প্রিয় শ্রোতা,হৃদ রক্তনালী রোগ মানবজাতির জন্য এক ঘাতক রোগ হিসেবে চিহ্নিত। বর্তমানে চীনে প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ লোক হৃদরক্তনালী রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে,যা বছরে মোট মৃত্যুর ৪০শতাংশ । হৃদরক্তনালী রোগের কী কী লক্ষণ আছে?কী ধরনের চিকিত্সা পদ্ধতি সবচেয়ে নিরাপদ এবং কার্যকর এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে স্বাভাবিকভাবেই অনেক রোগী আগ্রহী। আজকের 'স্বাস্থ্যের সন্ধানে' আসরে আপনাদের সঙ্গে নিয়ে প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব আমি, চুং শাওলি।
হৃদপিন্ডে রক্ত সরবরাহকারী করোনারি ধমনি সঙ্কীর্ণ হলে মায়োকার্ডিয়াল রক্তপ্রবাহরোধ হয়,অক্সিজেনের অভাব হয় এবং হৃদপিন্ডের কার্যক্রম ব্যাহত হয় । এ-সময়ে সৃষ্ট হৃদরোগ হল করোনারি হৃদরোগ ।
হৃদ রক্তনালী রোগ জন্মগত ও স্বোপার্জিত হৃদরক্তনালী রোগে বিভক্ত। আমরা যে করোনারি হৃদরোগ বলি তা স্বোপার্জিত হৃদ রক্তনালী রোগ । কী কী কারণে একজন করোনারি হৃদরোগে আক্রান্ত হতে পারে?এ-সম্পর্কে ডাক্তার লি থিয়েনছাং বলেন,আসলে করোনারি হৃদরোগ জীবনযাপন পদ্ধতির সঙ্গে সম্পর্কিত একটি রোগ। অযৌক্তিক ও স্বেচ্ছাচারী জীবনযাপন পদ্ধতি, যেমন; বেশি খাওয়া,কম শরীরচর্চা বা একদম শরীরচর্চা না-করা এবং আরামদায়ক জীবনযাত্রার ফলে মানবদেহে অতিরিক্ত চর্বি জমে করোনারি হৃদরোগ হয়।
ডাক্তার লি যেমন বলেছেন, আজও পর্যন্ত করোনারি হৃদরোগের কারণ স্পস্ট নয়। বলাবাহুল্য, চিকিত্সাবিদ্যাগত গবেষণা থেকে আবিস্কার করা হয়েছে যে,বেশ কয়েকটি অবস্থায় করোনারি হৃদরোগ সহজে হতে পারে। যেমন; উচ্চ রক্তচাপ,বহুমূত্র রোগ,উচ্চ রক্তঘনত্ব,পেরিফেরাল রক্তনালী রোগ,বংশগত করোনারি হৃদরোগ,ধূমপান,স্থূলতা,উচ্চচর্বিযুক্ত খাদ্য,শরীরচর্চার অভাব ইত্যাদি। কিন্তু এগুলোর মধ্যে একটা বা একাধিক উপাদান থাকলেও করোনারি হৃদরোগ নাও হতে পারে। সুতরাং এগুলোকে আমরা করোনারি হৃদরোগের কারণ বলি না। কেবল এগুলোকে করোনারি হৃদরোগের বিপজ্জনক উপাদান বলি। এ কয়েকটি বিপজ্জনক উপাদানের সংখ্যা মানবদেহে যত বেশি থাকে করোনারি হৃদরোগের ঝুঁকি ততই বাড়ে,রোগটিতে আক্রান্তের সময় ততই আগে হয় এবং রোগটি ততই গুরুতর হয়। সুতরাং জনসাধারণের উচিত নিজেদের শরীরে করোনারি হৃদরোগের বিপজ্জনক উপাদানের ওপর গুরুত্ব দেয়া, তা নিয়ন্ত্রণ করা এবং প্রয়োজন হলে ওষুধের মাধ্যমে চিকিত্সা করা।
করোনারি হৃদরোগের উপাদানগুলো অত্যন্ত জটিল বলে, এর আগাম লক্ষণ সহজে উপেক্ষিত হয়। তাই প্রতিরোধ ও চিকিত্সার জন্য করোনারি হৃদরোগের লক্ষণ নির্ণয় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ-সম্পর্কে ডাক্তার লি বলেন নাভি থেকে মাথা পর্যন্ত যে কোনো জায়গায় অল্প সময়ের ব্যথা,পেট ব্যথা, এমনকি দাঁত ব্যথাওউপেক্ষা করবেন না। কোনো শারীরিক কর্মকাণ্ডের পর অল্পসময়ের জন্য সৃষ্ট ব্যথাও উপেক্ষা করবেন না; এগুলো হৃদপিন্ডের সমস্যা হতে পারে।
হৃদরোগগুলোর মধ্যে করোনারি হৃদরোগের প্রকোপই সবচে বেশি। বিভিন্ন করোনারি হৃদরোগের লক্ষণ বিভিন্ন ধরনের। মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনজনিত করোনারি হৃদরোগের কথাই ধরা যাক। মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন হওয়ার এক সপ্তাহ আগে থেকেই রোগীর শরীরে হালকা ব্যথার লক্ষণ দেখা দেয়। শারীরিক পরিশ্রমের সময় ক্লান্তির অনুভূতি হয়। ইনফার্কশনের সময় বিরামহীনভাবে প্রচন্ড চাপ ও শ্বাসরোধের অনুভূতি হয়, এমনকি ছুরি দিয়ে কেটে গেলে যেধরনের ব্যথা হয়, তেমন ব্যথার অনুভূতি হয়। এ ব্যথা বক্ষাস্থির পিছনে এবং গোটা বুকে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাম বুকের ব্যথা অপেক্ষাকৃত বেশি। কখনো কখনো এ-ব্যথা পেটের উপরে হয় বলে সহজে একে ভুল করে পেটের ব্যথা হিসেবে নির্ণয় করা হয়। ব্যথার সময় অল্প জ্বর হয়,অস্থির লাগে, অতিরিক্ত ঘাম হয়,বমির ভাব বা বমি হয়,বুক ধড়ফড় করে এবং মাথা ঝিমঝিম করে। এ-সময় অতি পরিশ্রান্ত লাগে,শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এ-অবস্থা ৩০ মিনিটেরও বেশি সময়-- এমনকি কয়েক ঘন্টা স্থায়ী হতে পারে।
অ্যাজানা পেকটরিসজনিত করোনারি হৃদরোগের লক্ষণ হল, বক্ষাস্থির পেছনে চাপ ও শ্বাসরোধজনিত ব্যথা এবং সাথে সাথে মনে উত্কন্ঠা জাগা। ৩-৫ মিনিট ধরে স্থায়ী এ-ব্যথা প্রায়ই বামর বাহু,কাঁধ,চিবুক,গলা এবং পিঠে ছড়িয়ে পড়ে এবং ডান বাহুতেও বিস্তার লাভ করতে পারে।
হৃদপিন্ডের ক্রিয়া ব্যাহত এবং স্পন্দন বিশৃঙ্খলাজনিত করোনারি হৃদরোগের লক্ষণ হল, যে রোগী অ্যাজানা পেকটরিসে আক্রান্ত ছিল, রোগের ব্যাপক পরিবর্তনের পর মায়োকার্ডিয়াল ফাইবরোসিস হওয়ার কারণে অ্যাজানা পেকটরিস ধাপে ধাপে কমে যায় এবং অবশেষে সেরে যায়। কিন্তু সাথে সাথে হৃদপিন্ডের ক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার লক্ষণ যেমন শ্বাসকষ্ট, ইডিমা ও দুর্বলতা দেখা দেয়। তা ছাড়া, নানা ধরনের স্পন্দন-বিশৃঙ্খলাও হয়। এর লক্ষণ হল বুক ধড়ফড় করা। আর কিছু রোগীর কখনো অ্যাজানা পেকটরিস হলেও, এদের সরাসরি হৃদপিন্ডের ক্রিয়া ব্যাহত হয় এবং স্পন্দন বিশৃঙ্খল হয়।
আবার অনেক রোগীর করোনারি ধমনি অবরোধ হলেও অ্যাজানা পেকটরিসের অনুভূতি থাকে না; এমনকি কিছু রোগীর মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশনের সময়েও অ্যাজানা পেকটরিসের অনুভূতি হয় না। কিছু রোগীর হৃদপিন্ডের আকস্মিক মৃত্যু হওয়ার পর নৈমিত্তিক পরীক্ষার মাধ্যমে মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন এবং মৃত্যুর কারণ আবিস্কার করা হয় । এটা হল লক্ষণহীন মায়কার্ডিয়াল রক্তপ্রবাহরোধের করোনারি হৃদরোগের লক্ষণ ।
আকস্মিক মৃত্যু হয় এমন করোনারি হৃদরোগ হল করোনারি হৃদরোগ থেকে সৃষ্ট এবং পূর্বাভাস দেয়া যায় না এমন আকস্মিক মৃত্যু । অ্যাকিউট লক্ষণ দেখা দেয়ার ৬ ঘন্টার মধ্যে হৃদপিন্ডের স্পন্দন হঠাত বন্ধ হওয়ায় এ করোনারি হৃদরোগ হয়। এর প্রধান কারণ হল, রক্তপ্রবাহরোধে মায়োকার্ডিয়াল সেল ইলেক্ট্রোফিসিউলজিকল অস্বাবাবিক হওয়া এবং যার ফলে স্পন্দনের গুরুতর বিশৃঙ্খল হওয়া। ডাক্তার জোর দিয়ে বলেন,বিভিন্ন করোনারি হৃদরোগের লক্ষণ ভিন্ন হয় বলে বিভিন্ন ধরনের করোনারি হৃদরোগীর উচিত পূর্ব সাবধানতা অবলম্বনকে গুরুত্ব দেয়া ; যাতে যথাসময় চিকিত্সা করানো যায়।
সারা বিশ্বে এ্যাথরোসক্লিরোসিসের চিকিত্সার জন্য এখনো ওষুধ,মধ্যবর্তী চিকিত্সা পদ্ধতি ও শল্যচিকিত্সা ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হয়। এর মধ্যে মধ্যবর্তী চিকিত্সা পদ্ধতি কম ক্ষতিকর, বেশি কার্যকর এবং নিরাপদ বলে রোগীদের কাছে সমাদৃত হয়। এ-সম্পর্কে ডাক্তার লি বলেন,হৃদরক্তনালীরোগের মধ্যবর্তী চিকিত্সা পদ্ধতি হল আরও কম ক্ষতিকর একটি চিকিত্সা পদ্ধতি। বাহু ও হাতের কব্জি বা উরুর দিকের রক্তনালীর মধ্য দিয়ে মধ্যবর্তী চিকিত্সার বিশেষ যন্ত্রপাতি হৃদপিন্ডের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিয়ে রোগ সনাক্ত করা বা চিকিত্সা করা হয়। এ পদ্ধতিতে ক্ষতি কম এবং কম সময় লাগে বলে রোগীরা তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।
এক কথায়,ভালভাবে হৃদ রক্তনালী রোগের লক্ষণ জেনে নেয়া,যথাসময় চিকিত্সা করা,উপযুক্ত চিকিত্সার পরিকল্পনা খুঁজে বের করা,খাদ্যের ভারসাম্য বজায় রাখা এবং যথাযথ শরীরচর্চা করা হলে করোনারি হৃদরোগ এড়ানো যায় বা রোগের লক্ষণ কমানো যায় ।