Web bengali.cri.cn   
চীনের উত্তর সং রাজবংশ আমলের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, চিন্তাবিদ ও ঐতিহাসিক সি মা গুয়াং সম্পর্কে
  2013-04-02 20:03:14  cri
সি মা গুয়াং ছিলেন চীনের উত্তর সং রাজবংশ আমলের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, চিন্তাবিদ এবং ঐতিহাসিক। তিনি 'সিসিডংজিয়েন' নামক একটি ইতিহাসের গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। এই গ্রন্থ চীনের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সি মা গুয়াং জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকে তিনি পরিবারের কড়াকড়ির মধ্যে শিক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করেন। প্রতিদিন তিনি অনেক সময় ধরে বই পড়তেন। গ্রামের অন্যান্য ছেলে-মেয়ের সঙ্গে খেলাধুলা করার সময় তিনি তাদেরকে বই-এর গল্প বলতেন। তাই সেসব ছেলে-মেয়ে তার সঙ্গে খেলাধুলা করতে পছন্দ করত। গ্রামের প্রবীণরাও সি মা গুয়াংকে খুব পছন্দ করতেন। সবাই তাকে 'ক্ষুদে পন্ডিত' বলে ডাকতেন। অল্প বয়সেই সি মা গুয়াং অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিলেন।

বসন্তকালের এক সকাল। সেদিন সাত বছর বয়স্ক সি মা গুয়াং গ্রামের অন্য পাঁচ-ছয় জন ছেলে-মেয়ের সঙ্গে বাইরে খেলাধুলা করছিলেন। ঠিক সেসময় একটি ছেলে একটি বড় পাত্রের উপর উঠে সে-পাত্রে রাখা মাছ দেখছিল। অসর্তকতার কারণে ছেলেটি সে-পাত্রের ভিতরে পড়ে গেল। পানিভর্তি পাত্রে পড়ে ছেলেটি চিত্কার করতে শুরু করল। যে-কোনো মুহূর্তে ছেলেটি পানিতে ডুবে মারা যাবে---এমন আশঙ্কা দেখা দিল। অন্য ছেলে-মেয়েরাও ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। কেবল সি মি গুয়াং ধীরস্থির থাকলেন এবং তাড়াতাড়ি মাটি থেকে একটি বড় পাথর তুললেন। তিনি এই পাথর পাত্রটির দিকে নিক্ষেপ করলেন। সাথে সাথে পাত্রটি ভেঙ্গে ভিতরের পানি বাইরে প্রবাহিত হল। ছোট ছেলেটির জীবন রক্ষা পেল। একজন বৃদ্ধ লোক এই দৃশ্য দেখে সি মা গুয়াংকে খুব প্রশংসা করলেন। তিনি বললেন: 'এ ছেলে খুব বুদ্ধিমান। ভবিষ্যতে সে একজন অসাধারণ ব্যক্তি হতে পারে।'

স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে একদিন সি মা গুয়াং একটি স্কুলের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন একজন শিক্ষক ছাত্রদেরকে কনফুসিয়াসের 'ছুয়েনছিও' বই পড়াচ্ছিলেন। সি মা গুয়াং জানালার পাশে দাঁড়িয়ে শিক্ষকের বর্ননা শুনতে লাগলেন। সে-দিন তিনি খুব দেরীতে বাসায় ফিরে গেলেন। তার বাবা সি মা গুয়াংকে জিজ্ঞেস করলেন: 'তুমি আজকে এত দেরীতে বাসায় ফিরেছ কেন? কী ব্যাপার?' সি মা গুয়াং উত্তর দিলেন: 'আমি স্কুলের শিক্ষকের কথা শুনেছি। তিনি কনফুসিয়াসের বই পড়াচ্ছিলেন। তার সুন্দর বর্ননায় আমি একেবারে ডুবে গেলাম। এই জন্য বাসায় ফিরতে দেরী হয়েছে।' তার কথা বিশ্বাস করতে বাবার কষ্ট হলো। কারণ, সি মা গুয়াংয়ের বয়স তখন মাত্র সাত বছর। এতো অল্প বয়সের ছেলে কীভাবে কনফুসিয়াসের লেখা বুঝতে পারবে? বাবার মনে প্রশ্ন জাগলো। বাবা সি মা গুয়াংকে জিজ্ঞেস করলেন: 'শিক্ষক কোন অধ্যায় পড়াচ্ছিলেন? আমাকে এ সম্পর্কে কিছু বর্ণনা দিতে পার?' সি মা গুয়াং শিক্ষকের কাছ থেকে যেসব শুনেছেন, তা হুবহু বলে দিলেন। শুনে তার বাবা অবাক হলেন। তার এই ছোট্ট ছেলেটি এতো বুদ্ধিমান হয়েছে ভেবে তিনি ভীষণ অবাক হলেন।

সি মা গুওয়াং কেবল বুদ্ধিমান ছিলেন, তা নয়; তিনি অত্যন্ত পরিশ্রমীও ছিলেন। স্কুলে পড়ার সময় অন্যান্য ছেলে সময় পেলে কেবল খেলাধুলা ও দুষ্টুমি করত। কিন্তু সি মা গুয়াং বসে বসে বই পড়তেন বা কোন কিছু মুখস্ত করতে চেষ্টা করতেন। এমনটি বৃদ্ধ বয়সেও তার এই মুখস্ত করার অভ্যেস ছিল। পথে হাঁটার সময় অথবা বিছানায় শুয়ে পড়ার সময় তিনি কবিতা বা নিবন্ধ আবৃত্তি করতেন। অবিরাম চেষ্টার ফলে তিনি একজন বড় মাপের ইতিহাসবিদ হয়েছিলেন।

তবে সি মা গুওয়াং একজন রক্ষণশীল ব্যক্তি ছিলেন। তিনি নতুন কিছু গ্রহণ করতে চাইতেন না। উত্তর সং রাজবংশ আমলের পরিস্থিতি তখন বিরূপ ছিল। দেশের বাইরে রাজবংশের শত্রুরা ছিল শক্তিশালী। দেশের আর্থিক অবস্থা তখন ভালো ছিল না। এ-পরিস্থিতিতে হওয়াং আন সি নামের একজন রাজনীতিবিদ সংস্কার চালানোর প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। সে-সময় সি মা গুয়াং রাজদরবারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি হওয়াং আন সির উত্থাপিত সংস্কার পরিকল্পনার বিরোধিতা করেন। তিনি হওয়াং আন সির সঙ্গে এ-ব্যাপার নিয়ে বেশ কয়েক বার তর্কবিতর্কও করেছিলেন। পরে হওয়াং আন সি ধারাবাহিক সংস্কারের পরিকল্পনা উত্থাপন করলেন। সি মা গুয়াং তার বিরোধিতার মনোভাবে অবিচল থাকলেন। কিন্তু তত্কালীন রাজা সন সেন জন সংস্কারের পক্ষপাতি ছিলেন। তিনি প্রকাশ্যে হয়াং আন সির উত্থাপিত সংস্কারের পরিকল্পনা সমর্থন করেন। তখন সি মা গুয়াং-র করার কিছু থাকলো না। নতুন আইন একটার পর একটা কার্যকর করা হলো। হওয়াং আন সির বিরুদ্ধে সি মা গুয়াংয়ে উঠেপড়ে লাগলেন; একটার পর একটা অভিযোগ করতে লাগলেন। একদিন তিনি হওয়াং আন সির কাছে একটি চিঠি পাঠালেন। চিঠিতে লেখা ছিল: 'আমি জানি বতর্মান রাজা তোমাকে পছন্দ করেন। যদি তুমি সংস্কার-কর্মসূচি বন্ধ কর, তাহলে জনসাধারণ এতে উপকৃত হয়; যদি তুমি অব্যাহতভাবে এই সংস্কার অনুসরণ কর, তাহলে জনসাধারণ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষা হবে কি হবে না, তা তোমার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। আমার প্রস্তাব হল, তুমি অবিলম্বে এই সংস্কার-পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বন্ধ কর।' কিন্তু হওয়া আন সি সি মা গুওয়াংএর কথা শুনলেন না। পরে সি মা গুয়াং পদত্যাগ করে লওইয়াং চলে গেলেন। পদত্যাগ করার পরও সি মি গুয়াংয়ের ধারণায় কোনো পরিবর্তন এলো না। তিনি সুযোগ পেলেই হওয়াং আন সির সংস্কার পরিকল্পনার সমালোচনা করেন। সি মা গুয়াংয়ের বিভিন্ন তত্পরতায় হওয়াং আন সির সংস্কার পরিকলন্পনা ক্ষতিগ্রস্ত হল। এটা ছিল সি মা গুয়াংয়ের জীবনের কলঙ্কজনক অধ্যায়।

বার্ধক্যে সি মা গুয়াং লইয়াংয়ে বসবাস করতেন। এসময় তার দু'টো প্রধান কাজ ছিল: ওয়াং আন সির সংস্কার পরিকল্পনার বিরোধিতা করা এবং ইতিহাসের বই 'সিসহিটংজিয়েন'-এর সম্পাদনার কাজ শেষ করা। প্রথম কাজটি ইতিহাসে ভালো কাজ হিসেবে স্বীকৃত হয়নি। তবে, দ্বিতীয় কাজটির জন্য তিনি চিরকাল চীনা মানুষের কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ থাকবেন।

তখন চীনের সং রাজবংশ সামন্ততান্ত্রিক সমাজের মধ্য সময়পর্ব অতিক্রম করছিল। এই সময়পর্বে একের পর এক সম্রাটের পতন ঘটে; ধ্বংস হতে থাকে একের পর এক শহর। পরে আবার সেসব শহর সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে; মহান চীনা জাতি শক্তিশালী হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে। ইতিহাসের একটার পর একটা রাজনৈতিক সংগ্রামে অনেক অভিজ্ঞতা ও অনেক ঘটনার অবতারণা ঘটেছিল। এমনি এক প্রেক্ষাপটে কয়েকটি রাজবংশের আমলকে বিবেচনায় নিয়ে একটি অভিন্ন ইতিহাসের বই রচনার প্রয়োজন ছিল। সি মা গুয়াং এই দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।

১০৬৫ সাল থেকে সি মা গুয়াং 'সিসিটংজিয়েন' সম্পাদনার কাজ শুরু করেন। এই কাজ শেষ হয় ১০৮৪ সালে। দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে তিনি এই বই সম্পাদনার কাজ করেন। এই বইতে এক হাজার তিন শো বছরের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করা হয়। হাজারেরও বেশী ঘটনার বর্ণনা আছে এই গ্রন্থে। এই বই সম্পন্ন করার জন্য সি মি গুয়াং অনেক পরিশ্রম করেছেন। যখন এই বই-এর কাজ সম্পন্ন হয় তখন সি মা গুয়াংয়ের বয়স ৬৫ বছর। এর ঠিক দু'বছর পর তিনি মারা যান।

সুপ্রিয় শ্রোতা, এতোক্ষণ চীনের ইতিহাসের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, চিন্তাবিদ ও ঐতিহাসিক সি মা গুয়াং সম্পর্কে শুনলেন। এখন আজকের ক্যুইজ প্রতিযোগিতার প্রশ্ন: 'সি মা গুয়াং চীনের কোন রাজবংশ আমলের লোক ছিলেন?' আপনাদের উত্তর আমাদের ইমেলে পাঠাবেন। বাংলা বিভাগের ইমেলের ঠিকানা হল: ben@cri.com.cn

(চিয়াং/আলিম)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক