টানা ১৫ বছর ধরে চীনের খবর প্রচার করছেন মার্কিন সাংবাদিক এরিক নিলসন
2021-03-10 15:57:30

টানা ১৫ বছর ধরে চীনের খবর প্রচার করছেন মার্কিন সাংবাদিক এরিক নিলসন_fororder_0311

টানা ১৫ বছর ধরে চীনের খবর প্রচার করছেন মার্কিন সাংবাদিক এরিক নিলসন_fororder_03111

এরিক নিলসন টানা ১৫ বছর ধরে চীনের খবর প্রচার করে আসছেন। তিনি ১৫ বার চীনের সিছুয়ান প্রদেশের ওয়েনছুয়ান ভূমিকম্প-কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। আট বছর ধরে  তিনি চীনের বিভিন্ন দরিদ্র অঞ্চলে গিয়েছেন। তিনি ছিংহাই-তিব্বত মালভূমির পশুপালকদের সঙ্গে একসাথে থেকেছেন, খেয়েছেন। চীনা নেট ব্যবহারকারীরা তাকে ‘মার্কিন ভাই’ বলে ডাকেন।

 

এরিক বলেন, চীন যেন একটি পেঁয়াজের মতো। এক স্তর খোসার পর আরেকটি স্তর আছে। সারা জীবন ধরে চীন সম্পর্কে জানতে চাইলেও- তা যেন শেষ হয় না।

মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার সময় তিনি যুদ্ধের প্রতিবেদক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। ২০০৫ সালে এরিক চায়না ডেইলি পত্রিকায় ইন্টার্নশিপের সুযোগ পান। সেই সময় তিনি বুঝতে পারেন নি যে, চীন সম্পর্কে তার জানাশোনা খুব কম।

তিনি বলেন, যখন আমি চীনে পৌঁছাই, তখন একেবারে নতুন একটি জগত আমার চোখে পড়ে; যা আমার কল্পনার চেয়ে একদম ভিন্ন।

আগে এরিক ভেবেছিলেন, তিনি চীনে এক বছর থেকে চলে যাবেন। তবে তিনি জানতেন না যে, এক বছর পর তিনি চায়না ডেইলি পত্রিকায় কাজ করা শুরু করবেন।

 

২০০৮ সালে চীনের ওয়েনছুয়ানে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়। এরিক ১৫ বার ভূমিকম্প-কবলিত এলাকায় যান। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ভূমিকম্প-কবলিত এলাকায় তিনি দীর্ঘ ৮ মাস অবস্থান করেছিলেন।

এখনও তিনি ভূমিকম্প-কবলিত এলাকার নানা ভাঙা অবস্থার কথা মনে রেখেছেন। তিনি বলেন, আগে তাঁর দেখা অন্যান্য জায়গার চেয়ে ভূমিকম্প-কবলিত এলাকা একেবারে ভিন্ন রকম ছিল। সবখানে ধ্বংসযজ্ঞের দৃশ্য চোখে পড়ত!

 

তবে, তিনি শেষবার যখন সেখানে যান সেখানকার দৃশ্য দেখে তিনি হতবাক হয়ে পড়েন। পুনর্নির্মিত বাড়িঘর ভূমিকম্পের আগের চেয়ে আরো উন্নত ও সুসম্পূর্ণ হয়েছে।

তিনি বলেন, আগে আমি জনৈক ব্যক্তির সাক্ষাত্কার নিয়েছিলাম। তিনি জানিয়েছিলেন যে, ভূমিকম্প বিরাট প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং এর ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় প্রায় ১০ বছর সময় লাগে। তবে চীন মাত্র পাঁচ বছরে ভূমিকম্পোত্তর যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করেছে।

 

তিনি বলেন, চীন কীভাবে এ রকম বিস্ময়কর কাজ করেছে? এ প্রশ্নের উত্তর সম্পূর্ণ অনুধাবন  করা বিশ্বের জন্য অসম্ভব। আমি ভাবছি, চীন ছাড়া আর কোনো দেশ কি এমন বিশাল প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর এত দ্রুত পুনর্নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছে?

ওয়েনছুয়ানের অবস্থা প্রচার করার সময় এরিক আরো কয়েকজনের সঙ্গে পরিচিত হন এবং একটি সেচ্ছাসেবক দল গঠন করেন। তারা একসঙ্গে ভূমিকম্প-কবলিত এলাকার জন্য কাজ করেন।

 

২০১১ সালে ছিংহাই থেকে একজন উপাচার্য এরিককে বলেন, তাদের স্কুলে বিদ্যুত্ সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। তবে, ১০ হাজার ইউয়ান মূল্যের দুটি সৌর প্যানেল এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। উপাচার্য এরিককে জিজ্ঞাস করেন যে, তিনি তাদের সাহায্য করতে পারবেন কিনা? এরিক কোনো দ্বিধা না করেই রাজি হয়ে যান। তিনি মনে করেন, একটি সৌর প্যানেল কিনে দিতে পারলে হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে তা আলো দিতে পারে। তাকে এ কাজ করতেই হবে বলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন।

 

তিনি স্বীকার করেন, আমাদের বিশ্বকে আরো সুন্দর করে তোলার আস্থা তিনি ওয়েনছুয়ান ভূমিকম্পোত্তর পুনর্নির্মাণ কাজ থেকে পেয়েছেন। তিনি বলেন, সত্যি কথা বলতে, আমি বিশ্বাস করি, আমাদের এই বিশ্ব আরো সুন্দর হয়ে উঠবে। ভূমিকম্পের পর ওয়েনছুয়ানের অবস্থা ছিল দারুণ ভয়াবহ। এখন সেখানকার অবস্থা অনেক ভালো হয়েছে। স্বচক্ষে না দেখলে তা বিশ্বাস করা যায় না। সেই সময় থেকেই আমি মূলত চীনকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি।

 

২০১১ সালের জুলাই মাসে বিমান ও ট্রেন দিয়ে মালভূমি ও পর্বতাঞ্চল পার হয়ে এরিক ছিংহাই প্রদেশের ছুমালাই জেলার ইয়েকে গ্রামে যান। সেখানে তিনি স্থানীয় শিক্ষকদের সঙ্গে যৌথভাবে সৌর প্যানেল স্থাপন করেন। তারপর উজ্জ্বল আলোয় প্রথমবার শিক্ষার্থীদের তাঁবুতে যাওয়ার পর সবাই উল্লসিত হয়ে ওঠে।

‘সূর্য উদয়—মার্কিন ভাইয়ের চোখে চীনের দারিদ্র্যবিমোচনের বিস্ময়’ নামে এরিক তার নতুন বইটিতে লিখেন,

“শিক্ষার্থীদের তাঁবুগুলো প্রথমবারের মতো আলোকিত হওয়ার পর সব শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উল্লাস করেন এবং আমার মনও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।”

 

তারপর এরিক ইউশুছু মালাই জেলার সব স্কুলের জন্য সৌর প্যানেলের ব্যবস্থা করেন এবং হাজার হাজার শিক্ষার্থীর ক্লাসরুম ও ছাত্রাবাসে বিদ্যুত্ সরবরাহ করা শুরু হয়।

সে সময় এক ছাত্রীর দেওয়া একটি উপহার এরিকের মনে গভীর দাগ কাটে। এই উপহারটি ছিল হাতে তৈরি স্লিং শট। ছাত্রী তাকে বলেন, এই স্লিং শট ছাড়া আপনাকে দেওয়ার মতো আমার কাছে আর কিছু নেই। আমি নিজেই এই স্লিং শট তৈরি করেছি।

২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এরিক ও তার স্বেচ্ছাসেবক দল বহুবার বেইজিং ও ছিংহাইয়ে যাতায়াত করেছেন। এ সময় নীরবে-নিভৃতে বিশাল পরিবর্তনও ঘটেছে।

 

২০১৩ সাল থেকে চীন সরকার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের দারিদ্র্যমোচন পরিকল্পনা শুরু করে। ইয়াংসি নদী, হোয়াংহো নদী ও লানছান নদীর উত্সমুখ হিসেবে ছিংহাই প্রদেশের ছুমালাই জেলা হলো দারিদ্র্যমোচনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। সেখানকার বিভিন্ন স্কুলের বিশাল পরিবর্তন দেখে এরিক মনে মনে ভাবেন যে, তিনি মনে হয় ভুল জায়গায় এসে পৌঁছেছেন!

 

এরিক বলেন, চীন সত্যিই দারিদ্র্যবিমোচনে অগ্রাধিকার দিয়েছে। একটি বিষয় অন্য দেশের মানুষের পক্ষে বোঝা একটু কঠিন। তা হলো- মহামারী শুরু হলেও চীন দারিদ্র্যবিমোচনের কাজ ছেড়ে দেয় নি।

অবশেষে এরিক নিজের ইচ্ছা পরিবর্তন করেন। তিনি যুদ্ধাঞ্চলের প্রতিবেদক হন নি; বরং তিনি চীনের দারিদ্র্যবিমোচন খাতের অংশগ্রহণকারী, সাক্ষী ও সংরক্ষণকারী হয়েছেন।

 

সাংবাদিকতার কাজে এক দশকে এরিক চীনের মুলভূভাগের প্রতিটি প্রদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন।

সাক্ষাত্কার দেওয়ার সময় এরিক বলেন, চীন প্রসঙ্গে কিছু পশ্চিমা গণমাধ্যমের প্রচারণা সঠিক নয়। চীনে আসার সুযোগ পেয়ে তিনি গর্ব বোধ করেন এবং ফলে তিনি প্রকৃত চীনকে জানতে পেরেছেন।

চীনে না আসলে চীন সম্পর্কে আমার জানাশোনা এত গভীর হতে পারত না। চীন সম্পর্কে আমার জানার কোনো সুযোগ ছিলো না। কারণ, চীন নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যমের খবরাখবর ছিল ভুলে ভরা।

 

তিনি বলেন, আসল চীন সম্পর্কে জানতে চাইলে চীনের যে কোনো অংশে এবং চীনা জনগণের মধ্যে যেতে হবে। চীনা জনগণের মুখোমুখি হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে থাকলে আমার চীন সম্পর্কে জানার সুযোগ হতো না।

বর্তমানে চীনে এরিকের পনেরো বছর পূর্ণ হয়েছে। তিনি ‘সূর্য উদয়—মার্কিন ভাইয়ের চোখে চীনের দারিদ্র্যবিমোচনের বিস্ময়’ নামে একটি বই লিখেছেন। এ বইয়ের পাণ্ডুলিপি রচনার ফি এরিক সম্পূর্ণ ছাইহাইয়ের পশুপালকদের পরিবারে দান করবেন।

 

এরিক চীন সরকারের দেওয়া ‘মৈত্রী পুরস্কার’ পেয়েছেন। তিনি  চীনা জনগণের সঙ্গে গভীর অনুভূতি বিনিময়ের সেতু সৃষ্টি করেছেন।

এরিক বলেন, তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ছিংহাই-তিব্বত মালভূমিতে গিয়েছেন। তিনি ছাড়া, পরিবারের অন্য সদস্যদের ‘অতি উচ্চতার সমস্যার’ কারণে গুরুতর অসুস্থতা দেখা দেয়। তিনি মজা করে বলেন, হয়তো পূর্বজন্মে তিনি ছিংহাই-তিব্বত মালভূমিতে চড়ে বেড়ানো কোনো ইয়াক ছিলেন, তাই তার কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

 

চীনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মাইক্রোব্লগে অনেকেই এরিকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, সত্যিকার এক চীনকে তুলে ধরার জন্য এরিককে ধন্যবাদ। এসব প্রশংসার জবাবে এরিক বলেন, তার তুলে ধরা গল্প শুধু চীন-বিষয়ক গল্পই নয়, বরং মানবজাতির গল্পও বটে।

(লিলি/তৌহিদ/শুয়ে)