মো ইয়ানকে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার দেয়ার কারণ প্রসংগে তিনি বলেন, মো ইয়ান লোক-কাহিনী, ইতিহাস ও সমকালীন সমাজের সাথে বাস্তবতাকে সার্থকভাবে সংযুক্ত করেছেন। তাঁর সাহিত্যজগতে প্রবেশ করলে উইলিয়াম ফোলকনার ও গ্যাব্রিল গার্সিয়া মার্কুজের রচনাশৈলীর কথা মনে পড়ে, সেই সাথে চীনের ঐতিহ্যবাহী সাহিত্য ও মৌখিক সাহিত্যের একটি নতুন সূচনার সন্ধানও পাওয়া যায়।
একই দিন সন্ধ্যায় চীনের কেন্দ্রীয় টিভিকেন্দ্র থেকে ২০১২ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার মো ইয়ানকে দেয়ার খবর প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথে বিশাল চীন দেশে আনন্দ-উচ্ছাসের বন্যা বয়ে যায়।
চীনের সাহিত্যসমালোচকরা মনে করেন, চীনা সাহিত্য যে বিশ্ব সাহিত্য জগতে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং চীনের দিকে পাশ্চাত্য সাহিত্যের দ্বার যে খোলা হয়েছে, মো ইয়ানের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার জয় তার প্রমাণ। আগামীদিনে পাশ্চাত্য সাহিত্যমহল ও অনুবাদকমহল নিশ্চয় চীনা লেখকদের ওপর আরো নিবিড় দৃষ্টি রাখবেন।
একইদিন রাতে দেশবিদেশের সাংবাদিকদের দেয়া এক সাক্ষাত্কারে মো ইয়ান বলেন, নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার খবর পেয়ে আমি যেমন অত্যন্ত আনন্দিত, তেমনই একটু বিস্মিতও। কেননা, আমার পক্ষে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পাওয়া নেহায়ত দূরের ব্যাপার বলে মনে হয়েছিল। যাই হোক, মনের আনন্দ প্রকাশ করার জন্য আমি ও আমার পরিবারপরিজন আজ চীনের ঐতিহ্যবাহী পিঠা " চাও চি" খাব। " চাও চি" আমার সবচেয়ে প্রিয় খাবার।
তিনি আরো বলেন, আমি মনে করি এ পুরস্কার বিশেষ কোনো কিছুর পরিচায়ক নয়; চীনে অনেক সুপ্রতিষ্ঠিত লেখক আছেন, তাঁদের লেখাও বিদেশে স্বীকৃতি পাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
তিনি আরো বলেন, আগামীতেও আমার বেশীর ভাগ শক্তি নতুন রচনাসৃষ্টিতে প্রয়োগ করা হবে। আমার সাহিত্য সাধনা চলতে থাকবে। নোবেল পুরস্কারের সাংগঠনিক কমিটি থেকে পুরস্কার বিতরণের দিনক্ষণ জানার পর আমি নিশ্চয় সুইডেন যাব ।
প্রিয় শ্রোতা, চীনের কেন্দ্রীয় টিভি কেন্দ্রের উপস্থাপক পাই ইয়ান সং একইদিনে মো ইয়ানের সাক্ষাত্কার নেন। এবার শুনুন তাঁদের কথোপকথনের বিবরণ:
পাই ইয়ান সং: মো ইয়ান সাহেব, এই মুর্হুতে তো আপনার পেইচিং শহরে থাকার কথা। কিন্তু আপনি এখনো আপনার জন্মস্থান কাও মি শহরের উপকণ্ঠে পড়ে আছেন। আপনি কী ইচ্ছা করেই নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন?
মো ইয়ান: এক মাস হলো আমি এখানে ফিরে এসেছি। প্রতিবছর এ-সময় আমি এখানে ফিরে একাগ্রচিত্তে কিছু লিখতে চেষ্টা করি। কেননা, এখন শরত কাল, ফসল তোলার সময় । এখানে আমার বৃদ্ধ বাবা ও গ্রামবাসীদের সাথে কিছুদিন কাটাই এবং গ্রামের পরিবর্তনশীল জীবন ও কৃষকের মানসবৃত্তির খবর নিই। গত বছর ও তার আগের বছরের এ-সময়ও এখানে ছিলাম।
পাই ইয়ান সং: আপনি যে কাও মি জেলায় আছেন এ এখবর পেয়ে হঠাত মায়াবাদের কথা আমার মনে পড়ে গেল। কেননা, কাও মি জেলায় লাল সরঘাম চাষ করার যে জমি আপনাকে সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশ করতে উত্সাহ দেয় এবং আপনার সম্মান বয়ে আনে সেই জমিতে বসে আপনি আজ নোবেল সাতিহ্য পুরস্কার জয়ের সুখবর পান। এটা যেন একটি দৈব ব্যাপার ।
মো ইয়ান: দৈব ব্যাপার বটে। আগেভাগে তো নোবেল সাতিহ্য পুরস্কার পাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখিনি।
পাই ইয়ান সং: মো ইয়ান সাহেব, সত্যি কথা বলতে কি, এ সুখবর পাওয়ার দিনখানেক আগে থেকেই অনেক সাংবাদিক আপনাকে অনুসরণ করছিলেন। এ-জন্য মনে মনে একটু বিরক্ত বোধ করছিলেন কি?
মো ইয়ান: মোটেই না। এ সুখবরের জন্য তাঁরা কয়েকদিন অপেক্ষা করেছেন। কাও মি শহরের সংস্কৃতি বিভাগের অফিসভবনে গিয়ে আমি তাঁদের অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি ও নিষ্ঠার সাথে সাংবাদিকের দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁদের সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদও জানিয়েছি।
পাই ইয়ান সং: এখন আপনার বয়স ৫৭ বছর। এর আগে আপনি নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পাননি, পরে তো আর পাওয়ার প্রশ্নও উঠে না। আপনার সাহিত্য সৃষ্টির প্রৌঢ়কালে এ পুরস্কার আপনার হস্তগত হয়েছে। তা আপনার সাহিত্যসাধনায় বিঘ্ন ঘটাতে পারে কি?
মো ইয়ান: নোবেল সাহিত্য পুরস্কারও একটি পুরস্কার মাত্র । এ পুরস্কার পাওয়া কোনো বিশ্বকাঁপানো ঘটনা নয়। এ পুরস্কার পাওয়ার মানে এই নয় যে, আমি চীনের শ্রেষ্ঠ লেখক। আমি স্পষ্টই জানি, চীনে প্রথম শ্রেণীর বহু লেখক আছেন। নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার যোগ্যতা আছে, এমন চীনা লেখকের সংখ্যাও বড় কম নয়। লেখকের পক্ষে সবচেয়ে বড় জিনিষ হলো লেখা, পুরস্কার নয়। আমি যে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছি তাতে শুধু বোঝা যায় যে, আমি একটু বেশী সৌভাগ্যবান।
পাই ইয়ান সং: সুইডেনের সাহিত্য একাডেমীর ঘোষণাপত্র থেকে জানা যায়, উইলিয়াম ফোলকনার ও গার্সিয়া মার্কেজের যাদুকরী রচনাশৈলীর সাথে আপনার লেখার নিগূঢ় যোগসূত্র রয়েছে। এটা কী সত্য? আপনি কী তাদের প্রভাববলয় থেকে মুক্তি পেতে চান, কিংবা ইতোমধ্যে পেয়ে গেছেন?
মো ইয়ান: ১৯৮৭ সালে উইলিয়াম ফোলকনার ও গার্সিয়া মার্কেসের ওপর আমার লেখা একটি প্রবন্ধে তাঁদের সংগে চীনা লেখকদের বিশেষ করে আমার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এ দুজন খ্যাতনামা বিদেশী লেখকের প্রভাবে আমি যে প্রভাবিত হয়েছি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁদের লেখা পড়ে সহসা আমার বুদ্ধি খোলাসা হয়েছিল। বুঝতে পারলাম, গল্প লেখার আরেকটি পথ আছে। তবে তাঁদের রচনাশৈলি গ্রহণের সাথে সাথে তাঁদের কাছ থেকে পালিয়ে আসার ইচ্ছাও মনে জাগে। এখানে "পালানো" শব্দটি ব্যবহারের কারণ হলো এ যে, তাঁদের কাছে বেশী দিন থাকলে আমার ব্যক্তিত্ব লোপ পেতে পারে। আমার চোখে তাঁরা যেন দু্টি উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরি, যার খুব কাছে থাকলে গলে যাওয়ার ভয় থাকে। তাই তাঁদের কাছ থেকে যতদূরে থাকি ততই নিরাপদ।
পাই ইয়ান সং: তাহলে বোধহয় এ কথাও বলা যায় যে, সুইডেনের সাহিত্য একাডেমী শুধু আপনার আগেকার সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন করেছে।
মো ইয়ান: তাই তো মনে হচ্ছে। "পরিশ্রান্ত জীবনমৃত্যু" নামে আমার উপন্যাস সুইডিস ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বলাবাহুল্য, এই উপন্যাসে কিছু মায়াবী উপকরণ আছে, কিন্তু তা নিছক চীনা জাতির জিনিষ । অর্থাত চীনের লোক-কাহিনীর সাথে তার নিগূঢ় সম্পর্ক রয়েছে। এদিক থেকে বিচার করলে দেখা যায়, তাদের মূল্যায়ন নির্ভুল। কিন্তু তাদের মন্তব্য যে আমার বিশ-তিরিশ লাখ চীনা শব্দের উপন্যাসগুলোর যথার্থ বিচার –বিশ্লেষণ এ কথা নিশ্চয় বলা যায় না ।
চীনের লেখক সংঘের ভাইস চেয়ারম্যান হো চিয়ান মিন সিনহুয়া সংবাদ সংস্থাকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে বলেন, মো ইয়ান যে নোবেল সাহিত্য পুরস্কার জয় করেছেন তা শুধু মো ইয়ানের সাহিত্যচর্চার নয়, গত একশ বছরে চীনের সকল লেখকের সাহিত্যচর্চার বিশেষ করে আধুনিক যুগে চীনের লেখকদের সাহিত্যচর্চার সাফল্যের স্বীকৃতি।
তিনি আরো বলেন, চীনের সাহিত্যের ইতিহাসে মো ইয়ানের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার জয়ের বিশেষ তাত্পর্য আছে। অতীতে কিছু লোকের ভুল ধারণা ছিল যে, সাহিত্যের ভূমিকা বহুলাংশে কমে গেছে। তাঁরা হয়তো জানেন না, মো ইয়ান, চিয়া পিং আও, চাং ওয়েইসহ বহু লেখক নিরবে চীনা সমাজের ওপর দৃষ্টি রেখে তাঁদের লেখায় বাস্তববাদী পদ্ধতিতে সমসাময়িক সমাজের বিবর্তন চিত্রিত করতে প্রয়াসী। তাঁদের দৃষ্টিকোণ ও ভাবানুভুতি চীনা জাতির ভাগ্যের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাঁদের সাহিত্যসাধনার গাম্ভির্য্যে মূর্ত হয়ে ওঠে সাহিত্যসৃষ্টির মূল লক্ষ্য ।
মো ইয়ানের কাছে পাঠানো চীনের লেখক সংঘের একটি অভিনন্দনবার্তায় বলা হয়, মো ইয়ানের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার জয় করাটা শুধু তাঁর পক্ষে নয় চীনের সকল লেখকের পক্ষেও একটি মহা আনন্দের ব্যাপার। বস্তুত: এতে চীনের একাধিক প্রজন্মের লেখকদের স্বপ্ন পূর্ণ হলো।
এ অভিনন্দনবার্তায় আরো বলা হয়, গত কয়েক দশক ধরে মাতৃভূমির প্রতি নির্মল ভালাবাসা নিয়ে মো ইয়ান সাহিত্যসৃষ্টির পথে অগ্রসর হয়েছেন। জনসাধারণের সংগে তাঁর সম্বন্ধ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। গত শতাব্দির আশির দশক থেকে তিনি নিরীক্ষামূলক সাহিত্য রচনায় ব্রতী হন। তিনি তাঁর জন্মস্থানের মাটির গভীরে শিকড় গেড়ে সেখানকার কৃষকদের জীবন থেকে শৈল্পিক রস এবং গত শতাধিক বছরে চীনা জাতির ভাগ্য ও সংগ্রাম থেকে মানসিক শক্তি আহরণ করেন। চীনের প্রাণবন্ত ও স্বতন্ত্র সাহিত্যধারার ভিত্তিতে তিনি চীনা সাহিত্যের কল্পলোক, ধ্যানধারণার গভীরতা ও শিল্প-জগত সাধ্যমত সম্প্রসারণ করেছেন। চীনের সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর অবস্থান অদ্বিতীয়।
গত ১২ অক্টোবর চীনের কমিউনিষ্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পলিট ব্যুরোর স্থায়ী কমিটির সদস্য লি ছাং ছুন চীনের লেখক সংঘের কাছে লেখা একটি চিঠিতে মো ইয়ানকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন: চীনের সংস্কার ও আধুনিক গঠনকাজে দ্রত অগ্রগতি অর্জনের সাথে সাথে সাহিত্যসৃষ্টিতেও প্রবল প্রাণশক্তির সঞ্চার হয়েছে। যেসব লেখক জনসাধারণের জীবন ও জাতীয় ঐতিহ্যের গহনে প্রবেশ করে চীনের স্বকীয় শিল্পরীতি ও বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সাহিত্যকর্ম রচনা করেছেন, মো ইয়ান তাঁদের প্রতিনিধি। মো ইয়ানের নোবেল সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্তি যেমন চীনের সাহিত্যের বিকাশ ও সমৃদ্ধির নিদর্শন, তেমনই সকল ক্ষেত্রে চীনের প্রবলতা ও সারাবিশ্বে চীনের প্রভাব বিস্তারের লক্ষণও।
লি ছাং ছুন আশা করেন, চীনের লেখকরা জনগণের স্বার্থের কথা মনে রেখে জনসাধারণের মধ্যে থেকে নত্বুন ইতিহাস ও যুগের চাহিদা মেটানোর জন্য উত্কৃষ্ট সাহিত্যকর্ম রচনা করবেন এবং চীনের সংস্কৃতির সমৃদ্ধি ও মানবজাতির সভ্যতা ও প্রগতির জন্য অবদান রাখবেন।