত্সক ছিলেন। কয়েক বছরের মাথায় তার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। যুদ্ধের সময় অনেক সৈন্য আহত হয়। তিনি লক্ষ্য করলেন যে, গুরুতর আহত সৈন্যরা অস্ত্রোপচারের সময় নিদারুণ কষ্ট পায়। এসব দৃশ্য দেখে হুয়াঠো ভাবলেন: যদি অস্ত্রোপচারের সময় সৈন্যরা কষ্ট না-পেত, তবে কতোই না ভালো হতো!

তিনি এ-নিয়ে গবেষণা করতে শুরু করলেন এবং অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চেতনানাশক ওষুধ আবিষ্কার করলেন। অস্ত্রোপচারের আগে তিনি সে-ওষুধ রোগীদের খেতে দিতেন। ওষুধ খেয়ে তারা অজ্ঞান হয়ে যেতো। তখন তিনি অস্ত্রোপচার করতেন। এখানে বিষেশভাবে উল্লেখ করতে হয় যে, বতর্মানে সারা বিশ্বে অস্ত্রোপচারের সময় যে চেতনানাশক ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে, তা আবিষ্কৃত হওয়ার এক হাজার ছ'শো বছর আগে হুয়াঠো তার চেতনানাশক ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন। হুয়াঠো কেবল একজন ভাল চিকিত্সক ছিলেন তাই নয়, তিনি একজন অত্যন্ত কোমল হৃদয় মানুষ ছিলেন। গরীবদের কাছ থেকে তিনি চিকিত্সার জন্য কোনো অর্থ নিতেন না। তার এই কোমল ও দয়ার্দ্র আচরণের জন্য সাধারণ মানুষ তাকে খুবই ভালোবাসতো।

হুয়াঠোর দু'জন শিষ্য ছিলেন। তাদের যোগ্যতাও কম ছিল না। একদিন দু'জন শিষ্য হুয়াঠোকে জিজ্ঞেস করলেন: 'গুরু, আমরা জানতে চাই যে, মানুষ কীভাবে স্বাস্থ্যবান থাকতে পারে।' শিষ্যদের প্রশ্ন শুনে হুয়াঠো সাথে সাথে কোনোকিছু বললেন না। তিনি প্রথমে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। তিনি দরজার কোনা শিষ্যদের দেখিয়ে বললেন: 'দেখ, এই দরজা কাঠের তৈরী হলেও নষ্ট হয়নি বা ঘুনে ধরেনি। এর কারণ দরজাটি প্রতিদিন খোলা হয় এবং বন্ধ করা হয়। সুতরাং কোনো পোকা একে আক্রমণ করে সুবিধা করতে পারে না।' গুরুর কথা শুনে শিষ্যরা তার ইশারা বুঝতে পারলেন। তাদের মধ্যে একজন বলল: 'আমরা আপনার কথা বুঝতে পেরেছি। স্বাস্থ্যবান থাকতে চাইলে নিয়মিত শরীরচর্চা করা চাই, তাই না?' হুয়াঠো উত্তর দিলেন: 'তুমি ঠিকই ধরেছো। স্বাস্থ্যবান থাকতে চাইলে মানুষকে নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে। তা ছাড়া, দিনে উদরপূর্তি করে খাওয়া উচিত নয়। নিয়মিত শরীরচর্চা ও পরিমিত খাবার খেলে স্বাস্থ্যবান থাকা খুব কঠিন ব্যাপার নয়।'

পরে হুয়াঠো ও তার দু'জন শিষ্য 'পাঁচ প্রাণী' নামক ব্যয়াম আবিষ্কার করলেন। এ-পাঁচটি প্রাণী হল: বাঘ, হরিণ, বানর, ভালুক ও পাখি। এই পাঁচ রকমের প্রাণীর আচরণ অনুকরণ করে এই ব্যয়ামের কলা-কৌশল ঠিক করা হয়। চিকিত্সা করার সময় হুয়াঠো রোগীদেরকে এই ব্যয়ামও শিখিয়ে দিতেন। পরে অজস্র লোক হুয়াঠোর আবিষ্কৃত এই 'পাঁচ প্রাণী' ব্যয়াম চর্চা করতে শুরু করেন। শরীরে কোথাও ব্যথা অনুভূত হলে, এই ব্যয়াম করার সাথে সাথে ব্যথা চলে যায়।

পূর্ব হ্যান রাজবংশ আমলের শেষ দিকে চাওছাও নামক একজন বীর ছিলেন। মাঝে মাঝে চাওছাওয়ের মাথায় খুব ব্যথা হতো। এই রোগ দূর করার জন্য চাওছাও অনেক বিখ্যাত চিকিত্সক দেখিয়েছেন। কিন্তু সেসব চিকিত্সক তার এই রোগ ভালো করতে পারেননি। একদিন একজন কর্মকর্তা তাকে হুয়াঠোর কথা বললেন। চাওছাও একজন লোককে হুয়াঠোর কাছে পাঠালেন। যখন হুয়াঠো চাওছাওয়ের কাছে আসলেন, তখন চাওছাওয়ের মাথায় খুব ব্যথা হচ্ছিল। হুয়াঠো তার ব্যাগ থেকে একটি সূচ বের করলেন। তিনি চাওছাওয়ের কানের পাশে আকুপাংচার করলেন। আকুপাংচার করার কয়েক মিনিট পর চাওছাওয়ের মাথার ব্যথা অনেক কম গেল। দশ মিনিট পর যখন হুয়াঠো সূচ তুলে নিলেন, তখন চাওছাওয়ের মাথায় ব্যথা সম্পূর্ণভাবে চলে গেল। চাওছাও অত্যন্ত খুশী হলেন। তিনি হুয়াঠোকে বললেন: 'চিকিত্সক হিসেবে তোমার যোগ্যতা অসাধারণ। আমি তোমাকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ধন্যবাদ জানাবো।' চাওছাও হুয়াঠোকে তার বাড়িতে অবস্থান করতে অনুরোধ করলেন। কয়েক দিন পর হুয়াঠো টের পেলেন যে, চাওছাওয়ের অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। সুতরাং তিনি বাসায় ফিরে যেতে চাইলেন। কিন্তু চাওছাও হুয়াঠোকে অনেকটা জোর করেই তার বাড়িতে রেখে দিতে চাইলেন। হুয়াঠো চাওছাওকে বললেন: 'জনাব, আমার ছোট ভাই আমাকে চিঠি লিখেছে। আমার স্ত্রী অসুস্থ। সুতরাং স্ত্রীর জন্য আমাকে এক্ষুণি বাড়ি যেতে হবে।' নিরুপায় চাওছাও বললেন: 'পারিবারিক সমস্যার সমাধানের পর তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।'

কিন্তু ফিরে যাওয়ার পর হুয়াঠো আর চাওছাওয়ের কাছে যাননি। অন্যদিকে, চাওছাও দিন-রাত হুয়াঠোর আগমনের প্রত্যাশা করছিলেন। তিনি বেশ কয়েকবার হুয়াঠোর কাছে লোক পাঠালান। কিন্তু প্রত্যেকবার স্ত্রীর অসুখের অজুহাতে হুয়াঠো চাওছাওয়ের কাছে ফিরে যাননি। অবশেষে চাওছাও রেগে গেলেন। তিনি হুয়াঠোকে জোর করে ধরে এনে জেলে পুরলেন। হুয়াঠোকে জেলে ঢোকানোর পর চাওছাও তাকে হত্যা করার পরিকল্পনাও করলেন। কিন্তু একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা চাওছাওকে বললেন: 'হুয়াঠো একজন ভালো চিকিত্সক। তাকে হত্যা করা ঠিক হবে না।' চাওছাও বললেন: 'এ-ধরনের অহংকারী মানুষকে বাঁচিয়ে রেখে কী লাভ?' চাওছাও কর্মকর্তার পরামর্শ শুনলেন না। তিনি হুয়াঠোকে হত্যা করার নির্দেশ দিলেন। জেলের রক্ষক এ-খবর শুনে গোপনে হুয়াঠোর জন্য কয়েকটি ভাল খাবার তৈরি করল। হুয়াঠো তাকে জিজ্ঞেস করলেন: 'তুমি আমার জন্য এতো ভালো ভালো খাবার তৈরি করেছো কেন?' জেলরক্ষক হুয়াঠোকে বললেন: 'আপনি কি জানেন যে, চাওছাও আপনাকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছে?" হুয়াঠো লোকটির বিষন্ন মুখ দেখে বুঝতে পারলেন যে, তিনি চাওছাওয়ের হাত থেকে রেহাই পাবেন না। তিনি জেলরক্ষককে বললেন: 'আমি শীঘ্রই মারা যাবো। এতোদিন ধরে তুমি আমাকে অনেক সাহায্য করেছ। এর জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তোমাকে দেবার মতো আমার কাছে কিছু নেই। তুমি এই বইটি রাখো। বইটিতে দীর্ঘকাল ধরে আমার চিকিত্সার অভিজ্ঞতা লিপিবন্ধ আছে। তোমাকে এই বই যত্নে সংরক্ষণ করতে হবে।'

দু'দিন পর চাওছাও হুয়াঠোকে হত্যা করল। কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে হুয়াঠোর নাম চীনের জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত আছে। (চিয়াং/আলিম)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক