১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর মাও সে তুং এর চীন গণ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণার আওয়াজ তাত্ক্ষণিকভাবে থিয়ান আন মেন মহাচত্বরে সম্মিলিত জনসাধারণের তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ডুবে যায়। চীনের ইতিহাসে তখন থেকেই একটি নতুন অধ্যায়ের উন্মোচন হয়।
চীনের নতুন কর্তৃপক্ষ আর অতীতের সমাজ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। জনতা দেশের সব ক্ষমতার অধিকারী। দেশটি শোষণহীন ও বিভাজন মুক্ত এবং একসাথে সমৃদ্ধ হওয়ার সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যবস্তুর দিকে ধাবিত হয়। নতুন চীন প্রতিষ্ঠার পঞ্চম বছরে 'চীন গণ প্রজাতন্ত্রের সংবিধান' প্রকাশিত হয়। সংবিধান প্রকাশের আগে সারা দেশের সকল জনগণ এর খসড়া নিয়ে তিন মাসব্যাপী আলোচনা করে এবং মোট ১৩ লাখ ৮০ হাজার মতামত সংগৃহীত হয়। জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই খসড়া সংশোধনের পর সংবিধান প্রণয়ন ও প্রকাশিত হয়। বিখ্যাত আইনবিদ লি বু ইয়ুন এক সাক্ষাত্কার দেয়ার সময় বিশেষ করে এ সংবিধানের দুটি মৌলিক নীতির কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, 'আমাদের সংবিধান ১৯৫৪ সালের এ সংবিধান খুব কার্যকর। এর মধ্যে দুটি মৌলিক নীতি হচ্ছে আইনের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক আইন প্রণয়ন।'
প্রথম সংবিধানের সঙ্গে 'গণ কংগ্রেসের সংগঠন আইন', 'গণ আদালতের সংগঠন আইন'ও প্রকাশিত হয়। নয়া চীনের আইনী শাসনের প্রথম স্বর্ণ যুগ তখন থেকেই শুরু হয়। দেশের কর্তৃপক্ষ, ক্ষমতাসীন সংস্থা ও বিচার সংস্থা আইনানুসারে পরিচালিত হয়। তখন আইনের ওপর গবেষণা সবেমাত্র শুরু হলেও উত্সাহব্যঞ্জকভাবে তা সম্প্রসারিত হয়েছে। তখন মাত্র ২০ বছর বয়সী লি বু ইয়ুন বিখ্যাত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পেইচিং বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হয়ে আইন বিষয়ের ওপর গবেষণার সঙ্গে আজীবন সম্পর্ক গড়ে তুলেন। তিনি বলেন, 'আমরা মহা সাংস্কৃতিক বিপ্লব অতিক্রম করেছি। গোটা পার্টি ও সারা দেশের জনগণ গভীরভাবে আত্মজিজ্ঞাসায় নিবেদিত। তা হলো আইন না থাকলে হবে না। আইনানুসারে দেশ শাসন করা হচ্ছে ইতিহাসের নিয়ম ও মানবজাতির সভ্যতাও অগ্রগতির প্রয়োজনীয় চাহিদা।'
১৯৭৮ সাল হচ্ছে নয়া চীনের ইতিহাসে এক স্মরণীয় বছর। এ বছর থেকে শুরু সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের মাধ্যমে বর্তমান চীন শক্তিশালী দেশের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। চীন 'সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের উন্নয়ন এবং সমাজতান্ত্রিক আইন প্রশাসন গড়ে তোলা' এ দুটি বিষয় স্পষ্টভাবে উত্থাপন করেছে। 'ফৌজদারী মামলা আইন' ও 'ফৌজদারী আইন'সহ নানা ক্ষেত্রের আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে চীনের আইনের শাসন 'স্বর্ণ যুগে' প্রবেশ করে।
এখন সংবিধানকে কেন্দ্র করে গঠিত চীনের বিশিষ্ট সমাজতান্ত্রিক আইনী ব্যবস্থা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। 'আইনের সামনে সবাই সমান', 'আইনানুসারে দেশ শাসন করা', 'দেশের মানবাধিকার সম্মান ও তা রক্ষা করা', 'নাগরিকের সম্পত্তি লঙ্ঘন করা যায় না'সহ নানা মৌলিক নীতি সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। ১৯৯৯ সালে আইনানুসারে দেশকে শাসন করা চীনের মৌলিক নীতিতে পরিণত হয়েছে। আইনবিদ লি বু ইয়ুন গর্বিত কন্ঠে নিজের পেশাগত জীবনের সারসংকলন করে বলেছেন, 'আমার গবেষণার জীবনে দুটি কাজ উল্লেখযোগ্য। একটি হচ্ছে আইনানুসারে দেশ শাসন করার প্রস্তাব এবং আরেকটি হচ্ছে মানবাধিকারকে সমর্থন জানানো। এ দুটি বিষয় চীনের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।'
এখন চীনের 'সংবিধান' ও 'আইন প্রণয়নের আইন' এর মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ ও ভিন্ন পর্যায়ের বৈজ্ঞানিক আইন প্রণয়ন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। এখন চীনের সংবিধান ও এ সংশ্লিষ্ট আইন, বাণিজ্য আইন, ব্যবস্থাপনা আইন, অর্থনীতি আইন, সামাজিক আইন ও ফৌজদারী আইনসহ মোট ২৩১টি আইন প্রণীত হয়েছে। চীনের অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সমাজ জীবনের নানা ক্ষেত্রে আইনানুসারে চীনকে শাসনের মাত্রার অনেক উন্নতি হয়েছে।
আইনী শাসন ক্ষেত্রের অনেক সফলতার পরিমাপ করা যায় না। যেমন বর্তমানে চীনে আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬০০টিরও বেশি। আইন বিষয়ক গবেষণায়ও বিরাট অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। বিপুল পরিমান দেশি-বিদেশি পেশাগত বইও প্রকাশিত হয়েছে। এর পাশাপাশি আইন প্রণয়নের বৈজ্ঞানিক ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিও নিশ্চয়তা পেয়েছে। এখন আইনের খসড়া সমাজের কাছে মতামত সংগ্রহ করার মাধ্যমে প্রণয়ন নিয়মিত কর্মকান্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেবামূলক সরকার ও আইন ব্যবস্থার সংস্কারের মধ্য দিয়ে চীনের জনসাধারণ সত্যিকার অর্থেই আইনানুসারে দেশ শাসন এবং ন্যায়সংগত ও আইন অনুযায়ী বিচারের মান উন্নয়নের দিকটি অনুভব করেছেন। ক্ষমতার প্রতি আইনের তত্ত্বাবধানও জোরদার হয়েছে। লি বু ইয়ুন আরো বলেন, 'আইনী শাসন ও মানবাধিকার এ দুটি ধারণা এখন ব্যাপক জনসাধারণ ও ক্যাডারদের এক ধরনের চিন্তাভাবনার খোরাকে পরিণত হয়েছে। এ বিষয় আমি খুব সন্তুষ্টি বোধ করি।'
লি বু ইয়ুনের মতে, নয়া চীন প্রতিষ্ঠার ৬০ বছরে চীনাদের মানবাধিকার নির্ভরযোগ্য আইনের নিশ্চয়তা পেয়েছে। চীনে 'মানবাধিকারকে সম্মান ও নিশ্চিত করা এবং মানবাধিকার ব্রতের সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা'কে সমাজের প্রধান ধারা হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। তা ছাড়া, 'রাষ্ট্র মানবাধিকারকে সম্মান ও নিশ্চিত করবে, তা সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এখন চীনে মানবাধিকার নিশ্চয়তা সংক্রান্ত আইন আর অনুমোদিত আন্তর্জাতিক চুক্তির সংখ্যা ২৫০টিরও বেশি। বর্তমান চীনে নারী, বৃদ্ধবৃদ্ধা, বয়োজ্যেষ্ঠ, অপ্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি, প্রতিবন্ধী ও সংখ্যালঘু জাতিসহ বিশেষ গোষ্ঠীর অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার বিশেষ আইন আছে।
লি বু ইয়ুন চীনের আইনী শাসন কাজে অংশগ্রহণকারী ও প্রত্যক্ষদর্শীতে পরিণত হয়েছেন।
চীনের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন চিয়া পাও বলেছিলেন, 'গণতন্ত্র, আইনী শাসন, মুক্তি, মানবাধিকার, সমতা ও মানবজাতির প্রতি ভালোবাসা এ সব পুজিবাদী বৈশিষ্টের জিনিস নয়। এটা হচ্ছে সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় গোটা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত সভ্যতার সফলতা এবং মানবজাতির অভিন্ন মূল্যবোধ।'
আইনী শাসনের ধারণা চীনে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। লি বু ইউয়ুনসহ চীনের বহু আইনবিদ মনে করেন, চীনের আইনী শাসন ব্যবস্থায় নিজের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ ব্যাপক ও গভীরতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আইনী শাসনের বিশ্বায়নের প্রভাবও দিন দিন লক্ষণীয় হয়ে উঠবে। (ইয়ু কুয়াং ইউয়ে) |