চেঙ্গিস খানের কৈশোর কেটেছে এক অস্থির সময়ে। তখন মঙ্গোলিয়ায় প্রায় একশো জাতির বাস ছিল। এসব জাতি চিন রাজবংশের শাসনে ছিল। অথর্নীতি ও সংস্কৃতি অনুন্নত ছিল বলে এসব জাতির মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই থাকতো। তারা ঐক্যবন্ধ ছিল না।
চেঙ্গিস খানের বাবা তখন একটি জাতির নেতা ছিলেন। যখন চেঙ্গিস খানের বয়স ৯ বছর, তখন তার বাবা শত্রুর হাতে খুন হন। তার পরিবারের ওপর নির্ভরশীল লোকেরাও একে একে সরে পড়লো। এমনকি তার পরিবারের গৃহপালিত পশুগুলো পর্যন্ত ছিনিয়ে নেয়া হল। তখন তার বাসায় কেবল তার মা, তিনি নিজে এবং তার তিন জন ছোট ভাই ছিল। তাদের কোনো সহায়-সম্পত্তি ছিল না। পরিবারের অবস্থা ছিল খুবই খারাপ। এই কঠিন পরিবেশে চেঙ্গিস খান আস্তে আস্তে বড় হন। অন্য ছেলেদের তুলনায় তিনি শক্তিশালী ছিলেন। তা ছাড়া, তার তীর ছোড়ার কৌশল খুব ভাল ছিল। ছোটবেলা থেকে তিনি ছিল অন্যদের চেয়ে আলাদা। তিনি সবসময় অন্যদের সাহায্য করতেন। কোন অন্যায় দেখলে বাঁধা দিতেন। সুতরাং স্থানীয় লোকেরা তাকে খুব পছন্দ করতো। তিনি ছেলেদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন। অন্য ছেলেরা তাকে শ্রদ্ধা করতো।
চেঙ্গিস খান বড় হওয়ার পর একজন অত্যন্ত ভাল অশ্বারোহীতে পরিণত হন। তখন তিনি মনে মনে ভাবলেন, তার প্রচেষ্টায় তার বাবার আগের শক্তি পুন:প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত। তিনি ভালভাবে জানেন, কেবল নিজের শক্তিতে শ্রত্রুদেরকে পরাজিত করতে পারবেন না। নিজের শক্তি বাড়াতে চাইলে বিভিন্ন জাতির মধ্যে দ্বন্দকে কাজে লাগিয়ে বেশ কয়েকটি জাতির সমর্থন আদায় করতে হবে। তখন তার জাতির কাছাকাছি আরেকটি বড় বড় জাতি ছিল। তিনি এই জাতির নেতার সঙ্গে বন্ধুত্ব করলেন। তিনি ওই জাতির নেতার সঙ্গে বাইরে শিকার করতে যেতেন। রাতে একই তাবুতে ঘুমাতেন। মাঝে মাঝে তিনি নেতার পরিবাবের সবাইকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াতেন। ধীরে ধীরে দু'জনের মধ্যে মৈত্রী খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। তা ছাড়া, চেঙ্গিস খানের ওপর জাতির জনসাধারণের আস্থাও দিন দিন বাড়ছিল। তারা চেঙ্গিস খানের যোগ্যতা সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করতো। তারা মনে মনে ভাবতো যে, চেঙ্গিস খান 'খো হ্যান' হবার যোগ্য। 'খো হ্যান' মানে মঙ্গোলীয় জাতির সর্বোচ্চ প্রশাসক। তাদের আন্তরিক পরার্মশ শুনে কয়েকজন উপপদস্থ কর্তা একসঙ্গে এ-ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করলেন। অবশেষে তারা একমত হলেন যে, 'খো হ্যান' হবার জন্য চেঙ্গিস খানই সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তি। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর, তারা সবাই চেঙ্গিস খানের সামনে এসে বললেন: 'ঈশ্বর আপনাকে আমাদের জাতির সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে বাছাই করেছেন। আমাদের কোন আপত্তি নেই। এখন থেকে আপনার নেতৃত্বে আমরা সম্মিলিত হয়ে শত্রুদের সঙ্গে লড়াই করবো। এখন থেকে যদি আমরা আপনার নির্দেশ না-শুনি, তবে আপনি আমাদেরকে মেরে ফেলতে পারেন।' তখন থেকেই চেঙ্গিস খান মঙ্গোলীয় জাতির সর্বোচ্চ প্রশাসক হলেন। সে বছর তার বয়স ছিল মাত্র ৩২ বছর।
'খো হ্যান' অর্থাত মঙ্গোলীয় জাতির সবোর্চ্চ নেতা হওয়ার পর চেঙ্গিস খান নিজের ক্ষমতা জোরদার করা এবং প্রতিবেশী উপজাতির আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য সেনাবাহিনী সংস্কার করতে শুরু করেন। তিনি বিশেষভাবে একটি রক্ষক বাহিনী গড়ে তোলেন। তা ছাড়া, একটি ঘোড়া-প্রশিক্ষণ ঘাঁটি স্থাপিত করেন। অল্প সময়ের মধ্যে তার শক্তি সুসংহত হল।
মঙ্গোলীয় মালভূমিতে চেঙ্গিস খান আর্বিভুত হওয়ার পর, মঙ্গোলীয় জাতির বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে দ্বন্দ্ব দিন দিন তীব্রতর হয়ে উঠল। জামুহোর নেতৃত্বে কয়েকটি উপজাতির যৌথ বাহিনী চেঙ্গিস খানের সঙ্গে লড়াই করলেন। কিন্তু অবশেষে তারা চেঙ্গিস খান বাহিনীর কাছে হেরে গেল। চেঙ্গিস খান এ-সুযোগ নিয়ে আবারও অনেক উপজাতিকে পরাজিত করলেন। তিনি বেশিরভাগ মঙ্গোলীয় ভূখন্ত একীভূত করলেন।
১২০৪ সালে চেঙ্গিস খানের বাহিনী মঙ্গোলীয় জাতির পশ্চিম অঞ্চলের শেষ উপজাতির সঙ্গে লড়াই করতে শুরু করল। দু'পক্ষের মধ্যে লড়াই মাত্র এক মাস চলল। চেঙ্গিস খানের বাহিনী জয়লাভ করল। এই উপজাতির সর্বোচ্চ নেতা আত্মসমর্পন করলেন। তার সৈন্যরা বন্দি হয়ে পড়ল। চেঙ্গিস খানের নাম গোটা মঙ্গোলীয় মালভূমিতে ছড়িয়ে পড়ল। গোটা মঙ্গোলীয় জাতিকে এক করার কাজ সম্পন্ন হল। এরপর তিনি গোটা মঙ্গোলীয় মালভূমির জমি তার আত্মীয়স্বজন ও ছোট-বড় নেতাদের মাঝে বন্টন করলেন। যাদের বয়স ১৬ বছর বেশী এবং ৭০ বছর কম তারা সৈন্যের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হল। শান্তির সময় তারা চাষাবাদ করতো এবং যুদ্ধের সময় করতো যুদ্ধ। নিজেকে রক্ষার জন্য চেঙ্গিস খান উপজাতি পরিবারের সন্তানদেরকে নিয়ে একটি বিশেষ বাহিনী গড়ে তুললেন। তিনি সরাসরি এই বাহিনী পরিচালনা করতেন। তা ছাড়া, তিনি বিচার সংস্থা প্রতিষ্ঠা করলেন। তিনি মঙ্গোলীয় ভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। প্রশাসন পরিচালনায় চেঙ্গিস খান বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
মঙ্গোলীয় জাতি একীভূত হওয়ার পর, চেঙ্গিস খান চিন রাষ্ট্রের শাসন থেকে মুক্ত হবার পরিকল্পনা করলেন। তখন চিন রাষ্ট্র মধ্য চীনের অনেক জায়গা বিস্তৃত ছিল। মঙ্গোলীয় জাতির একীকরণ বাস্তবায়িত হওয়ার তিন বছর পর চেঙ্গিস খান চিন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ও তার চার ছেলে একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দিলেন। মাত্র তিন মাসের মধ্যে তারা চিন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন জনডু বা বতর্মানের পেইচিং অঞ্চলে পৌঁছে গেলেন। লড়াইয়ে চেঙ্গিস খানের বাহিনী চিন রাষ্ট্রের সৈন্যদের কাছ থেকে তিন হাজার ঘোড়া ও অজস্র মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নিল। তারা ঘোড়া ও মূল্যবান জিনিস মালভূমিতে নিয়ে গেল। এই লড়াইয়ের পর চিন রাষ্ট্রের রাজা আর জুনডুতে থাকার সাহস পেলেন না। তিনি তার পরিবার নিয়ে বিনলিয়েন নামে একটি জায়গায় সরে গেলেন।
১২১৯ সালে চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে দুই লাখ সৈন্য পশ্চিম দিকে অভিযান শুরু করল। পশ্চিম দিকে যাওয়ার পথে মঙ্গোলীয় বাহিনী অনেক নগর দখল করল। বর্তমান মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশ তাদের পদানত হল। পশ্চিম অভিযানে মঙ্গোলীয় বাহিনী জয়লাভ করল। এ-সব সাফল্যে চেঙ্গিস খান অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন। তখন তার মনে এই ভাবনার উদয় হলো যে, তিনি গোটা বিশ্ব জয় করার ক্ষমতা রাখেন।
ছ'বছর পর, চেঙ্গিস খান ডুছেন বা বর্তমান মঙ্গোলিয়ায় ফিরে এলেন। সারা বিশ্বকে জয়ের চিন্তা করার পাশাপাশি তিনি ইতোমধ্যে বুঝতে পারলেন যে মানুষের জীবন সীমিত। তখন তার বয়স কম নয়। তিনি মনে মনে ভাবলেন, তার এই মহান আশা-আকাঙ্ক্ষা পরিকল্পনা সম্পন্ন করতে কত সময় লাগবে? সুতরাং নিজের আয়ু বাড়ানোর জন্য নানা ধরনের পদ্ধতি খুঁজতে শুরু করলেন। একদিন তিনি মন্দিরে গিয়ে একজন গুরুকে জিজ্ঞেস করলেন: 'গুরু, আমি জানতে চাই, দীর্ঘজীবি হওয়ার কোনো উপায় আছে কি না।' তার কথা শুনে গুরু উত্তর দিলেন: 'আমি মিথ্যা কথা বলতে চাই না, পৃথিবীতে দীর্ঘজীবি থাকার কোন ঔষুধ নেই। কেবল আয়ু একটু বাড়ানো যেতে পারে।'
যখন চেঙ্গিস খান বয়স ৬৪ বছর, তখন তিনি শেষবার মঙ্গোলীয় বাহিনী পরিচালনা করলেন। এক লড়াইয়ে তিনি ঘোড়া থেকে মাটিতে পড়ে গেলেন। পরের দিন তার জ্বর এলো। আট দিন পর তিনি মারা গেলেন। এই বীরকে স্মরণ করার জন্য জনসাধারণ তার জন্য একটি সমাধি নির্মাণ করল।