Web bengali.cri.cn   
চীনের ইতিহাসের প্রথম নারী সম্রাট উ জে তিয়েন সম্পর্কে।
  2013-06-19 19:28:41  cri
উ জে তিয়েন চীনের ইতিহাসে অত্যন্ত বিখ্যাত। কারণ, তিনি ছিলেন চীনের ইতিহাসের একমাত্র নারী সম্রাট। তার শাসনামলে দেশ অত্যন্ত সমৃদ্ধ ছিল। তখন চীনের থাং রাজবংশ আমল। তার শাসনের সময় উ জে তিয়েন কৃষি উত্পাদনের দিকে অত্যন্ত মনোযোগ দেন। সে-সময় তিনি জনসাধারণের জন্য কিছুটা কল্যাণকর কাজ করেছিলেন। কিন্তু এর পাশাপাশি তিনি ছিলেন নিষ্ঠুর শাসক। তাই, তার শাসনামলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তিও কম ছিল না।

৬২০ খৃষ্টাব্দে তিনি চীনের বতর্মান সেনসি প্রদেশে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন কাঠের ব্যবসায়ী। পরে তার বাবা রাজদরজারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হন। পরে তিনি স্থানীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবেও নিয়োগ পান। যখন তার বয়স ৪৭ বছর, তখন তার স্ত্রী দ্বিতীয় মেয়ের জন্ম দেন। এই মেয়েই হলেন পরের থাং রাজবংশের রানী তথা নারী সম্রাট উ জে তিয়েন। যখন উ জে তিয়েনের বয়স ১৩, তখন তার বাবা মারা যান। উ জে তিয়েন অতি রূপসী যুবতীতে পরিণত হন। তার অপরূপ সৌন্দর্যের খবর অচিরেই স্থানীয় লোকজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে এ-খবর তত্কালীন রাজা লি সি মিনের কানে পৌঁছায়।

একদিন রাজা লি সি মিনের নির্দেশে রাজদরবারের একজন কর্মকর্তা উ জে তিয়েনের বাসায় এসে রাজার আদেশ পড়ে শোনান। রাজার সেই আদেশে উ জে তিয়েনকে রাজদরবারের 'কিউকনবাইন' তথা রাজার উপপত্নী হিসেবে নিয়োগ করা হয়। উ জে তিয়েনের মা রাজার এ-আদেশ শুনে অত্যন্ত অবাক হয়ে গেলেন। তিনি ভালোভাবে জানেন, রাজদরবারে রাজার উপপত্নীর অভাব নেই। তিনি মেয়েকে কাঁড়তে ধরে কান্নাকাটি শুরু করলেন। তিনি উ জেন তিয়েনকে বললেন: 'কে জানত, তোমার বাবা মারা যাওয়া কিছুকাল পরই পরিবারের ওপর সর্বনাশ নেমে আসবে। তুমি, রাজপ্রাসাদে প্রবেশের পর আর হয়তো আমাদের দেখা হবে না।" কিন্তু অল্প বয়সের উ জে তিয়েন ছিলেন অত্যন্ত শান্ত। তিনি হাসতে হাসতে মাকে বললেন: "মা, তুমি দু:খিত হয়ো না। আমিতো মনে করি এটা ভালোই হয়েছে।" রাজপ্রাসাদের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার আগে তিনি তার মাকে বললেন: 'রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করার পর, আমি সবসময় সতর্ক আচরণ করবো। রাজাকে খুশি করার জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাবো। আমি জানি, রাজা খুশি হলে সারাজীবন মযার্দা উপভোগ করতে পারবো। তা ছাড়া, আমি অবশ্যই তোমার এবং আমার পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করার চেষ্টা করবো।' তার কথা শুনে মা মনে মনে ভাবলেন, মেয়েটি আমার ছোটবেলা থেকেই খুব বুদ্ধিমান। আশা করা যায় যে, ভবিষ্যতে একদিন সে রাজার স্নেহের পাত্র হয়ে উঠবে।

রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করার দ্বিতীয় দিন রাজা তাকে ডেকে পাঠালেন। উ জে তিয়েনের সৌন্দর্য ও ব্যবহার দেখে রাজা তো মহাখুশি। রাজা উ জে তিয়েনকে কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। উ জে তিয়েন রাজার সমস্ত প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিলেন। রাজা খুব খুশি হয়ে উ জে তিয়েনের নাম দিলেন 'উমিয়ে'। উ জে তিয়েনের চেয়ে রাজা ২৬ বছর বড় ছিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে উ জে তিয়েনের সঙ্গ রাজা পছন্দ করা শুরু করলেন।

৬৪৩ খৃষ্টাব্দে রাজা লি সি মিন খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তিনি তার সবচেয়ে বড় ছেলে লি জিকে রাজকুমার হিসেবে সিংহাসনে বসিয়ে দিলেন। তখন উ জে তিয়েনের বয়স প্রায় বিশ বছর। রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করার পর তিনি অনেক বই পড়েছেন। আস্তে আস্তে তার সাহিত্য ও ইতিহাসের জ্ঞান সমৃদ্ধ হয়ে উঠল। লি জি মিন উ জে তিয়েনকে এত ভালবাসতেন যে খুব অসুস্থ হওয়ার সময়ও তিনি উ জে তিয়েনকে তার পাশে থাকতে বলেছিলেন। রাজকুমার লি জি প্রতি দিন বাবা লি সি মিনকে দেখতে আসেন। সুতরাং প্রতিদিন তিনি উ জে তিয়েনকে দেখতে পেতেন। উ জে তিয়েনের সৌন্দর্য রাজকুমার লি জিকেও অভিভূত করল। ৬৪৯ খৃষ্টাব্দে রাজা থাংথাইজং অসুস্থ হয়ে মারা যান। এরপর রাজকুমার লি জি রাজা হন। তত্কালের নিয়ম অনুযায়ী রাজার যেসব উপপত্নী কোন সন্তান জন্ম দেননি, তাদেরকে রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করতে হতো। উ জে তিয়েন কোন সন্তান জন্ম দেননি। রাজপ্রাসাদের নিয়ম অনুযায়ী তাকে একটি মন্দিরে সন্নাসিনী হিসেবে পাঠানো হয়।

রাজা থাংগাওজং রাজ সিংহাসনে আরোহণ করার পর তার মনে পড়ল উ জে তিয়েনের কথা। তিনি মন্দির থেকে উ জে তিয়েনকে ডেকে পাঠালেন। রাজপ্রাসাদে আবার ফিরে আসার প্রথম দিকে উ জে তিয়েন রাজার একজন সেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা শুরু করেন। তা ছাড়া, তিনি রানিকেও সেবা করতেন। রাজা ও রানি যে কথা বলেন তিনি তাই করতেন। তিনি রাজপ্রসাদের অন্যান্য সেবকদের প্রতিও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতেন। সুতরাং কিছুদিন পর রাজপ্রাসাদের সবার সঙ্গে উ জে তিয়েনের খাতির হয়ে গেল। তারা উ জে তিয়েনকে পছন্দ করতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে উ জে তিয়েনের মনে উচ্চাকাঙ্খা দেখা দিল; তিনি যড়যন্ত্র করা শুরু করলেন। তিনি মনে মনে রানিকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। রানির সেবকরা উ জে তিয়েনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেছে বলে রানির যে-কোন তত্পরতার কথা তারা উ জে তিয়েনকে বলে দিত। তারপর তিনি এ-সব তথ্য রাজাকে বলে দিতেন। ধীরে ধীরে রাজা রানিকে আরও বেশি অপছন্দ করা শুরু করলেন। পরে উ জে তিয়েন একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দিলেন। রাজা এ-কন্যাকে খুব পছন্দ করতেন। একদিন যখন উ জে তিয়েন অনুপস্থিত ছিলেন, তখন রানি এই মেয়েকে দেখতে এলেন। এ-খবর জেনে উ জেন তিয়েন নিষ্ঠুরভাবে নিজের কন্যাকে হত্যা করলেন। তারপর তিনি রাজার সামনে কাঁদতে কাঁদতে রানির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বললেন: 'আমাদের কন্যা আজ ভালই ছিল। কিন্তু আমি অনুপস্থিত থাকার সময় সে মারা গেছে। অবশ্যই কোন লোক তাকে হত্যা করেছে। দয়া করে এই হত্যাকারীকে ধরতে নিদের্শ দিন।' রাজা ক্ষুব্ধ হয়ে আশেপাশের সেবকদেরকে চিত্কার করে বললেন: 'যখন উ জে তিয়েন অনুপস্থিত ছিলেন, তখন কে এখানে এসেছিল?" সেবকরা সমস্বরে উত্তর দিল: 'মহারাজ, কেবল রানি একবার এখানে এসেছিলেন।" সে ছাড়া আর কে এখানে এসেছিল?' রাজা জিজ্ঞেস করলেন। ' না, আর কেই আসেনি' সেবকরা উত্তর দিল। রাজা তখন বললেন : 'রানি কি মেয়েকে হত্যা করেছেন?' ঠিক সেই সময় উ জে তিয়েন কাঁদতে শুরু করলেন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন : 'রানি ছাড়া আরও কেই আমাদের কন্যাকে হত্যা করেনি। তিনি আমাকে হিংসা করেন। মহারাজ, আপনাকে অবশ্যই ন্যায়সঙ্গতভাবে এই ঘটনা বিচার করতে হবে। আমি আমার প্রিয় কন্যা হারিয়েছি।' রাজা রেগে গেলেন। কিন্তু তিনি কোন প্রমাণ পাননি বলে রানিকে কেবল তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্ত নিলেন। তারপর রাজা উ জি তিয়েনকে রানি হিসেবে নিয়োগ দিলেন।

৬৮০ খৃষ্টাব্দে রাজা থাংগাওজং মারা যান। প্রশ্ন উঠলো: কে রাজা হবেন? তখন কেবল রানি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তিনি পর পর থাংগাওজংয়ের তিন ছেলেকে রাজা হিসেবে নিয়োগ করলেন। কিন্তু তিনি পর পর তাদেরকে বহিস্কারও করলেন। একসময় তিনি নিজে সিংহাসনে বসার স্বপ্ন দেখা শুরু করলেন। তিনি রাজপ্রাসাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে রদবদল করা শুরু করলেন। ৬৯০ খৃষ্টাব্দে উ জে তিয়েন সিংহাসনে বসলেন। তখন তার বয়স ৬৬ বছর। সিংহাসনে বসার পর তিনি ভিন্নমতাবলম্বীদেরকে ওপর নির্যাতন করা শুরু করেন। তবে, পাশাপাশি তিনি দক্ষ ব্যক্তিদেরকে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ করতেন। বস্তুত, চীনের ইতিহাসে উ জে তিয়েন ছিলেন একজন বির্তকিত নারী শাসক। (চিয়াং/আলিম)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক