Web bengali.cri.cn   
চীনের প্রচীনকালের বিখ্যাত সমরবিদ সেনউ সম্পর্কে।
  2013-01-08 20:04:24  cri
সেনউর জন্ম চীনের বসন্ত ও শরত যুগের শেষ সময়পর্বে। তিনি ছিলেন অভিজাত পরিবারের ছেলে। ছোটবেলা থেকেই তিনি নানা ধরণের বই পড়া শুরু করেছিলেন। তার বাবা ছিলেন সে সময়ের একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা। পরিবারের প্রভাবে সামরিক ব্যাপারে তার আগ্রহ বেশী ছিল। পরে তিনি উ রাজ্যের একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার পদে নিয়োগ পান। তার নেতৃত্বে উ রাজ্যের সেনাবাহিনী তত্কালের শক্তিশালী ছু রাজ্যকে পরাজিত করে। তখন থেকেই সেন উ বিখ্যাত হয়ে গেলেন। সারাজীবনে তিনি সামরিক তত্ত্ব নিয়ে ১৩টি বই লিখেছেন। তার গ্রন্থ 'সেজি বিনফা' নামে পরিচিত। তার বইগুলোতে চীনের প্রাচীনকালের যুদ্ধে অর্জিত অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করা হয়েছে। তার বইগুলোতে অনেক মূল্যবান সামরিক তত্ত্ব ও কৌশল ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তার বই বিশ্বের ওপরও বিরাট প্রভাব ফেলেছে। পরবর্তীকালের সমরবিদদের মধ্যে এমন একজনকেও পাওয়া যাবে না, যিনি তাকে বা তার রচনার সাথে পরিচিত নন।

ইতিহাসে সেনউ সম্পর্কে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। তখন ছু রাজ্য ছিল অনেক শক্তিশালী। অন্যদিকে, উ রাজ্য ছিল দুর্বল। সে-সুযোগে ছু রাজ্য মাঝে মাঝে উ রাজ্যকে অপমান করত। উ রাজ্যের রাজা উ রাজ্যকে চাঙ্গা করে তুলতে চাইলেন। উ জি শিউ নামে একজন লোক সেন উর বন্ধু ছিলেন। তিনি রাজপ্রাসাদের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। একদিন তিনি সেনউর লেখা বই উ রাজ্যের রাজাকে দিলেন। তিনি রাজার সামনে সেনউ-এর প্রশংসা করলেন। রাজা সেনউর লেখা বই পড়ে মহাখুশী। তিনি সঙ্গে সঙ্গে সেনউকে ডেকে পাঠালেন। রাজা বিনয়ের সাথে সেনউকে বললেন: 'আমি তোমার বই পড়েছি। অত্যন্ত ভাল বই। কিন্তু আমি নিশ্চিত নই যে, তুমি আমার সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিতে পার কি না।" জবাবে সেনউ বললেন, 'অবশ্যই আমি পারবো।'

সেনউর আত্মবিশ্বাস দেখে উ রাজ্যের রাজার মনে একটি অদ্ভুদ ধারণা জেগে উঠল। তিনি বললেন: 'তাহলে তোমাকে একদল নারী সৈন্যকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। পারবে কি।" 'অবশ্যই পারবো' সেনউ দৃঢ়ভাবে জবাব দিল। রাজা বললেন: 'ঠিক আছে, আগামিকাল সকালে তুমি প্রাসাদের নারী সেবকদেরকে প্রশিক্ষণ দেবে।' রাজার কথা শুনে সেনউ বললেন: 'মহারাজকে সন্তুষ্ট করার জন্য আমি চেষ্টা করবো।' তিনি আরো বললেন, 'কিন্তু সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া কোনো ছেলেখেলা নয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল নির্দেশ মেনে চলা। আমি কিন্তু সামরিক শৃংখলা অনুযায়ী নারী সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেবো।'

'অবশ্যই। তুমি যা বলবে তারা তাই করবে,' রাজা জবাব দিলেন।

পরের দিন সকালে, প্রাসাদের ১৮০ জন নারীসেবককে প্রাসাদের সামনে জড়ো করার নির্দেশ দিলেন রাজা। সবাই হাসিমুখে প্রাসাদের সামনে এসে হাজির হলো। সেনউ রাজার দু'জন প্রিয় নারীসেবককে দলনেতা নিয়োগ করলেন। তিনি এসব নারীসেবকের সামনে প্রশিক্ষণের নিয়ম বর্ণনা করলেন। তারপর তিনি সেনাবাহিনীর শৃংখলা ঘোষণা করলেন। অবশেষে তিনি জিজ্ঞেস করলেন: 'সবাই স্পষ্টভাবে আমার কথা শুনেছ?' 'ষ্পষ্টভাবে শুনেছি' সবাই জবাব দিল।

তারপর, সেনউ প্রশিক্ষনের নির্দেশ দিলেন। তার অসম্ভব কঠিন নির্দেশ শুনে তারা সবাই হেসে উঠলো। তাদের ধারণা ছিল, এটা একটি খেলা মাত্র। আসলে তারা সেনউর কথা ভালোভাবে শোনেননি। বিশেষ করে রাজার দু'জন প্রিয় নারীসেবকের হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরার অবস্থা হলো। নারীসেবকদের প্রতিক্রিয়া দেখে সেনউ ভাবলেন, মনে হয় তিনি তাদের সামনে ষ্পষ্টভাবে বলেননি। সুতরাং তিনি আবার সংশ্লিষ্ট শৃংখলা ও নিয়ম বণর্না করতে শুরু করলেন। কিন্তু এবার তারা আরও বেশি করে হাসতে শুরু করল। এ-দৃশ্য দেখে সেনউ রেগে গেলেন। তিনি উচ্চস্বরে বললেন: 'আমি দু'বার শৃংখলা ও সংশ্লিষ্ট নিয়ম ষ্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছি। যদি তোমরা এ-শৃংখলা ও নিয়ম মেনে না-চল, তাহলে ইচ্ছাকৃতভাবে এই সামরিক শৃংখলা ভঙ্গ করেছো বলে ধরে নেয়া হবে। তোমাদের মধ্যে সবার জন্যই এই নিয়ম প্রযোজ্য।' কথা শেষে তিনি তার দু'জন রক্ষীকে নির্দেশ দিলেন, দু'জন নারীনেতাকে মেরে ফেলতে। ঠিক সেই সময় রাজা একজন লোককে পাঠালেন সেনউর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য। এই লোক বললেন: 'আপনার যোগ্যতা আমরা সবাই দেখেছি। কিন্তু এই দু'জন সুন্দরীকে ক্ষমা করে দিন।' ' না! যে কোন লোক সামরিক শৃংখলা মেনে না-চললে সামরিক আইন অনুযায়ী তাকে শাস্তি দেয়া হয়', সেনউ দৃঢ়ভাবে বললেন। অবশেষে সেই দুই নারীনেতৃকে হত্যা করা হলো। তারপর তিনি অন্য দু'জন নারীকে দলের নেতা হিসেবে নিয়োগ করলেন। তখন সবাই মন দিয়ে সেনউয়ের কাছে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করলো। প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর, সেনউ রাজাকে বললেন: "মহারাজ, আমাদের প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে। আপনার নির্দেশে এখন তারা যুদ্ধে যোগ দিতে পারে।'

দু'জন প্রিয় নারীসেবক হারিয়ে উ রাজ্যের রাজার মন খুব খারাপ ছিল; তবে তিনি সেনউর দক্ষতার প্রশংসা করলেন। তিনি সেনউকে একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করলেন। তখন থেকে সেনউ তার দক্ষতাকে ভালভাবে কাজে লাগাতে শুরু করলেন। অল্প সময়ের মধ্যে তিনি একটি শক্তিশালী বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুললেন। একদিন একজন সামরিক কর্মকর্তা সেনউকে জিজ্ঞেস করলেন: 'আমরা কবে ছু রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করবো?' সেনউ উত্তর দিলেন: 'উ রাষ্ট্রের চাইতে ছু রাষ্ট্রের সেনাসদস্যের সংখ্যা অনেক বেশী। সুতরাং ছু রাষ্ট্রকে পরাজিত করতে চাইলে আমাদের এর আগে অনেক প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। নইলে আমরা বিজয়ী হতে পারবো না।'

পরে সেনউ একটি রণকৌশল তৈরী করলেন। তিনি তার সেনাবাহিনীকে তিন ভাগে ভাগ করলেন। এ তিনটি সেনাদল পালাক্রমে ছু রাষ্ট্রের সীমান্তে হামলা চালানোর ভঙ্গি করতে লাগলো। ছু রাষ্ট্রের সৈন্য লড়াই করতে এলেই উ রাষ্ট্রের সৈন্যরা সরে পড়তো। একটানা পাঁচ-ছয় বছর ছু রাষ্ট্রের সীমান্তে এ-ধরনের ইঁদুর-বেড়াল খেলা চলল। সবসময় ছু রাষ্ট্রের সৈন্যরা চিন্তিতভাবে সময় কাটায়। অবশেষে একসময় তারা নিস্তেজ হয়ে পড়ল। তাদের বিশ্রাম নেয়ার সুযোগ ছিল না। আস্তে আস্তে এ-সব সৈন্য বিষন্ন হয়ে পড়ল। তারা উ রাষ্ট্রের সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই-এর আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। তখন একজন সামরিক কর্মকর্তা সেনউকে বললেন: 'জেনারেল সেনউ, এখন ছু রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ করার সময় হয়ে গেছে। কেন আমরা এখন আক্রমণ শুরু করছি না?' কিন্তু সেনউ ধীরে ধীরে উত্তর দিলেন: 'না, এখন সময় আক্রমণের উপযোগী হয়নি। মনে রাখতে হবে, যুদ্ধ করলে জয় করতে হবে। সুতরাং এখন আমরা উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষা করছি। যখন ছু রাস্ট্রে অভ্যন্তরীণ দাঙ্গা-হাঙ্গামা শুরু হবে আমরা তখন ছু রাষ্ট্রের ওপর আক্রমণ করবো।'

শেষ পর্যন্ত সুযোগ সত্যিই আসল। সে বছর ছু রাষ্ট্রের রাজা ছুপিন মারা যান। তার ছেলে ছুচাও ছিলেন রাজা হবার অযোগ্য। তিনি সারাদিন বিলাস জীবনযাপনে সময় কাটান। আস্তে আস্তে তার চারপাশের কর্মকর্তারা তাকে অপছন্দ করতে শুরু করেন। তা ছাড়া, ছু রাষ্ট্রের আওতাধীন কয়েকটি ছোট ছোট দেশের জনগণ ছু রাষ্ট্র থেকে আলাদা হয়ে যাবার ফন্দি-ফিকিরও শুরু করলো। স্বাভাবিকভাবেই ছু রাষ্ট্রের অনেক জায়গায় বিদ্রোহ দেখা দিল। এ খবর পেয়ে সেনউ খুব আনন্দিত হলেন। তিনি উ রাষ্ট্রের রাজাকে বললেন: 'ছু রাষ্ট্র খুব শক্তিশালি বলে আমি তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিইনি। কিন্তু এখন তার আওতাধীন ছোট দেশগুলো স্বাধীন হতে চায় এবং ছু রাষ্ট্রে ঐক্য নেই। যেখানে সেখানে বিদ্রোহ দেখা দিচ্ছে। আমার মনে হয় এখন ছু রাষ্ট্রের ওপর আক্রমণের সময় হয়েছে।' রাজা সেনউয়ের প্রস্তাবে রাজি হলেন। সেনউর নেতৃত্বে উ রাষ্ট্রের সৈন্যবাহিনী মাত্র দু'মাসের মধ্যে ছু রাস্ট্রকে পরাজিত করল।

সেনউ-এর লেখা বই 'সেনজিবিফা' অর্থাত 'সেনউ-এর সামরিক কৌশল' পরে সামরিক কর্মকর্তাদের পাঠ্যবইয়ে পরিণত হয়। এই বইতে উদ্ধৃত একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে: 'পরষ্পরকে ভালভাবে উপলব্ধি করলে শত বার যুদ্ধ হলে শত বার বিজয় হতে পারে।' বই বহু আগেই ইংরেজি, ফ্রান্স, জার্মান, জাপানি , চেক ও রুশ ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বতর্মানে বিশ্বের অনেক লোক এই বই নিয়ে গবেষণা করছেন। প্রিয় শ্রোতা, এতোক্ষণ চীনের প্রাচীনকালের বিখ্যাত সমরবিদ সেনউ সম্পর্কে সংক্ষেপে আপনারদের জানালাম। শোনার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। (চিয়াং/আলিম)

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক