চীনে হুই জাতির অধিকাংশ সদস্য উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করে। তবে চীনের সর্বদক্ষিণের হাই নান প্রদেশের সান ইয়া শহরে রয়েছে ৯ হাজার হুই জাতির মুসলমান। তারা সান ইয়া শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে হুই হুই ও হুই সিন নামের দু'টি গ্রামে বাস করে।
লিউ সিও হুয়া একজন ৩৬ বছর বয়সী মহিলা এবং দুই সন্তানের জননী। সন্তানদের দেখাশোনা করার পাশাপাশি তিনি একটি গার্মেন্টস কারখানা পরিচালনা করেন। সম্প্রতি তিনি মালয়েশিয়া থেকে কিছু উন্নতমানের কাপড় আমদানি করে নিজের কারখানায় পোশাক তৈরি করেন।
লিউ সিও হুয়া একজন পরিশ্রমী গৃহিণী এবং ধর্মাচার পালনে আন্তরিক। অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও প্রতি জুমার দিন তিনি জামায়াতে নামাজ আদায় করেন এবং তারপর কোরান পড়া শিখতে আরবি স্কুলে যান। হজ পালনে মক্কা যাওয়ার জন্য স্থানীয় ইসলামি কমিটিতে তালিকাভুক্তও হয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, দশ-বারো বছর আগেও তিনি কখনও ভাবেন নি যে, তিনি এত আনন্দময় জীবনযাপন করতে পারবেন। তিনি বলেন:
"আগে মহিলারা কোথায়ও বেড়াতে যেত না এবং জানতো না বাইরের বিশ্ব কত সুন্দর। এখন আমাদের টাকা আছে এবং অনেক জায়গা যেমন হংকং, মালয়েশিয়া, ওয়েন চৌ এমন কি বিশ্বের যে কোনো জায়গায় বেড়াতে যাতে পারি।"
স্বামী বাইরে কাজ করবে এবং স্ত্রী সাংসারিক কাজ করবে – এটা চীনের একটি ঐতিহ্যগত ধারণা। কিন্তু সান ইয়া শহরের হুই জাতির মহিলাদের একটি বৈশিষ্ট ব্যবসা করা। তারা ইসলামি আইন ও রীতিনীতি পালন করার পাশাপাশি মনের দিগন্ত প্রসারিত করে। তারা রাস্তার পাশে সুপারি বিক্রি করে, সমুদ্রসৈকত দোকান খুলে মুক্তা বিক্রি করে কিংবা মুসলিম রেস্তোরাঁ চালায়। সান ইয়া শহরে সব সময় হুই জাতির মহিলাদের ব্যবসা করতে দেখা যায়। সেখানকার ইসলামি কমিটির প্রধান হা সাও লিন বলেন:
"ভালভাবে গৃহস্থালির কাজ করার পাশাপাশি এখানকার হুই জাতির মহিলারা নামাজ আদায় করে এবং ধর্মগ্রন্থ পড়ে। তারা বাইরের কাজও করে। এটা আমাদের একটি বৈশিষ্ট্য।"
হা সাও লিন বলেন, ৮শ' বছর আগে হুই জাতি সান ইয়া শহরে বসবাস শুরু করে। ওই সময় পুরুষেরা মাছ ধরতো এবং মহিলারা সেগুলো বিক্রি করতো এবং তখন থেকে সান ইয়ায় মহিলারা ব্যবসা শুরু করে। গত আশির দশকের পর সান ইয়া চীনের একটি বিখ্যাত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় উপকূলীয় পর্যটন শহরে পরিণত হয় এবং হুই জাতির সব পরিবার পর্যটন-সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ে নিযুক্ত হয়। তারা মুক্তা, স্ফটিক, খোলাসহ হস্তশিল্পজাত দ্রব্য, হাই নান প্রদেশের বৈশিষ্টপূর্ণ দ্রব্য ও পোশাক তৈরি ও বিক্রি করে। সান ইয়া শহরে তারা দশ-বারোটি বিশাল আকারের রেস্তোরাঁ ও ২৮টি পারিবারিক হোটেল চালায়। তারা সান ইয়া শহরে সবচেয়ে ধনী একটি গ্রুপ। উল্লেখ্য, এ ব্যবসার ব্যবস্থাপকদের অধিকাংশ মহিলা।
ছাব্বিশ বছর বয়সী হুই জাতির মহিলা উ শুয়্যে মেই আমাদের সাংবাদদাতাকে বলেন, তার এক বছর বয়সী দ্বিতীয় সন্তানের যত্ন নেওয়ার জন্য তিনি ব্যবসা বন্ধ করেছেন। তবে প্রতিদিন রাত ৮টার পর তিনি গ্রামের অন্য মহিলাদের সঙ্গে কম্পিউটার, পর্যটন, আইন ও হস্তশিল্পজাত দ্রব্য তৈরি বিষয়ক ক্লাসে যোগ দিতে নৈশ বিদ্যালয়ে যান। তিনি মনে করেন, সন্তান বড় হলে তিনি আবার ব্যবসায়ে ফিরে আসবেন। তিনি বলেন:
"আধুনিক সমাজে তুমি যদি বাইরে কাজ করতে চাও, তাহলে জ্ঞান খুব প্রয়োজনীয় এবং এ কারণে সবাই লেখাপড়া করতে ইচ্ছুক।"
আটচল্লিশ বছর বয়সী কাও ইয়্যু হে একজন আখন্দ। বিশ বছর আগে তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে দর্শনীয় স্থানে বাস চালাতেন। স্থানীয় পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে তার পরিবারের জীবনযাপনের মানও বেশ উন্নত হয়েছে। বর্তমানে তারা নিজেদের পর্যটন পরিবহন কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার স্ত্রীর উদ্যোগে তারা দর্শনীয় স্থানে তিনটি ফলের দোকান খুলেছেন এবং তার ছেলের স্ত্রী এখন এসব দোকানে কাজ করেন। কাও ইয়্যু হে মনে করেন, হুই জাতির নারীদের জনসম্মুখে না আসার যে ঐতিহ্য ছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসা এবং ব্যবসায়ে আত্মনিয়োগ করা পরিবর্তিত সমাজের ও উন্নত জীবনযাত্রার চাহিদার সঙ্গে মানানসই। তিনি বলেন:
"এখানে হুই জাতির মহিলারা কষ্টসহিষ্ণু ও পরিশ্রমী। যদি তারা বাইরে কাজ করতে না পারে, তাহলে কীভাবে জীবনযাপন করবে? মহিলাদের কাজে প্রবেশ করা পরিবারের জন্য একটি ভাল বিষয়।"
মহিলাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিবারের আয় প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হয় এবং পরিবারে ও সমাজে তাদের মর্যাদা বাড়ে। এর মধ্য দিয়ে সফল মহিলা শিল্পপতি তৈরি হয়। হা ই্যুয় মেই এমন শিল্পপতিদের একজন। তিনি যে স্ফটিক অলংকার কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার সম্পত্তির মূল্য ২০ কোটি ইউয়ানেরও বেশি। কোম্পানির সদরদপ্তর সান ইয়া শহরে। তাঁর কোম্পানির অধীনস্থ একটি প্রদর্শনী ও বিক্রয়কেন্দ্র হে নান প্রদেশের বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান 'থিয়ান ইয়া হে চিয়াও' যাওয়ার পথের পাশে অবস্থিত। শীতকাল সান ইয়া ভ্রমণের ব্যস্ত ঋতু। এলাকাটি সফরকালে আমাদের সাংবাদদাতা দেখতে পান কেন্দ্রের ভেতরে বাইরে আসা যাওয়া করছে বাস। কয়েক হাজার বর্গমিটারের এ প্রদর্শনী ভবনে নানা রকমের স্ফটিক কণ্ঠহার ও চশমাসহ নানা বস্তু পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সান ইয়া ছাড়া কুয়াং চৌতেও হা ই্যুয় মেইর আরেকটি কারখানা আছে। নিজের সাফল্য নিয়ে হা ই্যুয় মেই বলেন:
'সত্যবাদিতা ও প্রতিপত্তি মানুষের জন্য দু'টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট। এ দু'টি ছাড়া ব্যবসার ভবিষ্যত নেই। আরেকটি বিষয় হলো মনোভাব। যতো ভাল মনোভাব ততো ভাল ব্যবসা। হে নান দ্বীপ একটি আন্তর্জাতিক পর্যটন দ্বীপ এবং এর উন্নয়ন থেকে আমরাও উপকৃত হই। আমি বিশ্বাস করি, আরো বেশি মানুষ সান ইয়া পছন্দ করবে এবং আমাদের ব্যবসায়ে অগ্রগতি হবে।"
বর্তমানে সান ইয়া হুই জাতির মহিলারা পুরুষের চেয়ে কোনো বিচারে খাটো নয়। হাই নান প্রদেশকে আন্তর্জাতিক পর্যটন দ্বীপ হিসেবে গড়ে তোলার পাশাপাশি হুই জাতির মহিলারা ভবিষ্যতের ব্যাপারে আরো সুন্দর প্রত্যাশা রাখে।