Web bengali.cri.cn   
চীনের মিং রাজবংশের কৃষক বিদ্রোহের মহান নেতা লি জি ছেন সম্পর্কে।
  2013-02-05 18:41:00  cri
মিং রাজবংশ আমলের কৃষক বিদ্রোহ ছিল চীনের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ও সবচেয়ে বড় আকারের আন্দোলন। এ-আন্দোলনের ফলেই চীনে মিং রাজবংশের পতন ঘটে। লি জি ছেন ও ছাং শিয়েন জং ছিলেন সে-বিদ্রোহের দুই মহান নেতা।

মিং রাজবংশ আমলের শেষ দিকে, চীনের সেনসি প্রদেশের মিজি জেলার একটি গ্রামের এক কৃষক পরিবারে লি জি ছেন জন্মগ্রহণ করেন। যখন তার বয়স ১২ বছর, তখন তিনি গ্রামের এক জমিদারের হয়ে কাজ করা শুরু করেন। প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনি মাঠে জমিদারের গরু-ছাগল চড়ানোর কাজ করতেন। কিন্তু জমিদার তাকে ঠিকমতো খেতে দিত না; উল্টো, যখন-তখন ধরে পেটাতো। ২০ বছর বয়সে তিনি বাবাকে হারান। তখন গোটা পরিবারের দায়িত্ব তার কাধে এসে চাপে। এদিকে, বাবার শেষকৃত্যানুষ্ঠানের জন্য তাকে জমিদারের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিতে হয়। ঠিক সেসময়ই আকষ্মিকভাবে সেনসির উত্তরাঞ্চলে ভয়ঙ্কর খরা দেখা দেয়। খরা মানেই খাদ্যশস্যের উত্পাদন কমে যাওয়া। এ-ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। স্থানীয় জনসাধারণকে একটানা তিন বছর এই খরার কুফল ভোগ করে। সেসময়টায় তারা বন্য সবজি ও গাছের ছাল-বাকল-পাতা খেয়ে জীবনধারণ করতো। এ-অবস্থায় তার পক্ষে জমিদারের ঋণ পরিশোধ করা ছিল অসম্ভব ব্যাপার। তাই বেশ কয়েক বছর কঠোর পরিশ্রম করেও, লি জি ছেন চড়া সুদের ওই ঋণ পরিশোধ করতে পারলেন না। একদিন জমিদার নিজেই লি জি ছেনের বাসায় ঋণের টাকা আদায় করতে এলেন। লি জি ছেন জমিদারকে করজোরে বললেন: 'আমার পরিবারের সদস্যরা দু'বেলা দু'মুঠো খেতে পায় না। আমি কী করে আপনার টাকা পরিশোধ করবো? দয়া করে আমাকে আরো কিছুদিন সময় দিন।" কিন্তু জমিদার কঠোরভাবে বললেন: 'আমাকে টাকা দিতেই হবে। নইলে, আমি তোমার নামে কতৃর্পক্ষের কাছে নালিশ করবো। ওখানে আমার নিজের লোক আছে।' পরের দিন জমিদার তাকে জেলার গর্ভনরের কাছে নিয়ে গেল। সেখানে বেশ কয়েকজন লোক রাস্তায় লি জি ছেনকে হেনস্তা করল। অনেকেই সেই দৃশ্য চেয়ে চেয়ে দেখল। কেউ কেউ লি জি ছেনের সাহায্যে এগিয়ে আসতে চাইল। কিন্তু নির্যাতনকারীরা তাদের ভয় দেখিয়ে বলল: 'যদি তোমরা তাকে সাহায্য কর, তবে তোমাদেরও তার মতোই হাল হবে। এখন বল কার এতো সাহস যে লি জি ছেনের সাহায্যে এগিয়ে আসবে?" এ-কথা শুনে লি জি ছেনের প্রতি সহানুভূতিশীল একজন অন্যদের বলল: 'চল, আমরা একসঙ্গে এই হতভাগাকে নির্যাতনের কবল থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করি। সবাই মিলে চেষ্টা করলে তাকে বাঁচানো সম্ভব।" সবাই তখন একাট্টা হয়ে লি জি ছেনের পক্ষে দাঁড়ালো। নির্যাতনকারীরা তখন ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। ঠিক সেদিন থেকেই লি জি ছেনের মাথায় বিদ্রোহের বীজ রোপিত হয়ে গেল। তিনি কর্তৃপক্ষের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহের ডাক দিলেন।

খুব অল্প সময়ের মধ্যেই লি জি ছেনের বিদ্রোহের ধারণা স্থানীয় অধিবাসীদের সর্মথন পেল। কয়েক দিনের মধ্যে হাজার হাজার লোক তার দলে যোগ দিল। তখন দেশের অন্যান্য স্থানেও কয়েকটি বিদ্রোহী দল ছিল। সেসব দল সক্রিয় ছিল মূলত সেনসি ও হোনান এলাকায়। লি জি ছেন তার বিদ্রোহী দল নিয়ে সেনসি চরে যান। আস্তে আস্তে দেশের সর্বত্রই বিদ্রোহ দেখা দিল। স্থানীয় কর্তৃপক্ষগুলোর নাভিশ্বাস উঠে গেল। তারা বিদ্রোহ দমনে রাজদরবারের কাছে সাহায্য চাইতে লাগল। রাজার বাহিনীর আক্রমণে কৃষক বিদ্রোহীরা হোনান অঞ্চলে সরে যেতে বাধ্য হলো।

১৬৩৩ সালে রাজার বাহিনীকে মোকাবিলার উপায় নিয়ে আলোচনা করতে বিভিন্ন বিদ্রোহী দলের নেতারা লিইয়াংয়ে একত্রিত হন। লিইয়াং বতর্মান হোনান প্রদেশে অবস্থিত। বিদ্রোহী নেতাদের সে-সম্মেলনই ইতিহাসে 'লিইয়াং সম্মেলন' নামে বিখ্যাত' হয়ে আছে। বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর প্রায় শতাধিক নেতা সম্মেলনে যোগ দেন। তারা লড়াইয়ের কৌশল নিয়ে আলোচনা করেন। সম্মেলনে লি জি ছেন অনেক গঠনমূলক প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলেন। সবাই তার প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করেন। লি জি ছেনের প্রস্তাব অনুযায়ী, কৃষক বিদ্রোহীদের চার ভাগে ভাগ করা হয়। লি জি ছেন এক দলের দায়িত্ব নিলেন। পরে একটি বড় লড়াইয়ে বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর সম্মিলিত বাহিনীর প্রধান সেনাপতি মারা গেলে, লি জি ছেনকে প্রধান সেনাপতি নির্বাচন করা হয়। পরের কয়েকটি লড়াইয়ে লি জি ছেনের নেতৃত্বে বিদ্রোহী বাহিনী কয়েকটি লড়াইয়ে জয়ী হয়। ফলে বিদ্রোহী বাহিনীর মধ্যে লি জি ছেনের খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে যায়। তিনি বিদ্রোহীদের শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে উঠলেন। তা ছাড়া, তার নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী বাহিনী ছিল খুবই সুশৃংখল। তাই সাধারণ মানুষও তার নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী বাহিনীকে পছন্দ করা শুরু করলো। তখন থেকেই লি জি ছেনের নাম জনসাধারণের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। সারা দেশে লি জি ছেন সুপরিচিত একটি নাম হয়ে যায়।

১৬৪৪ সালের জানুয়ারি মাসে সিআনে লি জি ছেন 'ডাশিয়েগুও' নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করেন। তারপর এক লাখেরও বেশী বিদ্রোহীকে দুই ভাগে ভাগ করে তত্কালীণ মিং রাজবংশের রাজধানী পেইচিংয়ের উদ্দেশে পাঠানো হয়। রওয়ানা দেয়ার আগে লি জি ছেন বিদ্রোহী সৈন্যদের বললেন: 'তোমরা সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন করবে না। কোনো নিরীহ মানুষকে হত্যা করা, আমার আপনা পিতাকে হত্যা করার সামিল হবে। যদি কেউ কোনো নারীকে অপমান করে, তবে মনে করবো আমার আপন মা-কে অপমান করা হয়েছে। এ-ধরণের অপরাধ যে করবে, তাকে কঠিন শাস্তি দেয়া হবে।" লি জি ছেনের এই গণমুখী নীতির কারণে তার বাহিনী জনসাধারণের অকুন্ঠ সমর্থন পেতে থাকলো এবং তাদের সহায়তায় তার বাহিনী অল্প সময়ের মধ্যে থাইইয়ান, ডাঠংসহ পেইচিংয়ের আশেপাশের জায়গা দখল করে নিল। সেসব অঞ্চলে নিয়োজিত মিং রাজবংশের সেনাবাহিনী বিদ্রোহী বাহিনীর শৌর্য-বীর্য দেখে বিনা লড়াইয়ে আত্মসমর্পন করতে লাগলো। একসময় বিদ্রোহী বাহিনী পেইচিং নগরে প্রবেশ করলো। খবর শুনে মিং রাজবংশের রাজা ছংজেন হতভম্ব হয়ে গেলেন। ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনার জন্য রাজা রাজদরবারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরকে ডেকে পাঠালেন। কিন্তু কর্মকর্তারা কেউ এলেন না। রাজা বুঝে গেলেন, তার পতন আসন্ন। তিনি গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলেন। রাজার মৃত্যুর একদিন পর বিদ্রোহীরা পেইচিং নগরে প্রবেশ করে। সাধারণ মানুষ রাস্তার দুই পার্শ্বে দাঁড়িয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানায়।

কিন্তু কিছুকালের মধ্যেই বিদ্রোহী বাহিনীর মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দিল। আস্তে আস্তে এই দ্বন্দ্ব তীব্রতর হয়ে উঠল। অবশেষে ছিং বাহিনী অভ্যন্তরীণ কোন্দলে দুর্বল হয়ে যাওয়া কৃষক বিদ্রোহী বাহিনীকে পরাজিত করে ছিং রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করলো। ফলে, লি জি ছেনের নেতৃত্বে কৃষক বিদ্রোহ বলতে গেলে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে গেল। সুপ্রিয় শ্রোতা, এতোক্ষণ শুনলেন মিং রাজবংশের শেষ দিকের বিখ্যাত কৃষক বিদ্রোহের নেতা লি জি ছেন সম্পর্কে। আপনাদেরকে অশেষ ধন্যবাদ। (চিয়াং/আলিম)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক