Web bengali.cri.cn   
চীনা সংস্কৃতির মোহিনীশক্তি
  2012-12-24 19:23:06  cri

গত দশক ছিল চীনা সংস্কৃতি বিকাশের সোনালী যুগ। রসাত্মক সংলাপ, পেইচিং অপেরা, উত্তর পূর্ব চীনে প্রচলিত দুজন শিল্পীর গীতিনৃত্য, সান সি প্রদেশের অপেরা, দড়াবাজি ও কুংফুর মতো চীনের ঐতিহ্যবাহী শ্রেষ্ঠ শিল্প ক্রমে ক্রমে অবহেলার কবল থেকে মুক্তি পেয়ে যার যার প্রাণশক্তির পরিচয় দেয়। অধিক থেকে অধিকতর সংখ্যক মানুষ প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সংগীতানুষ্ঠান ও রসাত্মক সংলাপ উপভোগ করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন হাজার হাজার মাইল দূর থেকে আগত বিদেশিরাও। এর পাশাপাশি চীনা সংস্কৃতি দ্রুত ও দৃঢ় পদক্ষেপে বিদেশ গিয়ে নিজের স্বতন্ত্র শৈল্পিক মাধুর্যে বিশ্বকে বিমোহিত করছে।

আপনারা এখন শুনছেন দুজন বিদেশির রসাত্মক সংলাপের রেকর্ডিং। তাঁদের মধ্যে একজন ফরাসি, তাঁর নাম জুলিয়ান। ১.৮৭ মিটার উচ্চতাবিশিষ্ট জুলিয়ান একজন সুদর্শন ইউরোপীয় পুরুষ: নাক তাঁর উন্নত, চোখ কোঠরাগত, চুল হলুদাভ ও সামান্য কোঁকড়া। কিন্তু পেইচিং ভাষায় তাঁর কথা শুনে মনে হয় না যে, তিনি একজন বিদেশি। দশ বছর চীনে বসবাসকারী জুলিয়ান সংবাদদাতাকে জানান, চীনা সংস্কৃতির প্রতি গভীর কৌতুহলই তাঁর চীনে আসার প্রধান কারণ।

"আমি চীনের ইতিহাসকে পছন্দ করি। চীনের ইতিহাসের বই পড়ার জন্য আমি চীনা ভাষা শিখেছি। পরে চীনা সংস্কৃতির অন্যান্য অংশও আমাকে আকর্ষণ করে। আমি রসাত্মক সংলাপের ক্যাসেট কিনেছি। প্রথম ক্যাসেটে আছে মাস্টার লিউ পাও রুইর সমস্ত রসাত্মক কথা। পরে আমি মাস্টার হো পাও লিন ও মাস্টার মা সানের রসাত্মক সংলাপের ক্যাসেটও কিনেছি। প্যারিসের রাস্তায় হাঁটার সময় এবং পাতাল রেলে আমি তাঁদের রেকর্ডিং শুনি। ২০০২ সালে আমি চীনে আসি। তারপর চীন ছেড়ে আর কোথাও যাই নি।"

চীনে এসে জুলিয়ান প্রথমে ইংরেজি প্রশিক্ষণ কোর্সে শিক্ষকতা করেন এবং একটি পত্রিকায় কাজ করেন। বর্তমানে তিনি একজন উপস্থাপক। তাঁর চাকরি মাঝেমাঝে পরিবর্তিত হলেও রসাত্মক সংলাপের প্রতি তাঁর আগ্রহ কখনও হ্রাস পায় নি। ৬ বছর আগে তিনি বিখ্যাত রসাত্মক সংলাপ শিল্পী তিং কুয়াং ছুয়ানের শিষ্য হন। দুটো আলাদা সংস্কৃতির কারণে তাঁকে সুযোগ্য শিষ্য বলে প্রথমে তিং কুয়াং ছুয়ান মনে করেন নি। তিং কুয়াং ছুয়ান বলেন,

"প্রথমে তাঁকে আমার ভালো লাগে নি। কেন না কোনো এক প্রসংগ তুলতেই তিনি অনর্গল বলতে থাকতেন এবং চীনা ভাষার ওপর তাঁর দখল জাহির করতেন। মনে মনে ভাবতাম, তিনি কখনো আমার ছাত্র হতে পারবেন না। পরে তিনি পেইচিংয়ে চাকরি পেয়ে আবার আমার কাছে আসেন। আমি তাঁকে আমার ক্লাস শুনতে বলি। কালক্রমে আমি আবিষ্কার করি যে, এ সরলপ্রাণ বিদেশি যুবক বই পড়তে পছন্দ করেন এবং প্রচুর জ্ঞান তাঁর আয়ত্ত। লেখাপড়া, বই পড়া ও রসাত্মক সংলাপের মাধ্যমে চীনের সংস্কৃতি, রীতিনীতি এবং আচার ব্যবহার সম্বন্ধে অনেক কিছু জানেন তিনি। চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি সম্বন্ধেও তার উপলব্ধি অপেক্ষাকৃত গভীর। এখন তিনি আমার অন্যতম প্রতিষ্ঠিত বিদেশি শিষ্য।"

দেখতে দেখতে ৬ বছর কেটে গেছে। জুলিয়ান এখন তিং কুয়াং ছুয়ানের অন্যতম কৃতি বিদেশি শিষ্য। তিনি মাস্টার মা চি ও চিয়াং কুন প্রমুখ খ্যাতনামা শিল্পীদের সঙ্গে মঞ্চে অনুষ্ঠান পরিবেশনে অংশ নেন। জুলিয়ান বলেন, রসাত্মক সংলাপ শিখার মধ্য দিয়ে তাঁর পক্ষে চীনা ভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলা ক্রমশই সম্ভব হয়েছে। তা ছাড়া এর মাধ্যমে চীনের সংস্কৃতির মাধুর্যের স্বাদও পেয়েছেন তিনি। জুলিয়ান বলেন,

"শুধু রসাত্মক সংলাপ নয়, মাস্টার তিং কুয়াং ছুয়ানের ব্যবহার থেকেও আমি যা শিখেছি, তা বইপত্র থেকে পাওয়া যায় না।। আমি মনে করি, চীনা সংস্কৃতি থেকে পশ্চিমা জগতের মানুষদের অনেক শিখবার জিনিস আছে। যেমন চীনারা মনে করেন, কোনো কাজে হাত দেওয়ার আগে সব কথা ভাল করে চিন্তা করতে হবে। চীনাদের মতে মানুষের উদার সহিষ্ণুতা ও সমুদ্রতুল্য মুক্তহৃদয় থাকা উচিত।"

চীনের প্রেক্ষাগৃহে রসাত্মক সংলাপ উপভোগকারীদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।। গত কয়েক বছরে তে ইয়ুন সে'র মতো রসাত্মক সংলাপের পেশাগত দলগুলো দিন দিন খ্যাতি অর্জন করেছে। এসব দলের শিল্পীরা ঐতিহ্যের ভিত্তিতে রসাত্মক সংলাপের নবায়ন করেন এবং বিলুপ্তির হাত থেকে কতকগুলো রসাত্মক সংলাপ রক্ষার প্রয়াস চালান। বর্তমানে যারা রসাত্মক সংলাপ উপভোগ করতে প্রেক্ষাগৃহে যান তাঁদের অধিকাংশই যুবযুবতী। তাঁরা সাধারণত সপ্তাহান্তে একসাথে রসাত্মক সংলাপ শুনতে যান।

চীনের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির আকর্ষণ বৃদ্ধির সাথে সাথে বিশ্ব সংস্কৃতির সংগে তার মিলিত হওয়ার গতিও দ্রুততর হচ্ছে।

গত কয়েক বছরে বিশ্ব-ফ্যাশন প্রদর্শক টি-মঞ্চে দেখা যায়, চীনা মহিলাদের লাবণ্য, স্নিগ্ধতা ও গভীরতা-সূচক ঐতিহ্যবাহী পোশাক 'ছি ফাওয়ের' উপাদান মেশানো হয়েছে নানা ধরনের দামী পোশাকে। হুয়া মুক লান ও কুংফু পান্ডা নামে হলিউডে তৈরি চলচ্চিত্রে নানা পদ্ধতিতে চীনা উপাদান গ্রহণ করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশে চীনা গায়িকা সং চু ইংয়ের সার্থক সংগীতানুষ্ঠান পরিবেশনের ফলে চীনের লোকসংগীত বিশ্বের অসংখ্য শ্রোতার কাছে সমাদৃত হয়েছে। এই উত্সাহব্যঞ্জক পরিস্থিতিতে চীনের সংস্কৃতি খাতের অনেক প্রতিষ্ঠান স্থানীয় সংস্কৃতিকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার নতুন ব্যবস্থা নিচ্ছে। বিদেশে চীনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কোম্পানির কর্মকর্তা ওয়াং সিউ ছিন সংবাদদাতাকে বলেন,

"দশ বছর আগে আমরা যদি কোনো দেশে চীনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করতে চাইতাম, তাহলে বিদেশিদের মাধ্যমে আমাদের কোম্পানির প্রচারণা চালাতে এবং টিকেট বিক্রি করতে হত। কালক্রমে আমাদের আর্থিক ভিত্তি মজবুত হয়ে উঠেছে এবং আমাদের যথেষ্ট অভিজ্ঞতাও সঞ্চিত হয়েছে। তিন-চার বছর ধরে আমরা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিখ্যাত লিঙ্কন কেন্দ্র ও কেনেডি কেন্দ্রে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশনের ব্যবস্থা করেছি। থিয়েটার ভাড়া নেওয়া, প্রচারণা চালানো এবং টিকেট বিক্রি করার মতো সব কাজ আমরা নিজেই সম্পন্ন করছি। আমরা বিদেশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশনের অধিকার পেয়েছি।"

বিদেশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলা এবং কনফুসিয়াস স্কুল খোলার মাধ্যমে চীনের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির অংশ হিসেবে দড়াবাজি, কংফু, হস্তলিপিশিল্প, পেইচিং অপেরা ও থাইজি শরীরচর্চা আন্তর্জাতিক মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে। চীনের বৈদেশিক সংস্কৃতি কোম্পানির সংবাদ বিভাগের কর্মকর্তা ওয়াং হং পো বলেন, গত কয়েক বছরে পরিমাণ ও গুণের দিক থেকে চীনের সাংস্কৃতিক পণ্যের লক্ষণীয় উন্নতি হয়েছে। তিনি বলেন,

"আগের চেয়ে এখন বিদেশে আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশনের ব্যাপকতা যে অনেক বেড়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেবল আমাদের একটি কোম্পানির উদ্যোগেই প্রতি বছর বিদেশে ৫ থেকে ৬ হাজার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। এতে দর্শকদের সংখ্যা দাঁড়ায় এক কোটির কাছাকাছি। এ ছাড়া, আমরা প্রতি বছর সচেতনভাবে বাণিজ্যিক পদ্ধতিতে বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী ও প্রসিদ্ধ প্রেক্ষাগৃহের মঞ্চে আমাদের সাংস্কৃতিক পণ্য প্রদর্শনের কার্যকর ব্যবস্থা নিই।"

২০০৪ থেকে ২০১০ পর্যন্ত চীনের বৈদেশিক সংস্কৃতি কোম্পানি বিশ্বের ৮০টি দেশ ও অঞ্চলে যে সব শিল্পীদের ৬৩০টি দল পাঠিয়েছে, তাঁরা ৩৩ হাজার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেছেন। ওই সব পরিবেশনায় দর্শকের সংখ্যা ছিল ৭ কোটিরও বেশি। ৬০ শতাংশ বাণিজ্যিক অনুষ্ঠান পরিবেশনের কারণে কোম্পানিটির মোটা অংকের আয় হয়েছে।

নিউইয়র্কের টাইমস মহাচত্বরে প্রদর্শিত চীন বিষয়ক চলচ্চিত্রে চীনাদের ভাবমূর্তি সুস্পষ্টভাবে দীপ্যমান হয়ে ওঠে। ভিয়েনার দুর্গ-থিয়েটারে পেইচিং অপেরা মঞ্চস্থ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসের থিয়েটারে যে দড়াবাজি, নৃত্য ও কংফু পরিবেশন করা হয়, তাতে চীনের শিল্পকলার স্বাতন্ত্র মূর্ত হয়ে ওঠে। গত ১০ বছরে বিদেশে চীনের যে বিপুল সংখ্যক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়, বিদেশিদের জন্য সেগুলো চীনকে জানার জানালা ও মঞ্চ। বস্তুত সেগুলো পরস্পরকে জানার জন্য চীন ও অন্যান্য দেশের জন্য চমত্কার উপায়ও বটে।

চীনের বৈদেশিক সংস্কৃতি কোম্পানির সংস্কৃতি বিনিময় বিভাগের উপ-তত্ত্বাবধায়ক ওয়াং সিউ ছিন বলেন, সারা বিশ্বে চীনের মর্যাদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চীনের শিল্পকর্ম বিদেশিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। তাই তাঁর কোম্পানি বিদেশে একটির বদলে বহু বা ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশনের উদ্যোগ নিচ্ছে, যাতে বিদেশি দর্শকরা নানা দিক থেকে সামগ্রিকভাবে চীন ও চীনের পরিবর্তনশীল সংস্কৃতিকে জানার সুযোগ পান। তিনি বলেন,

"আগে আমরা এক এক বার এক একটি সাংস্কৃতিক দল বিদেশে পাঠাতাম। সেই সাংস্কৃতিক দল কোনো একটি দেশে গিয়ে শুধুমাত্র ৩টি বা ৪টি অনুষ্ঠান পরিবেশন করত। ২০০৫ সালের পর বিদেশে আমাদের ধারাবাহিক অনুষ্ঠান পরিবেশন আরম্ভ হয়। চীনের বসন্ত উত্সব উপলক্ষে চীনের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম অনুযায়ী অনেকগুলো শিল্পীদল অনেক দেশে গিয়ে নানা রকম অনুষ্ঠান পরিবেশন করে। গত তিন-চার বছর ধরে আমাদের কোম্পানিও 'চীনের ছন্দময় সৌন্দর্য' শিরোনামে বিদেশে অনুষ্ঠান পরিবেশনের যে একটি কার্যক্রম তৈরি করে, সেটা অনুযায়ী চীনের শিল্পীরা বিদেশের নামকরা থিয়েটারে অসংখ্য দর্শকের জন্য চীনের নৃত্য নাটক ও ঐকতান পরিবেশন করেছেন।"

তিনি বলেন, "গত কয়েক বছরে আমরা অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, সুইজারল্যান্ড, ইতালি, বেলজিয়াম প্রভৃতি দেশে চীনা সাংস্কৃতিক উত্সবের আয়োজন করেছি। ২০১০ সালে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি কেন্দ্রে একটি চীনা সংস্কৃতি উত্সবের আয়োজন করি। চীনের কেন্দ্রীয় ব্যালে নৃত্যদল, পেইচিংয়ের গণনাটক দল, আধুনিক নৃত্যদল এবং পেইচিং কুন চু অপেরা দলসহ ৮টি পেশাগত চীনা সাংস্কৃতিক দল এ উত্সবে অংশ নেয়।"

চীনের সংস্কৃতি মহলের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মনে করেন, চীনের 'গল্প' বলতে হবে প্রচলিত আন্তর্জাতিক শৈল্পিক রীতিতে, যাতে বিদেশি দর্শকরা সহজে তা বুঝতে এবং গ্রহণ করতে পারেন। চীনের বিখ্যাত সাংস্কৃতিক সমালোচক থান ফেই বলেন, চীনা সংস্কৃতির রয়েছে অফুরন্ত মাধুর্যরস। ভবিষ্যতে বিদেশে পদার্পনের সময় চীনা সংস্কৃতির আত্মবিশ্বাস পোষণ এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজের উত্কর্য প্রদর্শন করা উচিত। তবে ঐতিহ্যের সৃজনশীল রূপান্তর ঘটাতে নিজের বৈশিষ্ট্য হারানো উচিত নয়। যথার্থভাবে আন্তর্জাতিক রীতি গ্রহণ করলে আন্তর্জাতিক মঞ্চে চীনা সংস্কৃতির নিজস্ব শৈল্পিক মাধুর্য ও প্রাণশক্তি প্রদর্শন করা সম্ভব।

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক