Web bengali.cri.cn   
স্বাস্থ্যখাতকে কৌশলগত শিল্প হিসেবে দেখছে দ. কোরিয়া
  2013-05-17 16:46:03  cri
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনাদের মধ্যে এমন একটি কথা প্রচলিত হয়েছে যে, সৌন্দর্যের ওপর খুব গুরুত্ব দেয় - এমন চীনা তরুণীরা দক্ষিণ কোরিয়ায় ভ্রমণ করে দেশে ফিরে আসার পর সুন্দর হয়েছে। কোনো কোনো নারীর চেহারায় এমন পরিবর্তন হয় যে, ইমিগ্রেশন বিভাগে তারা সমস্যার সম্মুখীন হয়। সিনহুয়া বার্তা সংস্থার বিশ্ব বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্রের গবেষক জু খেছুয়ান কয়েক দিনের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া সফর করেন। এ বিষয়টির সত্যতা মিলেছে তার পাঠানো একটি প্রতিবেদনে।

এপ্রিলের মাঝামাঝি পরিশ্রমী দক্ষিণ কোরীয়রা সিউলের সড়কে নতুন বছরের কর্ম-পদক্ষেপ দ্রুততর করছে। শহরের গাংনাম-কুর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল এবং নিকটবর্তী প্রদর্শনী কেন্দ্রে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ থেকে আগত কয়েকশ' অতিথির অংশগ্রহণে চিকিত্সা ও স্বাস্থ্য খাতের সহযোগিতা ও উন্নয়ন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন 'মেডিকল কোরিয়া ২০১৩" অনুষ্ঠিত হয়।

সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিদেশি অতিথিদের পরিদর্শন করা প্রথম প্রকল্প হচ্ছে জেকে প্লাস্টিক সার্জারি হাসপাতাল। হাসপাতালটি সিউল শহরের গাংনাম-কুয়ে অবস্থিত। এটা হচ্ছে দেশটির সবচেয়ে বিখ্যাত ৫টি সৌন্দর্যবর্ধন সার্জারি হাসপাতালের অন্যতম। সড়কের পাশে ৬তলা একটি ভবনের সামনে ব্যস্তসমস্ত রোগী বা গাড়ি নেই। এমনকি কিছুটা নিদ্রালু মনে হয় জায়গাটিকে। ভেতরের অপেক্ষা এলাকায় কয়েকটি লম্বা চেয়ার ও ছোট টেবিলের সামনে কয়েকজন কন্সালটেন্ট রোগীদের সঙ্গে শান্তভাবে কথাবার্তা বলেছেন। হাসপাতালের প্রধান জু ছুয়ান জানান, হাসপাতালে ১০৪জন কর্মী আছেন, যাদের মধ্য ১৪জন ডাক্তার। ৬০টি ঘরের মধ্যে মাত্র কয়েকটি প্রেসক্রিপশন, গুদাম ও মিটিং রুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বাকিগুলো ক্লিনিক ও অপারেশন রুম। রোগীদের জন্য নির্ধারিত রুমে মোট ৩১টি বিছানা রয়েছে। হাসপাতালের খ্যাতির তুলনায় এখানকার সব কর্মপরিসর খুব সংকীর্ণ – একেকটি মাত্র ৫ থেকে ৭ বর্গমিটারের। কিন্তু প্রত্যটি রুমই খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। আসল ব্যাপার হলো সৌন্দর্যবর্ধন-সার্জারির জন্য আগত অতিথিদের জন্য একটি গোপন ও নিরিবিলি স্থানের ব্যবস্থা করার জন্য হাসপাতালটিকে এ রকম করে সাজানো হয়েছে। এরকম পরিবেশে ডাক্তার ও রোগীরা পুরোপুরি যোগাযোগ ও সুবিধাজনক চিকিত্সা নিশ্চিত করতে পারে।

জেকে হাসপাতালের প্রধান জানান, হাসপাতালটি ছিল ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি প্লাস্টিক সার্জারি ক্লিনিক। পর্যায়ক্রমে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নতমানের মুখের সার্জারি প্রযুক্তি এবং সরঞ্জাম আমদানি এবং আইএসও-৯০০১ আন্তর্জাতিক মান সনদ অর্জনের মধ্য দিয়ে বর্তমানে হাসপাতালটি মুখ ও সৌন্দর্য ছাড়াও পুরো শরীরের ত্বক ও চুলের চিকিত্সার যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জন করেছে। দশ-বার বছরে হাসপাতালের চিকিত্সকরা প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার সৌন্দর্যবর্ধন-সার্জারি করেছেন এবং কোনটাতেই কোনো সমস্যা হয়নি।

উত্কৃষ্ট সেবা দেওয়ার কারণে এখানে বিদেশি অতিথি আসছেন অনেক, যাদের মধ্যে চীনা অতিথি, বিশেষ করে ২০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত নারী, সবচেয়ে বেশি। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াও তাদের জন্য সম্ভাবনাময় বাজার। কোনো কোনো অতিথি বন্ধুদের কাছ থেকে জেনে আসেন, কেউ কেউ দক্ষিণ কোরিয়ার দৃশ্যদর্শন বিভাগের ওপর নির্ভর করে পর্যটনের সুযোগ কাজে লাগিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নেন। গ্রাহকদের নানা চাহিদা পূরণের জন্য হাসপাতাল পরিবহণ ব্যবস্থা, থাকা ও চিকিত্সাসহ ওয়ান স্টপ সার্ভিসের ব্যবস্থা করে।

অতিথিদের আকর্ষণ করা এবং চমত্কারভাবে অনেক বিদেশি অতিথিকে সুদক্ষ সেবা দেওয়ার কারণে সরকার জেকে হাসপাতালকে উচ্চ মূল্যায়ন করে এবং এটিকে 'নতুন প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি - গ্লোবাল হেলথ্ কেয়ার' পুরস্কারে ভূষিত করেছে। এছাড়া স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয় হাসপাতালটিকে বিদেশি রোগীদের উত্কৃষ্ট সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি দিয়েছে।

বলা যায়, জেকে হাসপাতাল দক্ষিণ কোরিয়ার সৌন্দর্যবর্ধন সার্জারি হাসপাতালগুলোর নেতৃস্থানীয়। কিন্তু এর মাত্রা এতো বড় হয়েছে দক্ষিণ কোরীয় সরকারের দৃঢ় সমর্থন এবং সমাজের ব্যাপক চাহিদার কারণে। হাসপাতালের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সড়কের দু'পাশে তাকালে সারি সারি 'সৌন্দর্যবর্ধন সার্জারি' লেখা হাসপাতাল অথবা ক্লিনিকের সাইনবোর্ড দেখা যায়। হাসপাতালের অভ্যর্থনাকারী জানান, এ সড়কে ক্লিনিকসহ ৫ শতাধিক হাসপাতাল রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার একজন বন্ধু জানান, ২ বছর আগেই সিউল শহরে ১ হাজার ৪শ'রও বেশি সৌন্দর্যবর্ধন সার্জারি হাসপাতাল ছিল।

চীনা সৌন্দর্য্য অনুরাগীদের মধ্যে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে যে, দক্ষিণ কোরীয় ছেলেরা যখন প্রেম করার কথা ভাবে, তখন শুধু প্রেমিকের চেহারা নয়, হবু শ্বাশুড়ির চেহারা নিয়েও ভাবে। কারণ তারা বুঝতে চায়, তাদের হবু স্ত্রী প্রকৃত সুন্দরী কিনা। তাদের ভাবনা হচ্ছে, হবু স্ত্রী যদি একজন কৃত্রিম সুন্দরী হয়, তাহলে পরবর্তী প্রজন্মের ওপর তার প্রভাব পড়বে। আর হবু স্ত্রী প্রকৃত সুন্দরী কিনা, তা জানার জন্য তারা হবু শ্বাশুড়িকে দেখে নিতে চায়। সে কারণে অনেক মেয়ের মাও সৌন্দর্যবর্ধন সার্জারি হাসপাতালে যান। বিষয়টি বেশ মজার। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ কোরীয় নারীদের সৌন্দর্য্য, ভালোবাসার হৃদয় এবং স্থানীয় সৌন্দর্যবর্ধন সার্জারি হাসপাতালের উঁচু সার্জারি প্রযুক্তি প্রতিফলিত হয়েছে।

সফরকালে আমি কোরিয়া স্বাস্থ্যখাত উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের প্রধান মাদাম কাও চিংহুয়ার সঙ্গে সাক্ষাত্ করি। তিনি দেশটির এ খাতের উন্নয়নের মূল উদ্দেশ্য এবং অর্জিত সাফল্য নিয়ে কথা বলেন।

কোরিয়া স্বাস্থ্যখাত উন্নয়ন ইনস্টিটিউট ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর লক্ষ্য হলো দেশটির স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন। দশ-বার বছরের প্রচেষ্টার মাধ্যমে সরকারি উদ্যোগের সমর্থনকারী এ প্রতিষ্ঠানটি এখন স্বাস্থ্যখাতের গবেষকের ভূমিকা পালন করছে।

প্রধান কাও আরো জানান, দেশটির স্বাস্থ্যখাতের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে সরকার নীতি সমর্থন দেয়। যেমন বিদেশে এ খাতের সম্প্রসারণে উত্সাহ দেওয়া এবং সাফল্য অর্জনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুরস্কৃত ও প্রশংসা করা হয়। এছাড়া অনুরূপ শিল্পে স্বীকৃতি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা, হাসপাতালের অবকাঠামো উন্নত করা, সৃজনশীল ফার্মাসিউটিকাল শিল্প এবং এ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। ইনস্টিটিউটটি বিদেশে শাখা স্থাপন করার মাধ্যমে বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ও আদান-প্রদান গড়ে তোলে। রোগীদের দক্ষিণ কোরিয়ায় এসে চিকিত্সা নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালের কর্মকাণ্ডকে বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এ প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি পর্যটন ও দৃশ্যদর্শন বিভাগকে চিকিত্সা বিভাগের সঙ্গে বিদেশি রোগী আকর্ষণে উত্সাহ দেয়। আগামী ২০২০ সালের আগে 'আন্তর্জাতিক চিকিত্সা সেবার গুরুত্বপূর্ণ স্থানে' পরিণত করার লক্ষ্যে বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়া 'আন্তর্জাতিক যত্ন পরিকল্পনা' কার্যকর করছে। এ পরিকল্পনার আওতায় ২০২০ সাল নাগাদ বছরে ১০ লাখ বিদেশি রোগী আকর্ষণ করতে চায় দেশটি।

প্রশ্ন করা যেতে পারে স্বাস্থ্যখাতে দক্ষিণ কোরিয়া এতো বেশি শক্তি নিয়োগ করেছে কেন? কাও সংক্ষেপে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। বিগত বছরগুলোতে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রধান স্থানীয় শিল্প হিসেবে দেখা হয়েছে নির্মাণ শিল্পকে। যদিও দেশটির অর্থনীতির আকার খুবই বড়, তবে সেখানে কর্মসংস্থান কমেছে বেশ। মনে করা হচ্ছে সেবা শিল্প বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। সেকারণে দেশের জনগণ এর ওপর নিবিড় মনোযোগ দেয়। আর এ জন্যই চিকিত্সা ও স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়ন শুরু করা হয়েছে।

কাও বলেন, "গত কয়েক বছর ধরে আমরা স্বাস্থ্য খাতকে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নতুন চালিকাশক্তি হিসেবে দেখছি এবং তাকে একটি কৌশলগত খাতের পর্যায়ে উন্নীত করেছি।"

আর দক্ষিণ কোরিয়ায় এতো বেশি সৌন্দর্যবর্ধন সার্জারি হাসপাতাল কেন? সুন্দর প্রধানের উত্তরও খুবই সুন্দর: দক্ষিণ কোরীয়রা, বিশেষ করে নারীরা, নিজেদের চেহারার ওপর গুরুত্ব দেয়। অঙ্গের সৌন্দর্যবর্ধনকারী মানুষের সংখ্যা বেশি, তাই সৌন্দর্যবর্ধন সার্জারি হাসপাতালের সংখ্যাও বেশি। হাসপাতালগুলোর মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতার কারণে তাদের সেবার মানও উন্নত হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সৌন্দর্যবর্ধন সার্জারির সুনাম দেশটিতে অনেক বিদেশিকে আকর্ষণ করছে। পাশাপাশি দৃশ্যদর্শন শিল্পেরও উন্নয়নে সহায়তা করছে।

বিশ্বের অনেক দেশ বিভিন্ন সময়ে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক পরিবেশ অনুযায়ী নতুন অর্থনৈতিক উন্নয়নের কৌশল নির্ধারণ করে। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার মতো চিকিত্সা খাতকে কৌশলগত শিল্প হিসেবে নির্ধারণকারী দেশ খুব বেশি দেখা যায় না। প্রধান কাও'র ব্যাখ্যা শোনার পর আমি দশ-বারো বছর আগে প্রেসিডেন্ট কিম দায়ে-জুংয়ের সাংস্কৃতিক খাতকে উন্নত করার উদ্যোগের কথা স্মরণ করি। গত শতাব্দীর শেষ দিকে যখন দক্ষিণ কোরিয়া গুরুতর আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল, খুব কম মানুষ সংস্কৃতির ওপর গুরুত্ব দিত। কিন্তু কয়েক বছর পর 'দক্ষিণ কোরীয় স্টাইলের সংস্কৃতি' এশিয়ায় এমনকি সারাবিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দক্ষিণ কোরিয়ার চিকিত্সা কি একটি 'সৌন্দয্য স্টাইল' সৃষ্টি করবে?

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক