Web bengali.cri.cn   
চীন ও ভারতের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা ২
  2012-09-24 09:35:26  cri

পরদিন প্রাতে চিত্রাঙ্গদা দূরে ফেলে দিলেন পুরুষের বেশ। পরিলেন রক্তাম্বর, কঙ্কণ কিঙ্কিণী কাঞ্চি। অনভ্যস্ত সাজ লজ্জায় জড়ায়ে অঙ্গ রহিল একান্ত সসংকোচে। তিনি গোপনে গেলেন সেই বনে অরণ্যের শিবালয়ে, দেখিলেন অর্জুনকে।

চিত্রাঙ্গদা গৃহে ফিরে গিয়ে ভাঙিয়ে ফেলিলেন ধনুঃশর যাহা কিছু ছিল; কিণাঙ্কিত কঠিন বাহু—ছিল যা গর্বের ধন এতকাল তাঁর—লাঞ্ছনা করিলেন তারে নিষ্ফল আক্রোশভরে। এতদিন পরে তিনি বুঝিলেন, নারী হয়ে পুরুষের মন না যদি চিনিতে পারেন, বৃথা বিদ্যা যত তাঁর। অবলার কোমলমৃণালবাহু দুটি তাঁর বাহুর চেয়ে ধরে শতগুণ বল। ধন্য সেই মুগ্ধ মুর্খ ক্ষীণতনুলতা পরাবলম্বিত লজ্জাভয়-লীনাঙ্গিনী সামান্য ললনা, যার ত্রস্ত নেত্রপাতে মানে পরাভব বীর্যবল, তপস্যার তেজ।

এরপর প্রবেশ করেন মদন। চিত্রাঙ্গদা জিজ্ঞাসা করেন: তুমি পঞ্চশর?

মদন উত্তরে বলেন: "আমি সেই মনসিজ, টেনে আনি নিখিলের নরনারী-হিয়া বেদনাবন্ধনে। "

চিত্রাঙ্গদা: কী বেদনা, কী বন্ধন, জানে তাহা দাসী, প্রণমি তোমারপদে। (বসন্তের মুখের পানে তাকিয়ে) প্রভু, তুমি কোন দেব?

বসন্ত: আমি ঋতুরাজ। জরা মৃত্যু দৈত্য নিমেষে নিমেষে বাহির করিতে চাহে বিশ্বের কঙ্কাল; আমি পিছেপিছে ফিরে পদে পদে তাকে করি আক্রমণ; রাত্রিদিন সেই সংগ্রাম। আমি অখিলের সেই অনন্ত যৌবন।

চিত্রাঙ্গদা: প্রণাম তোমারে ভবগন। চরিতার্থ দাসী দেব-দরশনে।

মদন: কল্যাণী, কী লাগী এ কঠোর ব্রত তব? তপস্যার তাপে করিছ মলিন খিন্ন যৌবনকুসুম। অনঙ্গ-পুজার নহে এমন বিধান। কে তুমি, কী চাও ভদ্রে?

চিত্রাঙ্গদা: আমি চিত্রাঙ্গদা, মণিপুররাজকন্যা। মোর পিতৃবংশে কভু পুত্রী জন্মিবে না--দিয়েছিলা হেন বর উমাপতি তপে তুষ্ট হয়ে। আমি সেই মহাবর ব্যর্থ করিয়াছি। অমোঘ দেবতাবাক্য মাতৃগর্ভে পশি দুর্বল প্রারম্ভ মোর পারিল না পুরুষ করিতে শৈব তেজে, এমনি কঠিন নারী আমি।

মদন: শুনিয়াছি বটে। তাই তব পিতা পুত্রের সমান পালিয়াছে তোমা। শিখায়েছে ধনুর্বিদ্যা রাজদণ্ডনীতি।

চিত্রাঙ্গদা: তাই পুরুষের বেশে নিত্য করি রাজকাজ যুবরাজরুপে, শিখিয়াছি ধনুর্বিদ্যা, শুধু শিখি নাই, দেব, তব পুষ্পধনু কেমন বাঁকাতে হয় নয়নের কোণে।

বসন্ত: সুনয়নে, সে বিদ্যা শিখে না কোনো নারী, নয়ন আপনি করে আপনার কাজ, বুকে যার বাজে সেই বোঝে।

চিত্রাঙ্গদা:

এক দিন গিয়েছিনু মৃগ-অন্বেষণে একাকিনী ঘন বনে, পূর্ণা-নদীতীরে। তরুমূলে বাঁধি অশ্ব, দুর্গম কুটিল বনপথে পশিলাম মৃগপদচিহ্ন অনুসরি। ঝিল্লিমন্দ্রমুখরিত নিত্য-অন্ধকার লতাগুল্মে গহন গম্ভীর মহারণ্যে কিছু দূর অগ্রসরি দেখিনু সহসা, রুধিয়া সংকীর্ণ পথ রয়েছে শয়ান ভূমিতলে চিরধারী মলিন পুরুষ। উঠিতে কহিনু তারে অবজ্ঞার স্বরে সরে যেতে— নড়িল না, চাহিল না ফিরে। উদ্ধত অধীর রোষে ধনু-অগ্রভাগে করিনু তাড়না—সরল সুদীর্ঘ দেহ মুহূর্তেই তীরবেগে উঠিল দাঁড়ায়ে সন্মুখে আমার—ভস্মসুপ্ত অগ্নি যথা ঘৃতাহুতি পেয়ে, শিখারূপে উঠে উর্ধ্বে চক্ষের নিমেষে। শুধু ক্ষণেকের তরে চাহিলা আমার মুখপানে— রোষদৃষ্টি মিলাল পলকে; নাচিল অধরপ্রান্তে স্নিগ্ধ গুপ্ত কৌতুকের মৃদূহাস্যরেখা বুঝি সে বালক-মূর্তি হেরিয়া আমার। শিখে পুরুষের বিদ্যা, প'রে পুরুষের বেশ, পুরুষের সাথে থেকে, এতদিন ভুলে ছিনু যাহা, সেই মুখে চেয়ে, সেই আপনাতে-আপনি -অটল মূর্তি হেরি', সেই মুহূর্তেই জানিলাম মনে, নারী আমি । সেই মূহূর্তেই প্রথম দেখিনু সম্মুখে পুরুষ মোর।

মদন: সে শিক্ষা আমারি সুলক্ষণে। আমিই চেতন করে দিই একদিন জীবনের শুভ পুণ্যক্ষণে নারীরে হইতে নারী, পুরুষে পুরুষ। কী ঘটিল পরে?

চিত্রাঙ্গদা: কী ভাবিতেছিনু মনে নাই। দেখিনু চাহিয়া ধীরে চলি গেলা। ছি ছি, মূঢ়ে, না করিলি সম্ভাষণ, না শুধালি কথা, না চাহিলি ক্ষমাভিক্ষা, বর্বরের মত রহিলি দাঁড়ায়ে।

মদন: আমি মনসিজ; মানসের সকল রহস্য জানি।

চিত্রাঙ্গদা: মাথায় পড়িল ভেঙে লজ্জা বজ্ররূপে, তবু মোরে পারিল না শতধা করিতে -- তাঁর শেষ কথা কর্ণে বাজিতে লাগিল তপ্ত শূল: "ব্রক্ষ্মচারিব্রতধারী আমি, পতিযোগ্য নহি বরাঙ্গনে। " তুমি জান, মীনকেতু, কত ঋষি মুনি করিয়াছে বিসর্জন নারীপদতলে চিরার্জিত তপস্যার ফল। হে, অনঙ্গদেব, সব দম্ভ মোর এক দণ্ডে লয়েছ ছিনিয়ে—সব বিদ্যা সব বল করেছে পদানত। এখন তোমার বিদ্যা শিখাও আমায়, দাও মোরে অবলার বল, নিরস্ত্রের অস্ত্র যত।

মদন: আমি হব সহায় তোমার। অয়ি শুভে, বিশ্বজয়ী অর্জুনে জিনিয়া বন্দী করি আনি দিব সম্মুখে তোমার। রাজ্ঞী হয়ে দিয়ো তারে দণ্ড পুরস্কার যথা-ইচ্ছা। বিদ্রোহীরে করিয়ে শাসন।

চিত্রাঙ্গদা: জানি আমার এ প্রেম আমার ক্রন্দনের নহে; যে নারী নির্বাক ধৈর্যে চিরমর্মব্যথা নিশীথনয়নজলে করে পালন, দিবালোকে ঢেকে রাখে ম্লান হাসিতলে, আজন্মবিধবা, আমি সে রমনী নহি; আমার কামনা কভু হবে না নিষ্ফল। বড় ইচ্ছ হয়, যৌবনোচ্ছ্বাসে সমস্ত শরীর যদি দেখিতে দেখিতে অপুর্বপুলকভরে উঠে প্রস্ফুটিয়া লক্ষ্মীর চরণশায়ী পদ্মের মতন। হে বসন্ত, সে বাসনা পুরাও আমার শুধু দিনেকের তরে।

বসন্ত: শুধু একদিন নহে, বসন্তের পুষ্পশোভা এক বর্ষ ধরি ঘেরিয়া তোমার তণু রহিবে বিকশি।

অর্জুন: কাহারে হেরিনু? সে কি সত্য, কিম্বা মায়া। সে নামি ধীরে সরোবরতীরে কৌতূহলে দেখিল নিজ মুখচ্ছায়া; উঠিল চমকি। ক্ষণপরে মৃদুহাসি হেলাইয়া বাম বাহুখানি, হেলাভরে এলাইয়া দিলা কেশপাশ। ক্ষণপরে কী জানি কী দুখে, হাসি মিলাইল মুখে, ম্লান হল দুটি আঁখি। নিশ্বাস ফেলিয়া, ধীরে ধীরে চলে গেল; সোনার সায়াহ্ন যথা ম্লান মুখ করি আঁধার রজনীপানে ধায় মৃদুপদে। (দ্বার খুলিয়া) এ কী? সেই মূর্তি? শান্ত হও হৃদয়। কোনো ভয় নাই মোরে বরাননে! আমি ক্ষত্রকূলজাত; ভয়ভীত দুর্বলের ভয়হারী।

চিত্রাঙ্গদা : তুমি অতিথি আমার। এ মন্দির আমার আশ্রয়। নাহি জানি কেমন করিব অভ্যর্থনা, কী সত্কারে তোমারে তুষিব আমি।

অর্জুন: অতিথি সত্কার তব দরশনে, হে সুন্দরী! শিষ্টবাক্যসমুহ সৌভাগ্য মোর। যদি নাহি লহ অপরাধ, প্রশ্ন এক শুধাইতে চাহি, চিত্ত মোর কুতুহলী।

চিত্রাঙ্গদা : শুধাও নির্ভয়ে।

অর্জুন: কোন সুকঠোর ব্রত লাগি জনহীন দেবালয়ে হেন রুপরাশি হেলায় দিতেছ বিসর্জন, হতভাগ্য মর্ত্যজনে করিয়া বঞ্চিত?

চিত্রাঙ্গদা: গুপ্ত এক কামনা-সাধন-তরে একমনে করি শিবপূজা।

অর্জুন: হায়, কারে করিছে কামনা জগতের কামনার ধন। সুদর্শন, উদয়শিখর হতে অস্তাচলভূমি ভ্রমণ করেছি আমি; সপ্তদ্বীপমাঝে যেখানে যা কিছু আছে দুর্লভ সুন্দর, অচিন্ত্য মহান, সকলি দেখেছি চোখে; কী চাও, কাহারে চাও, যদি বল মোরে মোর কাছে পাইবে বারতা।

চিত্রাঙ্গদা: ত্রিভুবনে পরিচিত তিনি, আমি যারে চাহি।

অর্জুন: হেন নর কে আছে ধরায়। কার যশোরাশি অমরকাঙক্ষিত তব মনোরাজ্যমাঝে করিয়াছে অধিকার দুর্লভ আসন।

চিত্রাঙ্গদা: জন্ম তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতিকুলে, সর্বশ্রেষ্ঠ বীর।

অর্জুন: মিথ্যা খ্যাতি বেড়ে ওঠে মুখে মুখে কথায় কথায়, ক্ষণস্থায়ী বাষ্প যথা উষারে ছলনা করে ঢাকে যতক্ষণ সুর্য নাহি ওঠে। হে সরলে, মিথ্যাকে কোরো না উপাসনা, এ দুর্লভ সৌন্দর্যসম্পদে। কহ শুনি সর্বশ্রেষ্ঠ কোন বীর, ধরণীর সর্বশ্রেষ্ঠ কুলে?

চিত্রাঙ্গদা: পরকীর্তি-অসহিষ্ণু কে তুমি সন্ন্যাসী? কে না জানে কুরুবংশ এ ভূবনমাঝে রাজবংশচূড়া?

অর্জুন: কুরুবংশ?

চিত্রাঙ্গদা: সেই বংশে কে আছে অক্ষয়যশ বীরেন্দ্রকেশরী নাম শুনিয়াছ?

অর্জুন: বলো, শুনি তব মুখে।

চিত্রাঙ্গদা: অর্জুন, ভূবনবিজয়ী। সমস্ত জগত হতে সে অক্ষয় নাম করিয়া লুণ্ঠন, লুকায় রেখেছি যত্নে কুমারীহৃদয় পূর্ণ করি।

অর্জুন: অয়ি বরাঙ্গনে, যে দুর্লভ লোকে করেছ তাহারে স্থানদান, সেথা হতে আর তার কোরো না বিচ্যুত।

চিত্রাঙ্গদা: তুমি পার্থ?

অর্জুন: আমি পার্থ, দেবী, তোমার হৃদয়দ্বারে প্রেমার্ত অতিথি।

চিত্রাঙ্গদা: শুনেছি ব্রক্ষ্মচর্য পালিছে অর্জুন দ্বাদশ বর্ষব্যাপী। সেই বীর কামিনীরে করিছে কামনা ব্রত ভঙ্গ করি?

অর্জুন: তুমি ভাঙিয়াছ ব্রত মোর। চন্দ্র উঠি যেমন নিমেষে ভেঙে দেয় নিশীথের যোগনিদ্রা- অন্ধকার।

চিত্রাঙ্গদা: ধিক, পার্থ ধিক! কে আমি, কী আছে মোর, কী দেখেছ তুমি?

অর্জুন: চারি দিক হতে দেবের অঙ্গুলি যেন দেখায়ে দিতেছে মোরে, ওই তব অলোক- আলোক-মাঝে কীর্তিক্লিষ্ট জীবনের পূর্ণ নির্বাপণ।

চিত্রাঙ্গদা: হায় পার্থ, কোন দেবের ছলনা! যাও যাও ফিরে যাও। মিথ্যারে কোরো না উপাসনা। শৌর্য বীর্য মহত্ত্ব তোমার দিয়ো না মিথ্যার পদে। যাও ফিরে যাও!

(বসন্ত ও মদনের প্রবেশ)

চিত্রাঙ্গদা: হে অনঙ্গদেব, এ কী রূপহুতাশনে ঘিরেছ আমারে, দগ্ধ হই, দগ্ধ করে মারি।... যেন আমি রাজকন্যা নহি; যেন মোর নাই পূর্বপর; আমি যেন ধরাতলে একদিন উঠেছি ফুটিয়া, অরণ্যের পিতৃমাতৃহীন ফুল। শুনিলাম: প্রিয়ে, প্রিয়তমে! গম্ভীর আহবানে। কহিলাম: "লহ লহ, যাহা কিছু আছে সব লহ জীবনবল্লভ" দুইবাহু দিলাম বাড়ায়ে।

মদন: সংগীতে যেমন, ক্ষণিকের তানে, গুঞ্জরি, কাঁদিয়া ওঠে অন্তহীন কথা। তার পরে বলো।

চিত্রাঙ্গদা: আপনারে আরবার মনে পড়ে গেল, ছুটিয়া পালায়ে এনু, নব প্রভাতের শেফালিবির্কীর্ণতৃণ বনস্থলী দিয়ে, আপনার ছায়াত্রস্তা হরণীর মত। বিজনবিতানতলে বসি, করপুটে মুখ আবরিয়া, কাঁদিবারে চাহিলাম, এল না ক্রন্দন।

মদন: হায়, মানবনন্দিনী, স্বর্গের সুখের দিন স্বহস্তে ভাঙিয়া ধরণীর একরাত্রি পূর্ণ করি তাহে যত্নে ধরিলাম তব অধরসম্মুখে— শচীর প্রসাদসুধা, রতির চুম্বিত, নন্দনবনের গন্ধে মোদিত-মধুর -- তোমারে করানু পান, তবু এ ক্রন্দন!

চিত্রাঙ্গদা: কারে, দেব, করাইলে পান? কার তৃষা মিটাইলে? সে চুম্বন, সে প্রেমসংগম এখনো উঠিছে কাঁপি যে-অঙ্গ ব্যাপিয়া বীণার ঝংকার-সম। সে তো মোর নহে! বহুকাল সাধনায় একদণ্ড শুধু পাওয়া যায় প্রথম মিলন, সে মিলন কে লইল লুটি, আমারে বঞ্চিত করি। মীনকেতু, কোন মহারাক্ষসীরে দিয়াছ বাঁধিয়া অঙ্গসহচরী করি ছায়ার মতন—কী অভিসম্পাত!

মদন: কল্য নিশি ব্যর্থ গেছে তবে! শুধু, কুলের সম্মুখে এসে আশার তরণী, গেছে ফিরে ফিরে তরঙ্গ-আঘাতে?

চিত্রাঙ্গদা: আজ প্রাতে উঠে, নৈরাশ্যধিক্কারবেগে অন্তরে অন্তরে টুটিছে হৃদয়। মনে পড়িতেছে একে একে রজনীর কথা। বিদ্যুতবেদনাসহ হতেছে চেতনা, অন্তরবাহিরে মোর হয়েছে সতিন, আর তাহা নারিব ভুলিতে। সপত্নীরে স্বহস্তে সাজায়া সযত্নে, প্রতিদিন পাঠাইতে হবে, আমার আকাঙক্ষা-তীর্থ বাসরশয্যায়; হেন শাপ নরলোকে কে পেয়েছে আর? হে অতনু, বর তব ফিরে লও!

মদন: যদি ফিরে লই, ছলনার আবরণ খুলে ফেলে দিয়ে কাল প্রাতে কোন লাজে দাঁড়াইবে আসি পার্থের সম্মুখে?

চিত্রাঙ্গদা: সেও ভালো, এই ছদ্মরূপিণীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ আমি শতগুণে। সেই আপনারে করিব প্রকাশ, ভালো যদি নাই লাগে, ঘৃণাভরে চলে যান যদি, বুক ফেটে মরি যদি আমি, তবু আমি—আমি রব। সেও ভালো, ইন্দ্রসখা।

বসন্ত: শোনো মোর কথা। ফুলের ফুরায় যবে ফুটিবার কাজ তখন প্রকাশ পায় ফল। যথাকালে আপনি ঝরিয়া পড়ে যাবে তাপক্লিষ্ট লঘু লাবণ্যের দল; আপন গৌরবে তখন বাহির হবে; হেরিয়া তোমারে নতুন সৌভাগ্য বলি মানিবে ফাল্গুনি। যাও ফিরে যাও, বত্সে, যৌবন-উত্সবে।

চিত্রাঙ্গদা: কী দেখিছ বীর?

অর্জুন: দেখিতেছি পুষ্পবৃন্ত ধরি, কোমল অঙ্গুলিগুলি রচিতেছে মালা; নিপুণতা চারুতায় দুই বোনে মিলি, খেলা করিতেছে যেন সারা বেলা চঞ্চল উল্লাসে, অঙ্গুলির আগে আগে।

চিত্রাঙ্গদা: কী ভাবিছ?

অর্জুন: ভাবিতেছি অমনি সুন্দর করে ধরে, সরসিয়া ওই রাঙা পরশের রসে, প্রবাস দিবসগুলি গেঁথে গেঁথে প্রিয়ে অমনি রচিবে মালা; মাথায় পরিয়া অক্ষয় আনন্দ-হার গৃহে ফিরে যাব।

চিত্রাঙ্গদা: এ প্রেমের গৃহ আছে?

অর্জুন: গৃহ নাই?

চিত্রাঙ্গদা: নাই। গৃহে নিয়ে যাবে! বোলো না গৃহের কথা। গৃহ চির বরষের; নিত্য যাহা তাই গৃহে নিয়ে যেয়ো। অরণ্যের ফুল যবে শুকাইবে, গৃহে কোথা ফেলে দিবে তারে? অনাদরে পাষাণের মাঝে? তার চেয়ে অরণ্যের অন্তঃপুরে নিত্য নিত্য যেথা মরিছে অঙ্কুর, পড়িছে পল্লবরাশি, ঝরিছে কেশর, খসিছে কুসুমদল, ক্ষণিক জীবনগুলি ফুটিছে টুটিছে প্রতি পলে পলে, দিনান্তে আমার খেলা সাঙ্গ হলে ঝরিব সেথায়, কাননের শত শত সমাপ্ত সুখের সাথে। কোনো খেদ রহিবে না কারো মনে।

অর্জুন: এই শুধু?

চিত্রাঙ্গদা: শুধু এই। বীরবর, তাহে দুঃখ কেন। আলস্যের দিনে যাহা ভালো লেগেছিল, আলস্যের দিনে তাহা ফেলে শেষ করে। সুখেরে তাহার বেশি একদণ্ডকাল বাঁধিয়া রাখিলে, সুখ দুঃখ হয়ে ওঠে। যাহা আছে তাই লও, যতক্ষণ আছে ততক্ষণ রাখো। কামনার প্রাতঃকালে যতটুকু চেয়েছিলে, তৃপ্তির সন্ধ্যায় তার বেশি আশা করিয়ো না। দিন গেল। এই মালা পরো গলে। শ্রান্ত মোর তনু ওই তব বাহু-'পরে টেনে লও বীর। সন্ধি হোক অধরের সুখসম্মিলনে ক্ষান্ত করি মিথ্যা অসন্তোষ। বাহুবন্ধে এসো বন্দী করি দোঁহে দোঁহে, প্রণয়ের সুধাময় চিরপরাজয়ে।

অর্জুন: ওই শোনো প্রিয়তম, বনান্তের দূর লোকালয়ে আরতির শান্তিশঙখ উঠিল বাজিয়া। কোনো গৃহ নাই তব, প্রিয়ে, যে ভবনে কাঁদিছে বিরহে তব প্রিয়পরিজন? নিত্য স্নেহসেবা দিয়ে যে আনন্দপুরী রেখেছিলে সুধামগ্ন করে, যেথাকার প্রদীপ নিবায়ে দিয়ে এসেছ চলিয়া অরণ্যের মাঝে?

চিত্রাঙ্গদা: প্রশ্ন কেন? তবে কি আনন্দ মিটে গেছে? যা দেখিছ তাই আমি, আর কিছু নাই পরিচয়। প্রভাতে এই যে দুলিতেছে কিংশুকের একটি পল্লবপ্রান্তভাগে একটি শিশির, এর কোনো নামধাম আছে? এর কি শুধায় কেহ পরিচয়। তুমি যারে ভালোবাসিয়াছ, সে এমনি শিশিরের কণা, নামধামহীন।

মন্তব্য
মন্তব্য
লিঙ্ক