Web bengali.cri.cn   
চীনের ইউয়ান রাজবংশ আমলের বিখ্যাত নাট্যকার গুয়ানহাংছিন সম্পর্কে।
  2013-04-09 14:24:59  cri
গুয়ানহাংছিন চীনের ইউয়ান রাজবংশ আমলের একজন বিখ্যাত নাট্যকার। জীবনে তিনি ষাটটিরও বেশি নাটক লিখেছেন। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি নাম-করা নাটকের নাম হল: 'টোওইয়ান' 'হুডিমন', 'চিওফেনছেন' 'ডেডাওহুয়ে', 'হুয়াংচিয়াংটিন' ইত্যাদি। তাঁর লেখা নাটকগুলোতে শাসকদের নিষ্ঠুরতার সমালোচনা এবং জনসাধারণের সংগ্রামের প্রশংসা করা হয়েছে। তার লেখাগুলোর নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। চীনের নাট্য জগতে গুয়ানহাংছিনের অবদান অনস্বীকার্য।

ইউয়ান রাজবংশ আমলে চীনের নাটক অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। বিশেষ করে চীনের উত্তরাঞ্চলে নাটকের মান খুব উঁচু ছিল। ইউয়ান রাজবংশের রাজধানী ছিল পেইচিং। তখন সমাজের উচ্চ শ্রেণীর লোকেরা সময় সময় থিয়েটারে নাটক উপভোগ করতে অভ্যস্ত ছিলেন। তখন ইউয়ান রাজবংশের শাসক ছিল মঙ্গোলিয়। হ্যান জাতির লোকের পক্ষে কর্মকর্তা হওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। গুয়ানহাংছিন এ-অন্যায়ের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করতেন। নাটকের ব্যাপারে আগ্রহের কারণে, শেষ পর্যন্ত তিনি নাটক লিখতে উত্সাহী হয়ে ওঠেন। সে-সময় তিনি মাঝে মাঝে অন্যান্য শিল্পীর সঙ্গে নাটক নিয়ে মত বিনিময় করতেন। তিনি তাদের সঙ্গে নাটক দেখতে যেতেন। কোন কোন সময় তারা নিজেরাই মঞ্চে উঠে নাটকে অভিনয় করতেন।

চীনের সামন্ততাত্রিক সমাজে দুর্নীতি খুব প্রচলিত ছিল। কর্মকর্তারা সব সময় নিজেদের স্বার্থ দেখতেন; জনসাধারণের দিকে তাদের খেয়াল ছিল না। এক বছর সারা দেশে প্রায় দশ হাজার দুনীর্তিপরায়ণ কর্মকর্তাকে একসঙ্গে উত্খাত করা হলো। গুয়ানহাংছিন এ-খবর শুনে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হলেন। দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাকে নিন্দা জানাতে তিনি তার বিখ্যাত নাটক 'টোওইয়ান' রচনা করলেন। নাটকে টোও নামক একজন মহিলার শোচনীয় জীবনের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। নাটকের গল্পটি মোটামুটি এমন: টোও স্থানীয় পন্ডিত টোতিয়েজেনের মেয়ে। ঋণ পরিশোধের জন্য তিনি তার মেয়ে টোও-কে তার ঋণদাতা মহিলা ছেইপুপুর কাছে বাল্যবধু হিসেবে বিক্রি করলেন। যখন টোও-এর বয়স ১৭ বছর তখন ছেইপুপুর ছেলের সঙ্গে তার বিয়ে হল। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে তার স্বামী মারা গেল। সংসারে দু'জন মহিলা ছাড়া আর কেউ রইল না।

এদিকে, লু নামের একজন চিকিত্সক ছেইপুপুর কাছ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে না-পেরে ছেইপুপুকে খুন করার সিদ্ধান্ত নিল। একদিন মিথ্যা অজুহাতে ছেইপুপুকে বাইরে নিয়ে গিয়ে দা দিয়ে কুপিয়ে খুন করার চেষ্টা করলো। ঠিক সে সময় ছেন লু য়ে নামে একজন লোক সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। সে সেই চিকিত্সকের কবল থেকে ছেইপুপুকে বাঁচালো। তারপর ছেইপুপু ছেন লু য়েকে বাসায় নিয়ে আসলেন। কিন্তু কে জানতো যে, ছেন লু য়ে ভীষণ পাজি লোক। সে মনে করল, সে ছেইপুপুকে বাঁচিয়েছে; বিনিময়ে তার কিছু পাওয়া উচিত। সে টোও-কে বিয়ে করতে চাইল। কিন্তু টোও সে-প্রস্তাবে রাজি হলো না।

তখন ছেন লু য়ে একটি মতলব আঁটলো। একদিন ছেইপুপু অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ছেনলুয়ে এক বোতল বিষ কিনলো। তার পর সে চুপি চুপি ছেইপুপুর স্যুপে এই বিষ ঢেলে দিল। সে বিষ দিয়ে ছেইপুপুকে খুন করতে চেষ্টা করল। সে মনে মনে ভাবল, যদি ছেইপুপু এই বিষাক্ত স্যুপ খেয়ে মারা যায়, তাহলে সে টোও-কে এর জন্য দায়ী করবে। নিরুপায় হয়ে টোও তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হবে। কিন্তু ছেনলুয়ের বাবা ছেনলাওডো এই স্যুপ খেয়ে সঙ্গে সঙ্গে মারা গেল। ছেনলুয়ে তার বাবার মৃত্যু দেখে টোওকে চিত্কার করে বলল: 'তুমি সময় নষ্ট না-করে আমাকে বিয়ে কর। নইলে আমি কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করবো যে, তুমি আমার বাবাকে খুন করেছো।" টোও সাথে সাথে উত্তর দিল: 'আমি তোমার বাবাকে খুন করিনি। আমিও এ-ব্যাপারে অভিযোগ করতে কতৃর্পক্ষের কাছে যাবো।' দু:খের ব্যাপার হল, জেলার গর্ভনর একজন দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তা ছিল। সে ছেনলুয়ের কাছ থেকে ঘুষ খেয়ে তার পক্ষে কথা বললো। টোও অভিযোগ অস্বীকার করায়, ওই কর্মকর্তা ছেপুপুকে লাঠিপেটা করার নির্দেশ দিল। লাঠির আঘাতে শ্বাশুড়ির মৃত্যু হতে পারে এই আশঙ্কায় টোও ছেনলওডোকে খুন করেছে বলে স্বীকারোক্তি দিল। কর্তৃপক্ষ টোওকে মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত করলো। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার আগে বিচারপতি টোওকে জিজ্ঞেস করলেন: "তোমার কিছু বলার আছে?' টোও বললেন: 'আমার পায়ের সামনে একটি শীতল পাটি বিছানো হোক এবং পতাকার স্তম্ভে সাদা কাপড় লাগানো হোক।" তার কথা শুনে বিচারপতি টোওকে জিজ্ঞেস করলেন: 'তোমার কথার অর্থ কী? আমি বুঝি না।' টোও উত্তর দিলেন: 'আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করার জন্য আমি এই শীতল পাটিতে দাঁড়িয়ে মারা যাবো। আমার রক্ত মাটিতে না-ফেলে বরং সাদা কাপড়ে মাখিয়ে উড়িয়ে দেয়া হবে।" বিচারপতি টোওয়ের অনুরোধ রাখলেন। তারপর টোও আবার বললেন: 'এখন গরমকাল। কিন্তু আমার প্রতি যে অন্যায় হয়েছে তার প্রতিবাদস্বরূপ আমি ঈশ্বরকে অনুরোধ করবো তিন দিন ধরে তুষারপাত ঘটাতে।" তার কথা শুনে বিচারপতি খুব রেগে গেলেন। তিনি চিত্কার করে বললেন: 'তুমি তো শীঘ্রই মারা যাবে। এখন তুমি আবোল-তাবোল কথা বলছ। জুন মাসে কি তুষার পড়তে পারে?" টোও দৃঢ়ভাবে বললেন: 'আমি নিশ্চিত, আগামিকাল থেকে তিন দিনব্যাপী তুষারপাত হবে।" অবাক ব্যাপার হল, টোও-এর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পর সত্যি সত্যিই তিন দিন ধরে তুষার পড়ল এবং তার রক্তও ঠিকই সেই সাদা কাপড়ে ছড়িয়ে পড়ল।

তিন বছর পর টোওয়ের বাবা টোতিয়েজেন জুযো পরিদর্শন করার সময় তার মেয়ের ঘটনা শুলনেন। তখন তিনি রাজদরবারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তিনি স্থানীয় গর্ভনরকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিলেন। পরে টোওয়ের গল্প সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো।

গুয়ানহাংছিনের লেখা 'টোওইয়ান' পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে মঞ্চস্থ হয়। দর্শকরা এই নাটক দেখে অত্যন্ত মুগ্ধ হতেন। নাটক ছাড়া গুয়ানহাংছিন অনেক সঙ্গীতও লিখেছেন। তার লেখা সঙ্গীতও খুব জনপ্রিয় ছিল। তার লেখা সঙ্গীতগুলোর মধ্যে অধিকাংশেই দেশের সুন্দর দৃশ্যে বর্ননা করা হয়েছে।

গুয়ানহাংছিন বেড়াতে পছন্দ করতেন। একদিকে তিনি দক্ষিণ চীনের বিভিন্ন জায়গার প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতেন এবং অন্যদিকে উত্তর চীনের শিল্পকলা প্রচার করতেন। সময় পেলে তিনি স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে শিল্পকলা বিশেষভাবে নাটক নিয়ে মত বিনিময় করতেন। মাঝে মাঝে তিনি স্থানীয় জনসাধারণকে নাটক পরিবেশনে সাহায্য করতেন।

চীনের ইউয়ান রাজবংশ আমলে কবিতা, সঙ্গীত ও নাচের তুলনায় নাটক অপেক্ষাকৃতভাবে অনুন্নত ছিল। কিন্তু গুয়ানহাংছিনের অবিরাম প্রচেষ্টায় নাটক ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে।

(চিয়াং/আলিম)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক