স্যানি হেভি ইন্ডাস্ট্রি নামের একটি চীনা কোম্পানি সম্প্রতি মার্কিন সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে সারা বিশ্বের দৃষ্টি আর্কষণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের একটি আঞ্চলিক আদালত বারাক ওবামা সরকার এবং বৈদেশিক বিনিয়োগ কমিটির বিরুদ্ধে স্যানি হেভি ইন্ডাস্ট্রির সহযোগী প্রতিষ্ঠান রালস-এর করা এই মামলা গ্রহণ করেছে। দুই অধিবেশন শুরু হওয়ার আগে স্যানি হেভি ইন্ডাস্ট্রি পেইচিংয়ে এ সম্পর্কে এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেন।
বিদেশে চীনা কোম্পানি বিনিয়োগ এবারের দুই অধিবেশনের একটি অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল।
চীনের দ্বাদশ জাতীয় গণকংগ্রেসের অধিবেশনের প্রথম দিন বাণিজ্যমন্ত্রী ছেন তে মিং মার্কিন সরকারের বিরুদ্ধে স্যানি হেভি ইন্ডাস্ট্রির মামলা দায়ের সম্পর্কে বলেন, এ ব্যাপারের তদন্ত এখন শেষ হয়নি এবং চীন সরকার এ কোম্পানিকে সহায়তা ও সুরক্ষা দেবে। তিনি বলেন:
"এটা হচ্ছে একটি কোম্পনি এবং একটি বিদেশি সরকারের মধ্যকার ব্যাপার। চীন সরকার আইনের কাঠামোর মধ্যে থেকে ব্যাপারটির ওপর গুরুতর দেয় এবং তদন্ত করে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতি অনুযায়ী, চীনের কোম্পানির কোনো স্বার্থ বিঘ্নিত হলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সেটা রক্ষার অধিকার অর্জন করে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ন্যায় বাণিজ্য বিভাগ ও কোম্পানি ক্ষয়ক্ষতি বিভাগ কোম্পানির অনুরোধের প্রেক্ষিতে তাদেরকে সহায়তা দেবে। "
গত সেপ্টেম্বরে প্রেসিডেন্ট ওবামা স্বাক্ষরিত একটি আদেশনামায় বলা হয় যে, অরেগন রাজ্যে স্যানি হেভি ইন্ডাস্ট্রি ও রালস-এর একটি বায়ুচালিত বিদ্যুত্ উত্পাদন প্রকল্প যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়েছে এবং সে কারণে প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাজনৈতিক কারণে বিদেশে চীনের কোম্পানির স্বার্থহানির ঘটনা এটি প্রথম নয়। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে চীনের হুওয়াই ও জেডটিই করপোরেশনকে বহিষ্কার করে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বার বার চীনের ফোটোভোটাইক কোম্পানিকে ঝামেলার মধ্যে ফেলে। এ ধারাবাহিক ব্যাপার এটাই তুলে ধরে যে, যখন চীনের কোনো কোম্পানি বিদেশে বিনিয়োগ করে তখন 'ঝুঁকি মোকাবিলার' উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত্।
২০০৩ সালে টি সি এল কোম্পানি ৫৬ লাখ ডলার দিয়ে ফ্রান্সের থমসন কোম্পানির টিভি ব্যবসা অধিগ্রহণ করে। তবে বিদেশের আইন ও ব্যবস্থাপনা কাঠামোর সঙ্গে অপরিচিত হওয়ায় সে অধিগ্রহণ টি সি এল-এর জন্য গুরুতর ক্ষতি ডেকে আনে। ইউরোপ শাখা কোম্পানি দেউলিয়া হওয়ার কারণে বিশাল ক্ষতিপূরণ দাবির সম্মুখীন হয় টি সি এল। কয়েক বছর আগের এ অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে জাতীয় গণকংগ্রেসের প্রতিনিধি, টি সি এল প্রেসিডেন্ট লি তং সেং বলেন, ঝুঁকি সচেতনতার অভাব তাদের ব্যর্থতার প্রধান কারণ।
"আমরদের উচিত্ বিশ্ব বাণিজ্যের ধারা, বিভিন্ন দেশের আইন ও নীতি জেনে নিজেকে রক্ষা করা এবং গবেষণার মাধ্যমে আইনের ফাঁদ ও ঝুঁকি এড়ানো। "
গত কয়েক বছরে বিদেশে চীনা কোম্পানির বিনিয়োগ দ্রুত গতিতে বেড়েছে। বিশ্বজুড়ে আর্থিক সংকট দেখা দিলেও চীনা কোম্পানির বিনিয়োগ হ্রাস পায় নি। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চীনের অনার্থিক সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ২০০৭ সালের ২৪.৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০১২ সালে ৭৭.২ ডলারে পৌঁছেছে। বার্ষিক প্রবৃদ্ধির গড় হার ২৫.৫ শতাংশ। তবে বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধির সাথে সাথে ঝুঁকি ও বেড়েছে।
লি তং সেং মনে করেন, যদি কোনো কোম্পানি ঝুঁকি এড়াতে চায়, তাহলে তার কিছু শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। তিনি বলেন:
"প্রথমে কৌশল খুব প্রয়োজনীয়। দেশের বাইরে একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণ বা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের উদ্দেশ্য কী এবং এ কৌশল কোম্পানির দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য উপযোগী না কি - এ ব্যাপার আমাদের চিন্তা করা উচিত্। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে সম্পদ বিষয়ে যথেষ্ট প্রস্তুতি। কারণ দেশের বাইরে একীভূতকরণ ও অধিগ্রহণের প্রক্রিয়ায় সুযোগ, চ্যালেঞ্জ ও জটিলতা - সবই বেশি বলে প্রস্তুতি না থাকলে এ কাজ করা যায় না।"
চীনের মেই তি কোম্পানির ভাইস-প্রেসিডেন্ট ইউয়ান লি ছুন বলেন, সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের পর চীনের অর্থনীতির দ্রুত প্রবৃদ্ধি হয়েছে এবং বিদেশে চীনা কোম্পানির বিনিয়োগ ভাল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। অনেক কোম্পানি এ সুযোগ ধরে বিদেশে বিনিয়োগের মাধ্যমে পণ্য আবিস্কার করে, বিদেশের বাজার বাড়ায় এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্ষমতা জোরদার করে।
তিনি উল্লেখ করেন, দেশ বিদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল বলে ঝুঁকি বিষয়ে সচেতনতা দরকার। ইউয়ান লি ছুন বলেন:
"গত কয়েক বছর দেশ-বিদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি জটিল ও পরিবর্তনশীল রয়েছে। আর্থিক সংকট ও ইউরোপের ঋণ সংকটসহ নানা সমস্যা চলছে এবং অনেক সমস্যার এখনও সমাধান হয়নি। এতে কোম্পানিগুলোর জন্য উন্নয়নের সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ দুটিই আসছে।"
এবারের জাতীয় গণকংগ্রেসের অধিবেশনে ইউয়ান লি ছুন একটি প্রস্তাব দাখিল করেন। বিদেশে চীনা কোম্পানির বিনিয়োগকে আরও বেশি সমর্থন দেওয়ার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহবান জানান। তিনি আশা করেন, সরকার ও কোম্পানির একসঙ্গে মিলে বিদেশে চীনা কোম্পানির অর্থ বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধি সাধন করবে।
"আমরা আশা করি, সরকার নতুন উপায়ে কোম্পানিগুলোকে সমর্থন করবে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, কর, অর্থ ও দক্ষ ব্যক্তিসহ নানা বিষয়ে সরকার কোম্পানিকে সমর্থন দিতে পারে, যেটি হবে একটি খুব ভাল ব্যাপার।"
প্রিয় শ্রোতা বন্ধুরা এতক্ষণ আপনারা চীনা কোম্পানি বিদেশে বিনিয়োগ সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন শুনলেন।
প্রিয় শ্রোতা, এখন শুনবেন দুই অধিবেশন চলাকালে চীনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় -- শহরায়ন সম্পর্কিত একটি প্রতিবেদন।
ছয় মার্চ পেইচিংয়ে দ্বাদশ গণরাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনের সদস্যরা 'স্থিতিশীল ও ইতিবাচকভাবে চীনের শহরায়ন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং শহরায়নের মান উন্নত করা' শীর্ষক একটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন। বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা শহরায়ন সম্পর্কে নিজেদের ধারণা ব্যাখ্যা করেন। চীনের ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়নের ভাইস-প্রেসিডেন্ট সু হুই মনে করেন, চীনের শহরায়ন চারটি সমস্যা সম্মুখীন হচ্ছে। তিনি বলেন:
"প্রথমত, যখন শহরায়ন পরিকল্পনা তৈরি করা হয় তখন সে পরিকল্পনায় আঞ্চলিক শিল্পের উন্নয়ন-বিষয়ক কোনো উপাদান থাকে না। কীভাবে কৃষকদের আয় এবং অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানো যায়, সে বিষয়টি পরিকল্পনায় দেখা যায় না। দ্বিতীয়ত, কৃষকের নাগরিকে পরিণত হওয়া একটি সহজ কাজ নয়। বিশেষ করে শিক্ষা ও সামাজিক নিশ্চয়তা বিধান বিষয়ে অনেক সমস্যা রয়েছে। তৃতীয়ত, অবকাঠামো নির্মাণের জন্য গঠিত তহবিলের তত্ত্বাবধান জোরদার করা উচিত্ এবং পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর উচিত আত্মসংযম ও নিজের তত্ত্বাবধানও বাড়ানো। শেষ বিষয় হচ্ছে, পরিবেশ সংরক্ষণের ধারণা ও অবকাঠামোর অভাবে পরিবেশ দূষণ দিন দিন গুরুতর হচ্ছে।"
তাছাড়া, শহরায়ন প্রক্রিয়ায় ১৩০ কোটি চীনা মানুষের খাদ্যসংস্থান একটি বড় বিষয়। গত বছরের শেষ দিকে চীনের কৃষিমন্ত্রী হান ছাং ফু জানিয়েছিলেন, দেশের খাদ্যশস্যের উত্পাদনে ৯ বছর ধরে প্রবৃদ্ধি হলেও খাদ্যশস্যের যোগান ও চাহিদা এখন কেবল ভারসাম্য পর্যায়ে পৌঁছেছে। বিশেষ করে ধান, গম ও ভুট্টা টানা ২ বছর ধরে আমদানি করতে হয়। চীনের সমাজবিজ্ঞান অ্যাকাডেমি প্রকাশিত 'শহরায়ন পরিকল্পনা- ২০১২'-এ বলা হয়েছে যে, খাদ্যনিরাপত্তা শহরায়নের পূর্বশর্ত।
শহরায়নের সাথে সাথে খাদ্যশস্য উত্পাদন নিশ্চিত করা সম্পর্কে চিউ সান সোসাইটির ভাইস-প্রেসিডেন্ট লাই মিং চে বলেন, এ জন্য আবাদি জমির পরিমাণ ও মান নিশ্চিত করার পাশাপাশি ব্যাপকভিত্তিতে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করতে হবে। তিনি বলেন:
"খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আবাদি জমির পরিমাণ ও মান রক্ষা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আরেকটি হচ্ছে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি। বর্তমানে অনেক কৃষক জানেন না কীভাবে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হয়।"
২০০০ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত – এক দশকে চীনে শহরের আয়তন ৬০ শতাংশ বেড়েছে। তবে শহরের উন্নয়নের গতি ও মাত্রা বাড়ানোর সাথে অনেক সমস্যা হাজির হয়েছে। যেমন যানজট, আবহাওয়া দূষণ ও সম্পদ নিঃশেষ হওয়া। এ সমস্যা সমাধানের উপায় রয়েছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টাদশ জাতীয় গণকংগ্রেসের কার্যবিবরণীতে।
শহরায়নের গতি ও মান সম্পর্ক গণরাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনের সদস্য, চীনের সংস্কার ও উন্নয়ন গবেষণালয়ের পরিচালক ছি ফু লিন মনে করেন, শহরের আকারের চেয়ে জনসংখ্যার শহরায়ন আরও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন:
"চীনা শহরায়নের হার উচ্চ নয়। শিল্পায়ন হারের চেয়ে সেটা ৫ থেকে ১০ শতাংশ কম। লক্ষণীয় দ্বন্দ্ব হচ্ছে, শহরের আকার বাড়ার গতির চেয়ে জনসংখ্যার শহরায়ন ধীর। ভবিষ্যতে আমরা লোকসংখ্যার শহরায়নের ওপর গুরুত্ব দেব।"
চীনের জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশনের প্রধান ছাং পিং বলেন, তারা শহরায়ন সম্পর্কে গণরাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনের সদস্যদের পরামর্শ বিশ্লেষণের পর জবাব দেবেন।
উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ চীনের শহরায়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে এবং সম্ভবত চলতি বছরের প্রথমার্ধে এ পরিকল্পনা প্রকাশিত হবে। (শিশির)