Web bengali.cri.cn   
প্রাচীনকালের বিখ্যাত ভূগোলতত্ত্ববিদ শিশাখের জীবন সম্পর্কে
  2012-12-10 18:43:38  cri
শিশাখে মিং রাজবংশের শেষ দিকের একজন বিখ্যাত ভূগোলতত্ত্ববিদ ছিলেন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন চিয়াংসু প্রদেশে। 'হংজু' তার আসল নাম ছিল। 'শাখে' ছিল তার ডাকনাম। ছোটবেলা থেকে তিনি প্রাকৃতিক রহস্য নিয়ে গবেষণা করতে পছন্দ করতেন। যখন তার বয়স ২২ বছর, তখন তিনি দেশের বিভিন্ন জায়গা ভ্রমণ করতে শুরু করেন। অবশেষে তিনি 'শিশাখের ভ্রমণকাহিনী' শীর্ষক একটি বই লেখেন। চীনের ইতিহাসে এটি একটি বিখ্যাত গ্রন্থ। এটা কেবল একটি ভূগোলবিষয়ক বই তাই নয়, একটি শ্রেষ্ঠ সাহিত্য রচনাও বটে। ।

ছোটবেলা থেকে শিশাখে বই পড়তে অত্যন্ত পছন্দ করতেন। যে-কোন নতুন জিনিসের ওপর তার কৌতুহল ছিল ব্যাপক। তখন তার বাসায় 'সেনহাইডুচিন' নামক একটি বই ছিল। তিনি কয়েক দিনে মধ্যে এই বই পড়ে শেষ করলেন। এই বইতে বিভিন্ন জায়গার নামকরা নদনদী ও পাহাড়পবর্ত, নানা ধরনের পাখি ও প্রাণী এবং খনিসম্পদের কথা লিপিবন্ধ ছিল। তা ছাড়া, বইতে অনেক সুন্দর সুন্দর রুপকথাও ছিল। এক কথায়, শিশাখের কাছে এটি একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় বই ছিল। এ বই পড়তে শুরু করলে তিনি ভাত খাওয়ার কথাও ভুলে যেতেন। স্কুলে তিনি ছেলে-মেয়েদের সামনে এই বই নিয়ে অনেক গল্প করতেন। সবাই তার গল্প মন দিয়ে শুনতেন।

'সেনহাইডুচিনের' মতো বই পড়ার পর শিশাখের মনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করার আকাংক্ষা জেগে ওঠে। তিনি তার এই ভাবনার কথা বাবা-মাকে বললেন। কিন্তু তার বাবা তাকে বাইরে যেতে বাধা দিলেন। যখন শিশাখের বয়স ১৯ বছর, তখন তার বাবা মারা যান। প্রাচীনকালের নিয়ম অনুযায়ী, বাবা বা মা মারা যাওয়ার পর সন্তানেরা বাইরে যেতে পারতেন না; অন্তত তিন বছর তাদেরকে বাসায় থাকতে হতো, শোক প্রকাশের জন্য। অতএব শিশাখে বাবার প্রতি সম্মান দেখাতে এবং প্রাচীন প্রথা মেনে চলার জন্য তিন বছর বাসা থেকে বের হননি। তিন বছর পর তার মনে আবারো ভ্রমণে যাওয়ার খেয়াল চাপলো। একদিন তার ৬০ বছর বয়স্ক মা তাকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করলেন: 'আজকাল তোমাকে খুব চিন্তিত দেখি। এর কারণ কী?" শিশাখে উত্তর দিলেন: 'ছোটবেলা থেকে আমার একটি স্বপ্ন আছে। তা হল, দেশের বিভিন্ন জায়গা আমি ঘুরে দেখবো। কিন্তু জীবিত অবস্থায় বাবা আমাকে যেতে দেননি। এখন তুমি আমাকে যেতে দিতে রাজি হলেও, তোমাকে ছেড়ে যেতে আমার খারাপ লাগছে।"

তখন মা ছেলেকে বললেন, 'বোকা ছেলে কোথাকার! তোমার মুখে এ-ধরনের কথা মানায় না। পুরুষদের উচ্চাভিলাষতো স্বাভাবিক বিষয়। সবসময় বাসায় থাকলে তুমিতো উদ্যানের হাঁস-মুরগির মতো হয়ে যাবে। বাইরে যাও। সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে বেড়িয়ে পড়ো।"

"তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু তোমার জন্য আমার ভাবনা হয়।" শিশাখে আবেগের সাথে বললেন।

'আমি জানি, তুমি একজন ভাল ছেলে। কিন্তু মা হিসেবে তোমাকে তোমার জীবনের লক্ষ্য থেকে দূরে রাখা আমার উচিত হবে না। তবে, আমার জন্য তোমার ভাবনার একটা সমাধানও আমি ঠিক করেছি। এ-ব্যাপারে তোমার প্রতি আমার একটি প্রস্তাব আছে।"-- শিশাখের মা বললেন।

'তোমার প্রস্তাবটি কী? তাড়াতাড়ি আমাকে বল।' শিশাখে উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন।

মা বললেন: 'প্রতিবার যখন তুমি বাইরে যাবে, কোথায় যাচ্ছো আমাকে জানিয়ে যাবে। সেখানে তুমি কতোদিন থাকবে, তাও আমাকে জানিয়ে যাবে। কারণ, আমি তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকবো। তবে মনে রেখ, তোমাকে ঠিক সময়ে ফিরে আসতে হবে। যদি তুমি এ-নিয়ম মেনে চলতে পার, তাহলে আমি তোমার জন্য দুশ্চিন্তা করবো না। তুমি কী বল?"

মমতাময়ী মা শিশাখেকের দিকে তাকিয়ে আরো বললেন: 'আরেকটি কথা। যদিও তোমার সবর্ত্র ভ্রমনের আকাংক্ষা আছে, তোমাকে কিন্তু একাগ্রচিত্তে নিজের কাজ করে যেতে হবে। আমার শরীর তেমন ভাল নয়, কিন্তু আমি তোমার জন্য বাসা দেখাশোনা করতে পারি। বাইরে যাকিছু দেখবে, ফিরে এসে সে-গল্প আমার কাছে করবে।"

'ঠিক আছে। তোমার প্রস্তাব অত্যন্ত ভাল।' শিশাখে আনন্দের সাথে মাথা নাড়লেন।

রওয়ানার আগে মা একটি টুপি শিশাখের মাথায় পরিয়ে দিলেন। তিনি বললেন: 'এটা আমার নিজের হাতে তৈরী টুপি। এটির প্রতি তাকালে তুমি মনে করবে আমাকে দেখছ। আমার জন্য তুমি কোন চিন্তা করবে না। একাগ্রচিত্তে তোমার গবেষণা কাজ চালিয়ে যাবে।'

পরদিন শিশাখে অশ্রুপূর্ণ নয়নে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। এরপরই তিনি প্রকৃতির সাথে মিশে যেতে থাকেন।

ভ্রমণের সময় তিনি কোনদিন প্রতিকূল আবহাওয়া এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেননি। বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি পড়ছে---ঠিক এমন সময় দেখা গেল তিনি একটি পাহাড়ে আরোহণ করছেন। শিশাখে বিশ্বাস করতেন যে, কষ্টে আনন্দ আছে। কষ্ট অতিক্রম না-করলে আনন্দ কাকে বলে জানা যায় না। শিশাখে এই ধারণায় দিনের পর দিন তার ভ্রমণ-অভিযান চালিয়ে গেছেন। দেশের বিভিন্ন জায়গার প্রাকৃতিক পরিবেশ উপভোগ করার পাশাপাশি তিনি অনেককিছু লিখেছেনও।

প্রতিবার বাইরে থেকে বাড়িতে ফিরে তিনি তার মায়ের কাছে ভ্রমণের গল্প করতেন। এ ছাড়া, গ্রামবাসীরাও তার গল্প শুনতে তার বাসায় ভীর জমাতো। বয়স ২২ বছর হওয়ার পর তিনি প্রতি বছর নিয়ম করে ভ্রমণে যেতেন। পূর্বাঞ্চলের জেনচিয়াং থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ইন্নায়েন, উত্তরাঞ্চলের হোপে থেকে দক্ষিণাঞ্চলের কুয়াংতুং—এ-সব জায়গা তিনি ঘুরে দেখেছেন। ইতিহাস বলছে, সারা জীবনে তিনি বতর্মান চীনের ২৫টি প্রদেশে ভ্রমণ করেছিলেন।

ভ্রমণের সময় তিনি অনেক কষ্ট সহ্য করেছেন। কিন্তু দমে যাননি; নিজের অনুসন্ধান-কাজ থামিয়ে রাখেননি। তিনি জীবনে বেশ কয়েকবার পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছেন। ভ্রমণের সময় এমন বড় দুর্ঘটনায় পড়েছেন, যাতে তার মৃত্যু হতে পারতো। তিনি নিজের হাতের কলম দিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গার সুন্দর দৃশ্য, মূল্যবান সম্পদ এবং স্থানীয় রীতিনীতি সম্পর্কে লিখেছেন।

১৬৪০ সালে শিশাখে চার বছরব্যাপী দীর্ঘ সময়ের ভ্রমণ শেষ করেন। ইয়েন্নান পৌছে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সে-বছরের গ্রীষ্মকালে তাকে নিজের বাড়িতে পাঠানো হল। বাড়িতে ফিরে তিনি চিকিত্সা নেয়ার পাশাপাশি, তার প্রতিদিনের ডায়েরি নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। এসব ডায়েরির তথ্য একত্রিত করে তিনি শেষ পর্যন্ত একটি মোটা গ্রন্থ সম্পাদন করছিলেন।

পরের বছর অর্থাত ১৬৪১ সালে এই মহান ভ্রমণকারী ও ভূগোলতত্ত্ববিদ মৃত্যুবরণ করেন। দু:খের ব্যাপার হল, তার অধিকাংশ ডায়েরি পরে আর পাওয়া যায়নি। সংরক্ষিত অংশগুলো প্রকাশিত হয় 'শিশাখের ভ্রমণবৃত্তান্ত' নামক বই আকারে। এই বইয়ে মোট চার লাখেরও বেশী শব্দ আছে। বইটিকে ভূগোলতত্ত্ব বিষয়ক একটি বিখ্যাত বই বলে গণ্য করা হয়।

সুপ্রিয় শ্রোতা, এতোক্ষণ 'শিশাখে' সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন শুনলেন। আমার সঙ্গে থেকে অনুষ্ঠানটি শোনার জন্য অশেষ

সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন
মন্তব্য
লিঙ্ক