Web bengali.cri.cn   
চীনের মিং রাজবংশ আমলের বিখ্যাত উপনাস লেখক উ ছেন এন সম্পর্কে।
  2013-06-19 19:28:41  cri
উ ছেন এন ১৫০০ সালে তত্কালীন সেনইয়ান এবং বতর্মানের চিয়াংসু প্রদেশের হুয়েআনে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকে তিনি রূপকথা পড়তে পছন্দ করতেন। বৃদ্ধ বয়সে তিনি চীনের ইতিহাসের অত্যন্ত বিখ্যাত ভূতের উপন্যাস 'পশ্চিম যাত্রা' লিখেছিলেন। এই উপন্যাস শত শত বছর ধরে চীনা মানুষের অন্যতম প্রিয় উপন্যাস। রূপকথা ও উপন্যাস লেখা ছাড়া তিনি কবিতা লিখতেও পছন্দ করতেন। তিনি জীবনে অনেক কবিতাও লিখেছেন।

উ ছেন এনের দাদা এবং দাদার বাবা রাজদরবারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন । কিন্তু তার দাদা মধ্যবয়সে মারা যান। সুতরাং উ ছেন এনের বাবা একটি ছোট দোকান চালিয়ে জীবিকা অর্জনে বাধ্য হন। অবসর সময়ে তিনি ছেলে উ ছেন এনকে নানা ধরনের গল্প বলতেন। উ ছেন এন নিষ্ঠার সঙ্গে তার বাবার গল্প শুনতেন। যখন উ ছেন এনের বয়স সাত বছর, তখন তিনি স্কুলে পড়াশুনা করতে শুরু করেন। অল্প সময় পর তিনি কবিতা লিখতে শুরু করেন। স্থানীয় লোকজন তার লেখা কবিতার প্রশংসা করতেন। যখন গ্রামের ছেলেরা খেলার মাঠে খেলাধুলা করতো, তখন উ ছেন এন ঘরে বসে বই পড়তেন। লোকেরা তাকে 'বাল্য পন্ডিত' বলে ডাকতো।

চীনের প্রাচীনকালে রাজদরবারের কোন একটি কর্মকর্তার পদ অর্জন করতে চাইলে রাজদরবারের বিশেষ ধরনের পরীক্ষায় অংশ নিতে হতো। এক বছর উ ছেন এন ও তার কয়েক জন বন্ধু এক সঙ্গে নানচিনে আয়োজিত পরীক্ষায় অংশ নিতে গেলেন। উ ছেন এন খুব নিশ্চিত ছিলেন যে, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সামর্থ্য তার আছে। কয়েক দিন পর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হল। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন উত্তীর্ণদের নামের তালিকায় তার নাম নেই। তিনি মর্মাহত হলেন। তিন ভাবলেন, পরিচিতজনদের কাছে তার আর কোনো মর্যাদা রইল না এবং তিনি পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করার স্বপ্ন পূরণেও ব্যর্থ হয়েছেন। পরের বছর তার বাবা মারা যান। পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তার কাঁধে এসে পড়ে। তিনি আবার নিষ্ঠার সঙ্গে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।

তিন বছর পর উ ছেন এন আরেকবার নানচিনে আয়োজিত রাজদরবারের পরীক্ষায় অংশ নিতে গেলেন। কিন্তু এবারও তিনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হননি। তিনি একজন মেধাবী ও জ্ঞানী যুবক। কিন্তু তিনি দু'বার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হননি। তিনি নিজে নিজেই অত্যন্ত লজ্জাবোধ করলেন। দুশ্চিন্তায় একদিন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি বিষন্নতায় ভুগতে লাগলেন। পরীক্ষায় আবারো অংশ নেওয়ার আগ্রহও হারিয়ে ফেললেন। এমনকি তার তখন বই পড়তেও ইচ্ছা করতো না।

পরীক্ষায় বারবার ব্যর্থ হলেও, তিনি একজন জ্ঞানী লোক ছিলেন, তাতো কোন সন্দেহ নেই। চারপাশের সবাই তার লেখা কবিতা পড়তে পছন্দ করতেন। ধীরে ধীরে জন্মস্থানে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লো। এক বছর, তত্কালীন রাজা দক্ষিণ চীন পরিদর্শন করেন। রাজাকে স্বাগত জানানোর জন্য স্থানীয় কর্মকর্তা জনসাধারণের কাছ থেকে টাকা ও মালপত্র সংগ্রহ করেন। এই দৃশ্য দেখে উ ছেন এনের খুব খারাপ লাগলো। তিনি সঙ্গে সঙ্গে দু'টো কবিতা লিখলেন। এ দু'টো কবিতার সারমর্ম ছিল: 'দুনিয়া তখন শান্ত ছিল না। মানুষের ওপর নির্যাতন করার ভূত আছে। স্বর্গ থেকে অলৌকিক কোন প্রাণী তাদেরকে দমন করলে আনন্দের ব্যাপার হবে।' তিনি পাপময় শক্তিকে ঘৃণা করেন। তার আশা ছিল, কোন বীর এসে দেশের জনসাধারণকে মুক্ত করবেন। এই চিন্তা থেকেই তিনি পরে 'পশ্চিম যাত্রা' নামের ভূতের উপন্যাস লিখেছিলেন।

একসময় উ ছেন এন আবারও একটি স্কুলে ভর্তি হন। তিনি আশা করছিলেন যে, ভবিষ্যতে একদিন রাজা তার মেধা ও জ্ঞানের কদর করবেন। তখন তার বয়স ৫০ বছর। যুবকদের তুলনায় তার জ্ঞান অনেক বেশী। তবে তারা মাঝে মাঝে উ ছেন এনকে উপহাস করত। একদিন একজন যুবক উ ছেন এনকে বলল: 'দেখুন, আপনার বয়স কত হয়েছে! আমাদের সঙ্গে পড়াশুনা করা কি লজ্জার ব্যাপার নয়?' এ কথা শুনে উ ছেন এনের অত্যন্ত রাখাপ লাগলো। যদিও আপাতদৃষ্টিতে তাকে এ-কথা উদাসীনই মনে হলো। পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি অনেক নিবন্ধ ও কবিতা লিখেছেন। অবশ্যই তিনি আরও বেশী বই পড়েছেন। তার জ্ঞান আরও অনেক সমৃদ্ধ হল। কয়েক বছর পর অবশেষে তিনি বতর্মান জেচিয়াং প্রদেশের জানশিয়েন জেলার গর্ভনের একজন সহকারি হিসেবে নিয়োগ পান। এটি ছিল নিম্নশ্রেণীর কর্মকর্তার পদ। সারা দিন গর্ভনরের জন্য দলিলপত্র ঠিকঠাক করা তার কাজ ছিল। সে বছর তার বয়স ৬২ বছর ছিল।

দীর্ঘকাল তিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে বসবাস করেছিলেন বিধায়, তাদের শেচনীয় জীবন তিনি নিজের চোখে দেখেছেন; দেখেছেন স্থানীয় কর্মকর্তাদের নির্যাতন। জীবনে প্রথমবারের মতো একজন কর্মকর্তা হয়ে তিনি সততাকে পথ চলার পাথেয় হিসেবে বেছে নিলেন; মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন, কোনো অবস্থাতেই দুর্নীতি করবেন না এবং জনগণের কোনো ক্ষতি করবেন না। তিনি ভোর থেকে সন্ধ্যা পযর্ন্ত জনসাধারণের সুখ-দূ:খের খোজখবর নিতেন। অনেক সময় এ-কাজে তিনি এতো ব্যস্ত থাকতেন যে, বাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা ভুলে যেতেন। কিন্তু তিনি একজন সরল মানুষ ছিলেন। অন্যদেরকে তোষামোদ করা পছন্দ করকেন না। তার আশেপাশের অন্যান্য কর্মকর্তারা তাকে এজন্য অপছন্দ করতো। কেউ কেউ তাকে বললেন: আপনি এতো সরল কেন? প্রতিদিন আপনি ব্যস্ত সময় কাটান। অথচ তোষামোদ করতে জানেন না। একদিন আপনার সর্বনাশ হবেই।' দু'বছর পর নানা অজুহাতে উ ছেন এনকে বরখাস্ত করা হল। তারপর তিনি জন্মস্থানে ফিরে গেলেন। এরপর তার মনে কোনোদিন আর কর্মকর্তা হবার সাধ জাগেনি।

জন্মস্থান হুয়েআন ফিরে আসার পর, উ ছেন এন আবার সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করতে শুরু করলেন। তিনি বুড়ো হয়েছেন। তার কাছে বেশি টাকা ছিল না। তা ছাড়া, তার কোনো সন্তানও ছিল না। কিন্ত তা সত্ত্বেও তিনি বিষন্ন হয়ে পড়েননি। তিনি প্রতিদিন বই পড়তেন এবং কবিতা লিখতেন। জন্মস্থানে ফিরে আসার দ্বিতীয় বছরে তিনি 'পশ্চিম যাত্রা' উপন্যাস শিখতে শুরু করেন। উপন্যাসে বৌদ্ধ তত্ত্ব সংগ্রহ করার জন্য একজন সন্নাসী ও তার তিন শিষ্যের ভারত যাত্রার কষ্ট বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। গল্পে বর্ননা করা হয়েছে: তারা চার জন ভারতে যাওয়ার পথে অনেক ধরনের ভূতের আক্রমণের শিকার হন। কিন্তু তারা একের পর এক ভুতগুলোকে নিমূর্ল করে অবশেষে তাদের গন্তব্যস্থান ভারত পৌছান। যখন তিনি এই উপন্যাস লিখতে শুরু করেন তখন তার বয়স ৭১ বছর। যখন তিনি এই উপন্যাস শেষ করেন তখন তার বয়স ৮১ বছর। এ দশ বছরে তিনি প্রতিদিন লিখতেন। লিখতেন আর সংশোধন করতেন। তার নিরলস প্রচেষ্টার ফলে অবশেষে একটি আকর্ষণীয় উপন্যাস লেখা হল। উ ছেন এনের লেখা 'পশ্চিম যাত্রা' উপন্যাসকে চীনের তিনটি বিখ্যাত উপন্যাসের অন্যতম বলে ধরা হয়। উ ছেন এনের নাম চীনের ঘরে ঘরে পরিচিত। চীনের সাহিত্য ইতিহাসে উ ছেন এনের অবদান বিশেষভাবে প্রশংসনীয়।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক