Web bengali.cri.cn   
চীনের দক্ষিণ সং রাজবংশ আমলের বিখ্যাত সমরবিদ ইউয়ু ফি সম্পর্কে শুনবেন।
  2013-04-16 15:41:17  cri
ইউয়ু ফি চীনের দক্ষিণ সং রাজবংশ আমলে চিন জাতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধের একজন বিখ্যাত বীর ছিলেন। সং রাজবংশের হারিয়ে-যাওয়া ভূমি ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি অবদান রেখেছেন। তিন্তু তত্কালীন রাজা ও তার আশেপাশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার শত্রুতার কাছে তাকে নতি স্বীকার করতে হয়েছিল। তার ওপর শত্রুরা মিথ্যা দোষারোপ করে এবং পরিণামে তাকে আত্মহত্যা করতে হয়। কিন্তু ইউয়ু চিরকাল চীনা জনসাধারণের মনে বেঁচে থাকবেন।

চীনের উত্তর সং রাজবংশ আমলের শেষ দিকের কথা। শিয়াংযৌ ঠাংইয়েন জেলা তখন বতর্মান হোনান প্রদেশে অবস্থিত। ইউয়ুহো নামে একজন কৃষক ওই জেলার একটি গ্রামে বাস করতো। তখন ১১০৩ সাল। একদিন ইউয়ু ফি এই কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

ইউয়ু ফির পরিবারের অবস্থা ভাল ছিল না। তার বাবা মা অন্যদের জমি চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সন্তানদের পড়াশুনার খরচ বহনের সামর্থ্য তাদের ছিল না। ছোটবেলা থেকে ইউয়ু ফি তার বাবা-মার সঙ্গে কৃষি জমিতে কাজ করতেন। ইউয়ু ফিকে পড়ানোর জন্য রাতের বেলায় তার বাবা একটি লাঠি দিয়ে মাটিতে শব্দ লিখতেন। তারপর তিনি বারবার এ সব শব্দ লিখতেন। মাঝে মাঝে তিনি ভোরবেলা পযর্ন্ত লিখতেন। কয়েক বছর পর ইউয়ু ফি অনেক শব্দ শিখে ফেলেন। এর মধ্যে তিনি বেশকিছু বইও পড়েছেন। তিনি বিশেষ করে চীনের প্রাচীনকালের কয়েকটি সামরিক তত্ত্ব সম্পর্কিত বই পড়েছেন। বইগুলোর চমত্কার অধ্যায়ওগুলো তার মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল।

ছোটবেলা থেকে কৃষিকাজ করতেন বলে ইউয়ু ফি শরীর-স্বাস্থ্য খুব ভাল ছিল। যখন তার বয়স ১৪ বছর, তখন তিনি একজন গুরুর কাছ থেকে কুংফু শিখলেন। ওই গুরুর তীর ছোড়ার কৌশলও অত্যন্ত ভাল ছিল। বিভিন্ন স্থান থেকে যুবকরা তার কাছে তীর ছোড়ার কৌশল শিখতে আসত। একদিন একটি খোলা মাঠে গুরু তার সকল শিষ্যকে একত্রিত করলেন। তিনি প্রথমে তিনটি তীর ছুড়লেন। প্রতিটি তীর লক্ষ্যবস্তুতে গিয়ে আঘাত হানল। উপস্থিত সকলে হাততালি দিয়ে গুরুকে অভিনন্দন জানালো। গুরু বললেন: 'তোমরা একটু আগে আমার তীর ছোড়া দেখেছ। যদি তোমরা আমার মত নৈপূণ্য দেখাতে পার, তাহলে আমি তোমাদেরকে আরও জটিল কৌশল শিখিয়ে দেবো।'

ইউয়ু ফি তাড়াতাড়ি গুরুর সামনে এসে দাঁড়ালেন। তিনি আন্তরিকভাবে গুরুকে সালাম করে বললেন: 'আমি আপনার মতো তিনটি তীর ছুড়তে চাই। দেখেন আমি আপনার মতো পারি কি না?" গুরু সাথে সাথে ইউয়ু ফিকে তিনটি তীর দিলেন। ইউয়ু ফি একে একে তীর তিনটি ছুড়লেন। গুরুর মতো ইউয়ু ফির ছোড়া প্রতিটি তীর গিয়ে লক্ষ্যবিন্দুতে আঘাত হানল। ইউয়ু ফির চমত্কার নৈপূণ্য দেখে গুরু মহা খুশী হলেন। তিনি ইউয়ু ফিকে তার প্রধান শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করলেন। পরে তিনি তীর ছোড়ার সমস্ত কৌশল ইউয়ু ফিকে শিখিয়ে দিলেন।

দু'বছর পর গুরু মারা গেলেন। ইউয়ু ফি মর্মাহত হলেন। এরপর গুরুকে স্মরণ করার জন্য তিনি প্রতি বছর গুরুর কবরের সামনে কমপক্ষে একবার পুস্পমাল্য অর্পণ করতে আসা শুরু করলেন। একদিন ইউয়ু ফির বাবা ইউয়ুহোজু তাকে জিজ্ঞেস করলেন: 'তোমার শিক্ষক কেবল তোমাকে তীর ছোড়ার কৌশল শিখিয়ে দিলেন। তোমার তাকে এত শ্রদ্ধা করার কারণ কী?' বাবার কথা শুনে ইউয়ু ফি উত্তর দিলেন: 'আমার গুরু তার সারা জীবনের রপ্ত করা কৌশল আমাকে শিখিয়ে দিয়েছেন। আমি তার কাছ থেকে যে-কৌশল শিখেছি, সারা জীবন তা কাজে লাগাতে পারবো। এই জন্য আমি তার ওপর কৃতজ্ঞ।' ইউয়ু ফির কথা শুনে তার বাবা মনে মনে খুব খুশী হলেন। তিনি ভাবলেন তার ছেলে সত্যই সত্যিই বড় হয়েছে। তিনি ইউয়ু ফির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন: 'খুব ভাল বাবা। যদি কোনোদিন দেশের তোমাকে প্রয়োজন হয়, তখন দেশের জন্য অবদান রাখতে পারবে তো?' ইউয়ু ফি মাথা উঁচু করে দৃঢ়ভাবে তার বাবাকে বললেন: 'ভবিষ্যতে আমি অবশ্যই দেশের সেবা করবো।'

যখন ইউয়ু ফির বয়স ২০ বছর, তখন তিনি পরিপক্ক এক যুবক। কথা কম বলেন এবং অত্যন্ত শান্ত স্বভাবের। তখন উত্তর দিকের চিন রাষ্ট্র মাঝে মাঝে সং রাজবংশের সীমান্তে হামলা চালাতে শুরু করে। ইউয়ু ফি মনে মনে ভাবলেন, দেশের জন্য সেবার করার সময় হয়েছে। তিনি সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিলেন। লড়াইয়ের ময়দানে কৃতিত্ব দেখিয়ে তিনি অল্প সময়ের মধ্যে সৈন্যবাহিনীর একজন ছোট অফিসার পদ লাভ করেন। একদিন যখন তার নেতৃত্বে নিয়মিত প্রশিক্ষণ চলছিল, তখন দূর থেকে মানুষ ও ঘোড়ার আওয়াজ ভেসে আসল। একজন সৈন্য চিত্কার করে বলল: ' উত্তর দিক থেকে চিন রাষ্ট্রের সৈন্য আমাদের দিকে আসছে।' সবাই উত্তর দিকে তাকলো। দেখা গেল, সংখ্যায় তাদের দ্বিগুণ শত্রুসেনা তাদের দিকে ধেয়ে আসছে। ঠিক সে সময় ইউয়ু ফি নিজের সৈন্যদেরকে বললেন: 'আমাদের চেয়ে শত্রুর সংখ্যা বেশী। সুতরাং আমাদের মনোবল বাড়াতে হবে। যদি আমরা অত্যন্ত সাহসিকতা প্রদর্শন করতে পারি, তাহলে শত্রুরা ভয় পেয়ে পালিয়ে যাবেৱ। এখন তোমরা সবাই আমাকে অনুসরণ কর।' কথা শেষ করে ইউয়ু ফি তার তরবারী উচু করে উঁচু করে সিংহের মতো গর্জন করে উঠলেন এবং শত্রুর দিকে তেড়ে গেলেন। তারপর সবাই ইউয়ু ফির মতো করতে লাগল। চিন রাষ্ট্রের সৈন্যরা সেই বিকট শব্দে এবং শত্রু সৈন্যদের সাহসিকতায় বিভ্রান্ত হলো। তারা ভাবলো, নিশ্চয়ই সামনের ছোট দলটির পেঁছনে আরো বড় দল আছে। তাই অমন তেড়ে আসছে। তারা ভয় পেয়ে পিছু হটে গেল। ইউয়ু ফি ও তার সৈন্যরা শত্রুদের অনেকটা পথ পিছন পিছন ধাওয়া করল। এ-খবর দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো এবং ইউয়ু ফি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন।

এরপর ইউয়ু ফি যুদ্ধে অনেক বার বিজয়ী হয়েছেন। তিনি ধীরে ধীরে পদোন্নতি পেয়ে, শেষপর্যন্ত জেনারেল হলেন। তখন দেশের অনেক হৃতভূমি তিনি পুনরুদ্ধার করেন। তার বিজয় অভিযান যখন চলছিল, ঠিক তখন তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ছিনগুয়ে আড়ালে ইউয়ু ফির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছিলেন। তিনি তত্কালীন রাজার সামনে ইউয়ু ফির বিরুদ্ধে খারাপ কথা বললেন। রাজার মনেও সন্দেহ ঢুকলো। রাজা ভয় পেলেন এই ভেবে যে, এভাবে চলতে থাকলে ইউয়ু ফি একসময় অনেক বেশি জনপ্রিয় ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেন এবং তাকে তখন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না-ও হতে পারে। সুতরাং রাজা ইউয় ফিকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে আসার নির্দেশ দিলেন। রাজার এই নির্দেশপত্র পেয়ে ইউয়ু ফি রাজাকে একটি চিঠি লিখলেন। চিঠিতে তিনি লিখলেন, 'বতর্মানে শত্রুদের উদ্যম অত্যন্ত কম আছে। আমাদের সৈন্যদের উদ্যম অত্যন্ত বেশী। এবার আমরা তাদেরকে নিমূর্ল করতে পারবো। যদি এখন প্রত্যাহার করি তাহলে এখানকার হৃতভূমি পুনরুদ্ধার করা আর সম্ভব হবে না।' কিন্তু রাজার কাছে চিঠি পাঠানোর পর ইউয়ু ফি একদিনে ১২টি নির্দেশপত্র পেলেন। তখন ইউয়ু ফি পুরোপুরি বুঝতে পারলেন যে, তাকে ফিরে যেতেই হবে। ইউয়ু ফির বাহিনী সরে যাবে শুনে স্থানীয় জনসাধারণ অত্যন্ত বিষন্ন হয়ে পড়ল। ইউয়ু ফি স্থানীয় জনসাধারণকে বললেন, রাজার নির্দেশ মেনে নিতে হবে । তার কোনো উপায় নেই।

পরে জানা যায় যে, প্রধানমন্ত্রী ছিনগুয়ের কুপরামর্শেই তত্কালীন রাজা চিন রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়াই বন্ধ করেছিলেন। কিন্ত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অপরাসরণের পরও রাজা ও প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিত হতে পারলেন না। তারা ইউয়ু ফিকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

১১৪২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মহান বীর ইউয়ু ফি নিজেই বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন। তার মৃত্যু বিশ বছর পর সু রাজবংশ আমলের তত্কালীন কর্তৃপক্ষ তাকে বীরের সম্মানে ভূষিত করে এবং হ্যাংযৌ শহরের পশ্চিম হ্রদের পারে তার জন্য একটি সমাধি-সৌধ নির্মাণ করা হয়। শত শত বছর ধরে লোকজন তার সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে আসছে। সুদীর্ঘকাল ধরে ইউয়ু ফি দেশপ্রেমিকদের কাছে এক প্রেরণার নাম হয়ে বেঁচে আছেন।

(চিয়াং/আলিম)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক