মহাকাশের ‘ঘুড়ি’ নিয়ন্ত্রণকারী যুবক-যুবতীদের গল্প
2021-03-01 17:39:33

সম্প্রতি চীনের রাষ্ট্রীয় মহাকাশ ব্যুরোর সূত্রে জানা গেছে, ‘থিয়ানওয়েন ১’ অনুসন্ধানকারী যান মঙ্গলের ছবি পাঠিয়েছে ও ১০ ফেব্রুয়ারি তা মঙ্গলের কক্ষপথে প্রবেশ করেছে। চীনের প্রথম মঙ্গল অনুসন্ধানকারী কৃত্রিম উপগ্রহ এটি। আসলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন মহাকাশগবেষণায় অনেক সাফল্য অর্জন করেছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলেও এ খাতে অনেক অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। বিশেষ করে, বেইজিং এরোস্পেস ফ্লাইট কন্ট্রোল সেন্টার সুশৃঙ্খলভাবে চালু হয়েছে। চন্দ্রযান, মঙ্গলযান, রকেট, মহাকাশযান, কৃত্রিম উপগ্রহ ভূমি থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং ডেটা সংগ্রহ করার সাথে সাথে সেগুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিতে হয়। মহাকাশ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের কর্মীদের জন্য এ যেন মহাকাশে বিভিন্ন সাইজের ‘ঘুড়ি’ ওড়ানো। এখানকার যুবক কর্মীরা সবসময় মনোযোগ দিয়ে নিজেদের হাতে সেই সূতা ধরেন ও ‘ঘুড়ি’ ওড়ান। আজকের অনুষ্ঠানে এখানকার যুবকদের গল্প শেয়ার করবো।

বেইজিং এরোস্পেস ফ্লাইট কন্ট্রোল সেন্টারের নারী সমন্বয়ীকর্মী

২০২০ সালের ২৩ জুলাই চীন প্রথমবারের মতো মঙ্গল অনুসন্ধানকারী ‘থিয়ানওয়েন ১’ নিক্ষেপ করে। ৪ মাস পর ‘ছাং এ্য ৫’ নভোযান চাঁদের নমুনা সংগ্র করে। এ দুটি কার্যক্রমে বেইজিং এরোস্পেস ফ্লাইট কন্ট্রোল সেন্টারের সমন্বয়কর্মী ছিলেন পাও শুও, যিনি একজন নারী। আসলে মহাকাশ সমন্বয়কর্মীর কাজ অনেক কঠিন। তাদের শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকতে হয়, থাকতে হয় সমন্বয়ের সামর্থ্য। তাই বিভিন্ন কার্যক্রমের আগে সুন্দরভাবে প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পন্ন করতে হয় তাকে এবং মনোযোগ দিয়ে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়। ১৯৯২ সালে জন্মগ্রহণ করা নারী পাও শুও মাত্র ৩ বছর চাকরি করছেন। তবে সেরা সমন্বয়-দক্ষতা রয়েছে তার। তিনি সহকর্মীদের ব্যাপক স্বীকৃতি ও প্রশংসা পেয়েছেন।

সমন্বয়ের কাজ করার আগে তিনি মহাকাশযানের ফাইনাল নির্দেশনা দেওয়ার দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। আগের কর্ম-অভিজ্ঞতা স্মরণ করে পাও বলেন, ‘মহাকাশযানের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত তাকে সংগ্রহ করতে হতো। তবে বর্তমানে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সমন্বয় করা আমাদের মূল কাজ। তাই মহাকাশযান সম্পর্কে আরও গভীর ও বিস্তারিত জানতে হয়।’

‘থিয়ানওয়েন ১’ নিয়ন্ত্রণ করা পাও’র প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এ কাজ ছিল উত্তেজনাময় ও আনন্দায়ক। তিনি উত্সাহের সঙ্গে এ কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন। সেটা শেষ করে মাত্র কয়েক মাস পর ‘ছাংএ্য ৫’ চন্দ্রযানের সমন্বয়ের কাজের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন তিনি। ‘ছাংএ্য’-এর কাজ চাঁদ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনা। সারা বিশ্বের মনোযোগ ছিল এদিকে। তখন পাও’র প্রধান দায়িত্ব চাঁদ থেকে নমুনা সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় সমন্বয়কারীর ভুমিকা পালন করা। অর্থাত চাঁদে অবতরণের ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সংশ্লিষ্ট নমুনা সংগ্রহকাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে তিনি প্রয়জোনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন করা। এ সম্পর্কে পাও বলেন, ‘যদিও চাঁদ অনুসন্ধানকারীর জন্য তা ছিল সহজ একটি নমুনা সংগ্রহের ভঙ্গি, তবে এর পিছনে পৃথিবী ও চাঁদের মধ্যে ৩.৮ লাখ কিলোমিটার দূরের যোগাযোগব্যবস্থা কাজ করেছে। চাঁদে নমুনা সংগ্রহ করা সর্বশেষ কার্যক্রম। নমুনা সংগ্রহ করার পর সঠিকভাবে তা রক্ষা করা সবচেয়ে কঠিন ও চ্যালেঞ্জের কাজ। কারণ, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টানা কয়েকবার যান্ত্রিক বাহু দিয়ে চাঁদের উপর থেকে পরিকল্পিত এলাকায় চাঁদের মাটি সংগ্রহ করতে হয়েছে। তারপর নমুনাগুলো অবতরণকারীর স্টোরেজ ডিভাইসে রাখতে হয়েছে, যাতে চাঁদ থেকে নমুনা পৃথিবীতে আনা সম্ভব হয়।’

৪৮ ঘন্টার সমন্বয়ের কাজ কতো গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন ব্যাপার, তা পাও’র জন্য স্পষ্ট। তিনি এ দুই দিনের মধ্যে না-ঘুমানোর প্রস্তুতিও নিয়েছেন। ছাংএ্য নিক্ষেপ করার এক মাস আগে তিনি প্রতিদিন মাত্র ৪ ঘন্টা বিশ্রাম নিতেন। বাকি সময় পড়াশোনা ও অন্যান্য কাজ করার মাধ্যমে মন পরিষ্কার রাখার চেষ্টা করতেন তিনি। কারণ ঘুমের সময় বেশি হলে টানা ৪৮ ঘন্টা মাথা পরিষ্কার রাখা তার পক্ষে সম্ভব হবে না।

একজন সেরা ‘মহাকাশযান নিয়ন্ত্রক’ হিসেবে শক্তিশালী শরীর প্রয়োজন। ছুটির দিনে তিনি নিয়মিত দৌড়ান ও তাইকান্দো চর্চা করেন। এমন চর্চার মাধ্যমে শরীরের সহ্যক্ষমতা বাড়ে এবং বড় চাপে অভ্যস্ত হয়।

২০২০ সালের পয়লা ডিসেম্বর ‘ছাংএ্য ৫’ চাঁদে অবতরণের পর তিনি যাত্রিক বাহু’র বিভিন্ন ভঙ্গির নির্দেশনা দিয়েছেন, হাজারটিরও বেশি নির্দেশনার মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহের কাজ সম্পন্ন করেছেন। গোটা দলের চমত্কার সহযোগিতায় নমুনা সংগ্রহ হয়েছে। মাত্র ৩৭ মিনিটে নমুনার সংগ্রহ ও স্টোরেজের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। কয়েক মাস আগে পৃথিবীতে এ প্রক্রিয়া চর্চা করতে প্রায় অর্ধেক দিন লেগেছিল। অবশেষে সবার যৌথ প্রয়াসে চাঁদের নমুনা সংগ্রহের সময় পরিকল্পনার চেয়ে ৭ ঘন্টা কম হয়েছে।

টানা ৩০ ঘন্টা সমন্বয়ের কাজ করেছেন, কিছু খেতে পারেননি, বিশ্রাম নিতে পারেননি, ঘুমাতে পারেননি। অন্যান্য সহকর্মীরা পাওকে বিশ্রাম নিতে বলেছেন। কিন্তু তিনি তাদের প্রস্তাব গ্রহণ করেননি। তিনি টানা নিজের কাজ করে গেছেন।

চাঁদের চালক চাং খুয়ান

সাধারণ মানুষের জন্য রাস্তায় গাড়ি চালানো স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে চাং খুয়ানকে চাঁদে ‘ইয়ুথু’ অনুসন্ধানকারী যন্ত্র চালাতে হয়। তবে তিনি নিজে চাঁদে যাননি।  তিনি বরং পৃথিবী থেকেই এ অনুসন্ধানকারী পর্যবেক্ষকযন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করেন। ‘ছাংএ্য ৪’ চাঁদ অনুসন্ধান কার্যক্রমে তিনি ‘ইয়ুথু ২’ যন্ত্রের চালকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন চাং। ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি বেইজিংয়ের মহাকাশযান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে বসে ‘ছাংএ্য ৪’ অনুসন্ধানকারীর সফল অবতরণে আনন্দে চিত্কার করে ওঠেন। হঠাত কম্পিউটারের স্ক্রিনে সফ্টওয়ারের সতর্ক তথ্য দেখা যায়। তখন তিনি অনেক উত্তেজনাপূর্ণ ও নিশ্বাসও নিতে ভুলে গেছেন। কারণ সমস্যা থাকলে ‘ইয়ুথু ২’-এর সঙ্গে অবতরণকারী যন্ত্র বিচ্ছিন্ন হবে না এবং গোটা প্রক্রিয়াটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তখন প্রযুক্তিকর্মীদের জরুরি মিটিং বসে। সবার আলোচনায় ‘ইয়ুথু ২’ যাত্রার পদ্ধতি সমন্বয় করা হয় এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে যাত্রা স্বাভাবিক হয়ে যায়। তবে চাং খুয়ান উত্তেজনার কারণে ঠাণ্ডার মধ্যেও ঘামতে থাকেন।

একজন সেরা চালক হিসেবে ‘ইয়ুথু’র কাঠামো ও সামর্থ্য জানার সাথে সাথে ভৌগোলিক অবস্থানের পর্যবেক্ষণ ও যাত্রার মধ্যে নিয়ন্ত্রণসহ বিভিন্ন জ্ঞান জানতে হয়। সেটি চালানোর জন্য সংশ্লিষ্ট মেরামতকাজও ঠিকঠাক জানতে হয় কয়েক বছরের গবেষণার মাধ্যমে তাঁর কর্মীদল যন্ত্রপাতির সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ শেখে।

যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াশোনা করতেন, তখন ছাত্র চাং খুয়ান টেলিভিশনে ‘ছাংএ্য ১’ নিক্ষেপ কার্যক্রম দেখেছেন। তখন থেকেই তিনি মহাকাশযান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেন। তবে স্নাতক হওয়ার পর যখন কেন্দ্রে ভর্তি হন, শুরুর দিকে শুধু সরঞ্জাম তথ্যায়ন ব্যবস্থার গবেষণা কাজে অংশ নেন। এটা চাংয়ের পরিকল্পনামতো হয়নি।  তখন তিনি প্রতিদিন গবেষণার দক্ষতা ও জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করতেন। ৩ বছর পর অবশেষে ‘ছাংএ্য ৪’ নিক্ষেপ কার্যক্রমে অংশ নেন তিনি এবং পরে ‘ছাংএ্য ৫’-এর রিমোট নিয়ন্ত্রণ ডিজাইনের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এখন ‘ছাংএ্য ৪’ এবং ‘ইয়ুথু ২’ চাঁদে অনুসন্ধানকাজ চালাচ্ছে। এর মধ্যে নতুন কার্যক্রমে অংশ নেওয়া নির্দেশনা পান তিনি। যদিও অন্য কাজের জন্য অনেক ব্যস্ত তিনি, তবে নিয়মিতভাবে ‘ইয়ুথু ২’ ও ‘ছাংএ্য ৪’-এর খোঁজখবর নিতে হয় তাকে। ‘ইয়ুথু’ পরিচালনা করতে করতে তিনি অনেক জ্ঞান অর্জন করেছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন সহনশীলতা ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।

৩৫ বছর বয়সী লি লিয়াং মহাকাশযান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে টানা ৮ বছর ধরে কাজ করছেন। একজন পর্যবেক্ষক কর্মী থেকে নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের দুই বিভাগের পরিচালকে পরিণত হয়েছেন তিনি। ২০১৪ সালে অপটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে মার্স্টাস ডিগ্রী পেয়ে তিনি কেন্দ্রে যোগ দেন। তখন শেনচৌ ১০ নভোযানের যাত্রা মাত্র শেষ এবং ছাংএ্য ৩ নিক্ষেপের কাজা মাত্র শুরু হয়েছে। তখন তিনি আনন্দমনে কার্যক্রমে অংশ নেন। তবে সংশ্লিষ্ট অনেক তথ্য তার কাছে ছিল অজানা। তিনি সিনিয়ার কর্মীদের কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করেন। তবে সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। কে তাকে শেখাবে? তিনি শূন্য থেকে শুরু করেন। পড়াশোনা করে অনেককিছু শেখেন। অফিসে, হোস্টেলে যেখানে তিনি সময় পেয়েছেন, বই নিয়ে বসে গেছেন পড়তে। বিশেষজ্ঞদের বিশ্রামের সময় তিনি তাদের কাছে গেছেন প্রশ্ন নিয়ে। পরিশ্রমের সাফল্যও পেয়েছেন তিনি। কয়েক বছরের প্রচেষ্টায় তাঁর পেশাগত দক্ষতা ও জ্ঞান অনেক বেড়েছে এবং গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার সুযোগও তিনি পেয়েছেন।

‘থিয়ানচৌ ১’ পরিবহন নভোযান লি লিয়াংয়ের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট। মহাকাশে নভোযানের সঠিক যাত্রা নিশ্চিতে পরীক্ষাগারে বার বার পরীক্ষা করতে হয়। তখন তিনি কর্মীদের সাথে মহাকাশে ‘থিয়ানচৌ ১’-এর বিভিন্ন যাত্রার দৃশ্যের মডেল তৈরি করেন। যে কোনো সমস্যা বা ভুল থাকার সম্ভাবনা চেক করেন। এ কার্যক্রম যেন তাঁর আপন বাচ্চার মতো। যদি বাচ্চা বড় হয়, তাহলে সে নিজেই দৌড়াদৌড়ি করতে পারে। ছোট থাকলে সবসময় যত্ন নিতে হয়। লি এমন উদাহরণ দিয়ে তাঁর গবেষণাকাজ বর্ণনা করেন।

মহাকাশের কাজ করার জন্য আবেগ ও স্থিতিশীল মন প্রয়োজন। রকেট ও নভোযান নিক্ষেপ করার জন্য শুধু আবেগ যথেষ্ঠ নয়। এ খাতে গবেষণায় সফলতা অর্জন করতে চাইলে প্রতিদিন পরিশ্রম করতে হয়। এ সম্পর্কে লি বলেন, “আমার ছোটবেলা থেকে মহাকাশের প্রতি অনেক আগ্রহ ছিল। তাই মহাকাশ নিয়ে কাজ করা আমার জন্য সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার।”

‘থিয়ানওয়েন ১’ অনুসন্ধানকারী যন্ত্র মঙ্গলে পৌঁছে গেছে। ২০২১ সালে অজানা ও রহস্যময় মহাকাশে চীনের মহাকাশ কর্মীরা আরও বেশি নতুন রেকর্ড ও ইতিহাস সৃষ্টি করবেন। অদূর ভবিষ্যতে মহাকাশের আরও তথ্য জানতে সক্ষম বলে বিশ্ব।(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)