নতুন যুগে ‘মূল ধারার’ চলচ্চিত্রের ঐতিহাসিক ভূমিকা
2021-07-29 13:11:50

নতুন যুগে ‘মূল ধারার’ চলচ্চিত্রের ঐতিহাসিক ভূমিকা_fororder_11

২০১৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ৭০তম বার্ষিকীতে ‘My People,My Country’, ‘The captain’ এবং ‘ The Climbers’- এই তিনটি চলচ্চিত্র জাতীয় দিবসের ছুটিতে প্রদর্শিত হয়।

 

২০২০ সালে মার্কিন আগ্রাসন প্রতিরোধে উত্তর কোরিয়াকে সাহায্যদানকারী সেচ্ছাসেবী সেনা পাঠানোর ৭০তম বার্ষিকীতে ‘The Sacrifice’ নামের চলচ্চিত্রটি দেখানো হয়। এরপর বক্সঅফিসে এর আয় দ্রুতগতিতে ১০০ কোটি ইউয়ান ছাড়িয়ে যায় এবং এতে মহামারীর পর প্রেক্ষাগৃহ পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া হয়।

 

২০২১ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার শততম বার্ষিকীতে ‘১৯২১’ ও ‘বিপ্লবী’ নামের মুভিটি প্রদর্শিত হয়।

দেখা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ‘মূল ধারার’ চলচ্চিত্র মাঝেমধ্যেই দর্শকরা দেখেছেন এবং তা চলচ্চিত্র বাজারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। এসব চলচ্চিত্র বক্সঅফিসে অনেক ভালো আয় করেছে।

 

এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, মূল ধারার চলচ্চিত্রগুলো আগের চেয়ে বেশি দর্শক স্বীকৃতি পেয়েছে। এসব চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দর্শকেরা সুগভীর দেশপ্রেমের অনুভূতি এবং জাতীয় গর্বের বিষয়টি অনুভব করতে পারেন। অন্যদিকে মূলধারার চলচ্চিত্রগুলো ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। আগে এসব চলচ্চিত্র শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রচারে ভূমিকা পালন করতো। বর্তমানে মূলধারার চলচ্চিত্র বাণিজ্যিক বিপণনের পথে অগ্রসর হচ্ছে। এর বিষয়বস্তু ও থিম প্রকাশের পদ্ধতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে।

 

ঐতিহ্যবাহী গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার ওপর ভিত্তি করে তৈরি চলচ্চিত্র থেকে, বর্তমানে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের উপাদানের সমন্বয়ে নির্মিত ‘নতুন মূলধারার’ চলচ্চিত্রে নানা পরিবর্তন ও উন্নয়ন ঘটেছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের চলচ্চিত্রের সংস্কার ও সৃজনশীলতা কীভাবে হবে? চীনের কি রকম চলচ্চিত্র প্রয়োজন? এসব প্রশ্নের জবাব নিয়ে সাজিয়েছি আমাদের আজকের অনুষ্ঠান।

 

হয়তো অনেকেই জিজ্ঞাস করতে পারেন যে, মূল সুর বা মূল ধারা মানে কি? এই শব্দ কোথা থেকে এসেছে?

‘মূল সুর’ শব্দটি আসলেই সংগীত-সম্পর্কিত শব্দ। শুরুতে মূল সুরের চলচ্চিত্রের বিষয়গুলো খুব সীমিত ছিলো। সে সময় ডোমেস্টিক চলচ্চিত্র শুরু হয়। ১৯৭৯ সালে সভ্যতা ও শিল্প মহলের যৌথ প্রতিনিধি সম্মেলনে তেং সিও পিং বলেন, সভ্যতা ও শিল্প রচনায় সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা দিয়ে জনগণকে শিক্ষা দেওয়া এবং উত্সাহ দেওয়া উচিত্। পুরোপুরিভাবে মানবজাতির বুদ্ধি দিয়ে প্রাণবন্ত ও ইতিবাচক চলচ্চিত্র তৈরি করা উচিত্। তখন থেকে চলচ্চিত্রের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো জানায়, তেং সিও পিংয়ের কথা আমাদের চলচ্চিত্র তৈরির মূল সুরে পরিণত হওয়া উচিত্।

 

১৯৮৭ সালে দেশব্যাপী ফিচার ফিল্ম তৈরির সম্মেলনে চলচ্চিত্র ব্যুরো বহুবার ‘মূল সুর লালন করা এবং বৈচিত্র্যে অবিচল থাকার’ শ্লোগান উত্থাপন করে। তখন থেকে ‘মূল সুর’ এই শব্দটি চীনের চলচ্চিত্র রচনার ক্ষেত্রে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ‘মূল সুর’ শব্দটি চলচ্চিত্র খাতে উত্থাপনের সময় থেকে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন সময় এর অর্থ পরিবর্তিত হয়েছে।

 

চীনা চলচ্চিত্র উন্নয়নের শুরুতে ‘মূল সুর’-এর ধারণা ছিলো না। তখনকার সমাজ স্থিতিশীল ছিলো না বলে চলচ্চিত্র গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কণ্ঠ প্রকাশের চ্যানেল হয়ে ওঠে। তাই তখনকার গল্পগুলো প্রধানত ঐতিহাসিক ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়। যেমন, বামপন্থি চলচ্চিত্র, জাপান-বিরোধী প্রতিরোধ যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তৈরি চলচ্চিত্র এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্মিত চলচ্চিত্র প্রভৃতি।

 

গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর চলচ্চিত্র শিল্প নতুন এক পর্যায়ে প্রবেশ করে। সেই সময় বিপ্লবের ইতিহাস ও বাস্তবতা তুলে ধরে ব্যাপক শিল্পকর্ম দর্শকদের সামনে হাজির হয়। তবে, তখনকার চলচ্চিত্র তৈরিতে প্রধানত রাজনৈতিক প্রচারণাকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। ১৯৫৬ সালে চেয়ারম্যান মাও চ্যে তোং ‘শত ফুল ফুটতে দাও’ চিন্তাধারা উত্থাপন করেন। চলচ্চিত্র ব্যুরো এ চিন্তাধারার ভিত্তিতে সংস্কার চালায় এবং ইতিবাচক সাফল্য অর্জন করে। চলচ্চিত্রের বার্ষিক সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধির পাশাপাশি, চলচ্চিত্রের মতাদর্শগত ও শৈল্পিক মান বৃদ্ধি পায়। তবে, ১৯৬৬ সালে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পাশাপাশি চলচ্চিত্র খাতে আরেকবার অচলাবস্থা সৃষ্টি  হয়।

 

৮০’র দশকের পর ‘মূল সুর’ এই শব্দ আবারও ফিরে আসে। তখনকার উদ্দেশ্য ছিল বুর্জোয়া শ্রেণির উদারনীতি ঠেকানো। তাই সে সময় চলচ্চিত্র রচনার প্রধান লক্ষ্য ছিল স্বদেশের মহান সংস্কারের সঙ্গে সমন্বয় ঘটানো এবং চলচ্চিত্র ব্যক্তিদের মূল্যবোধ জাগ্রত করা। সে সময় মূল সুরের চলচ্চিত্রের জন্য নানা চেষ্টা করা হতো। দর্শকদের কাছে সুপরিচিত ইতিহাসবিষয়ক ফিল্ম ছাড়াও, আরো থাকতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের ঘিরে তৈরি বায়োপিক চলচ্চিত্র এবং সাধারণ পারিবারিক মূল্যবোধ ও সামাজিক নীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ের চলচ্চিত্র।

 

একবিংশ শতাব্দীতে চলচ্চিত্র বাণিজ্যিক জগতে পা রাখে। একের পর এক বেসরকারি চলচ্চিত্র কোম্পানি উঠে আসে। মূল সুরের চলচ্চিত্র অবশেষে রাজনৈতিক দাসত্বের বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। বাণিজ্যিক বাজারকে প্রধান অবস্থান হিসেবে চলচ্চিত্র উন্নয়নের নতুন সুযোগ সামনে আসে।

 

যদিও মূল সুরের মুভিটি পরিপূর্ণভাবে রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের মতো নয়, তবে এর রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য উপেক্ষা করা যায় না। জাতীয় আদর্শ তুলে ধরে প্রয়োজনীয় সময় সরকারি বিভাগের প্রচার মুখপাত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় এমন চলচ্চিত্র। তবে আগের সুগভীর রাজনৈতিক বিষয়ের চলচ্চিত্রের তুলনায় বর্তমানে মূল সুরের চলচ্চিত্রগুলো আরো বেশি বাজারায়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে অনেকে ‘মূল সুর’ শব্দটি ছেড়ে দিয়ে ‘নতুন ধারা’ শব্দটি ব্যবহার করা শুরু করেন। আধুনিক যুগে ‘নতুন ধারার’ চলচ্চিত্র আসলেই জনগণের পছন্দের, মূল মূল্যবোধ, যুগের বৈশিষ্ট্য ও ভাবমূর্তি তুলে ধরে এসব চলচ্চিত্র। আগের ‘মূল সুরের’ চলচ্চিত্রের তুলনায় বর্তমান ‘নতুন ধারার’ চলচ্চিত্রে নানা পরিবর্তন ঘটেছে।

 

প্রথমত, ‘মূল ধারার’ চলচ্চিত্রের বিষয় আরো বৈচিত্র্যময় ও বিস্তৃত হয়ে উঠেছে। ‘মূল ধারার’ চলচ্চিত্রের বিষয় যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সীমাবদ্ধ না, বরং সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ও উজ্জ্বল সাফল্যের বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে চলচ্চিত্র তৈরি হয়। যেমন, বন্যা প্রতিরোধ করা, ভূমিকম্প, দুর্যোগ থেকে উদ্ধার, মহামারী প্রতিরোধ, অলিম্পিক, ক্রীড়া ও শিল্প সৃষ্টি প্রভৃতি। এসব বিষয় ‘নতুন মূল ধারার’ চলচ্চিত্রের প্রধান গল্পে পরিণত হয়।

 

দ্বিতীয়ত, বর্তমানে ‘মূল ধারার’ চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট ও দৃষ্টিভঙ্গিও পরিবর্তিত হয়েছে। আগে ‘মূল সুরের’ চলচ্চিত্রগুলোতে প্রধানত দেশ ও জাতির ওপর ফোকাস করা হতো। সেগুলোতে সামষ্টিক দৃষ্টি থেকে ইতিহাস পর্যন্ত দেখা যেতো। তবে, বর্তমানে ‘মূল ধারার’ চলচ্চিত্রে ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হতে দেখা যায়। এতে মানুষ ও যুগের সম্পর্ক ফুটে ওঠে।

 

তৃতীয়ত, মূল ধারার চলচ্চিত্রে অনেক বড় বড় তারকাদের দেখা যায়। তাদের অংশগ্রহণে মূল ধারার চলচ্চিত্রগুলো অনেক দর্শক- বিশেষ করে তরুণ দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে তারকাদের জন্য মূল ধারার চলচ্চিত্রে কাজ করা গৌরবের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। মহান তারকাদের যোগদানের পাশাপাশি, মূল ধারার চলচ্চিত্র অনেক নেপথ্যে-প্রযোজকের দৃষ্টিও আকর্ষণ করেছে।

 

বর্তমানে ‘মূল ধারার’ চলচ্চিত্রগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বক্সঅফিসের ফলাফল বা মুভি’র গুণগত মান- যাই হোক, আগের তুলনায় তা ব্যাপকভাবে উন্নত হয়েছে। এখন পর্যন্ত দেশীয় বক্সঅফিসের লিডারবোর্ডে প্রথম দশটি চলচ্চিত্রের মধ্যে ৫টিই হলো মূল সুরের চলচ্চিত্র। বলা যায়, বর্তমানে ‘মূল ধারার’ চলচ্চিত্রগুলো আগের রাজনৈতিক প্রচারণার ট্যাগ থেকে বেরিয়ে এসেছে। এসব চলচ্চিত্রে দর্শক স্বীকৃতি ছাড়াও, তাদের শক্তিশালী বাণিজ্যের সম্ভাবনাও দেখা যায়।

 

দেশের সংশ্লিষ্ট নীতির সমর্থনে ‘মূল ধারার’ চলচ্চিত্র উন্নত করা উচিত্। তা ছাড়া, এ ধরনের চলচ্চিত্রে অব্যাহতভাবে সংস্কার ও সৃজনশীলতা চালানো উচিত্। তাই আশা করা যায়, ভবিষ্যতে বিভিন্ন পক্ষের যৌথ প্রচেষ্টায় মূল ধারার চলচ্চিত্রের বিশাল উন্নয়নের সুযোগ থাকবে।

 

জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য উপায়ে গুরুগম্ভীর বিষয় তুলে ধরা হবে ভবিষ্যতে মূল ধারার চলচ্চিত্র উন্নয়নের প্রধান দিক। যেমন, যুদ্ধবিষয়ক চলচ্চিত্রে কেবল রক্তপাতকেই গুরুত্ব দেওয়া উচিত্ নয়, বরং যুদ্ধবিরোধী চিন্তাধারা এবং সুন্দর জীবনের প্রতি আকাঙ্ক্ষার অনুভূতি প্রকাশ করতে হবে। আরো সার্বিক ও বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে একজন বীর বা বিপ্লবীর ভাবমূর্তি গঠন করা উচিত্।

(লিলি/তৌহিদ/শুয়ে)