সর্বস্তরে বাংলা চালু: ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছরের অরণ্যে-রোদন
2021-02-21 19:32:47

করোনাক্রান্তির মধ্যেও শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় জাতিস্মরণ করছে বায়ান্নের ভাষা শহীদদের। একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তাদের সামরিক সচিবরা। পরে শ্রদ্ধা জানান মুক্তিযোদ্ধা, বিদেশী কূটনীতিক, তিনবাহিনীর প্রধানরা, বিভিন্ন রাজনৈতিক, পেশাজীবী ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ। সবার কণ্ঠে এক দাবি সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন। তবে ভাষা আন্দোলনের প্রায় ৭০ বছর পর কী অবস্থায় রয়েছে সর্বস্তরে বাংলা প্রচলের দাবি। ভাষাসংগ্রামী এবং বিশ্লেষকরা বলছেন, সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের এতদিনের দাবিটি অরণ্যে রোদনেই পর্যবসিত হয়েছে।

দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভুল নীতিতে দেশভাগের পর বাঙালির ওপর প্রথম আঘাতটা এসেছিল ভাষার ওপর। ঘোষণা আসে উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তাতেই আগুন জ্বলে ওঠে বাঙালির চেতনায়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে গড়ে ওঠে তীব্র আন্দোলন। বায়ান্নের ২১শে ফেব্রুয়ারি রক্তে ভেসে যায় ঢাকা মেডিকেলের সামনের রাস্তা। শহীদ হন রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ নাম না জানা আরো অনেকে। ভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে ইতিহাস গড়েন তারা। বাংলা পায় রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা।

কিন্তু শুধু রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি নয়, সর্বস্তরে বাংলা চালু হবে- এটা ছিল ভাষাশহীদ ও ভাষা সংগ্রামীদের প্রাণের আকুতি। ভাষাসংগ্রামীসহ সংস্কৃতিকর্মীরা গত সাতদশক ধরেই দাবি জানিয়ে আসছেন সর্বস্তরের বাংলা চালুর। পাকিস্তান আমলে সেটা না হলেও একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বস্তরে যথাযোগ্য মর্যাদায় বাংলা চালু হবে- এটা খুবই প্রত্যাশিত ছিল।

কিন্তু স্বাধীনতার এতদিনেও রাষ্ট্রের সব স্তরে এখনো চালু হয়নি বাংলা। উচ্চ আদালতে বাংলা চালুর কথা বলা হলেও পরিভাষা সমস্যাসহ নানা যুক্তিতে এখনো তা কার্যকর হয়নি। দু’একজন বিচারপতি মাঝেমধ্যে বাংলায় রায় দিয়ে খবরের শিরোনাম হন- অগ্রগতি এ পর্যন্ত। যদিও প্রধানমন্ত্রী ইংরেজি রায় অনুবাদের জন্য পেশাদার অনুবাদক নিয়োগের কথা বলেছেন। অবশ্য এবারের শহীদ দিবসে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন জানিয়েছেন, অচিরেই উচ্চ আদালতে বাংলায় রায় লেখা শুরু হবে।

সর্বস্তরে বাংলা চালুর কথা না হয় থাক। যেখানে যেখানে বাংলার ব্যবহার হচ্ছে তার অবস্থাও শোচনীয়। ভুল বানান, বিকৃত উচ্চারণ, ইংরেজি বর্ণে বাংলা লেখা, কিছু এফএম বেতার, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলার যথেচ্ছ ব্যবহার- প্রায় সর্বত্র বাংলা ভাষার এক বিশৃঙ্খল অবস্থা।

ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিককে ব্যথিত করে বাংলা ভাষা নিয়ে এ নৈরাজ্য। তিনি মনে করেন স্বাধীনতার পর সরকারগুলো সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনে যথেষ্ট উদ্যোগ

নেয়নি। সমাজের একটা সুবিধাবাদী এবং ইংরেজি শিক্ষিত গোষ্ঠী চায় না সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন হোক। সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন সম্ভব হয়নি বলে দেশে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থাও চালু করা সম্ভব হয়নি। যে কারণে সমন্বিত একটা শিক্ষাব্যবস্থাও গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ভাষা শহীদদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করতে বাংলাকে যথাযথ মর্যাদা দেয়ার তাগিদ দিলেন নবতিপর এই ভাষাসংগ্রামী।

বাঙালির ভাষা আন্দোলনকে স্বীকৃতি দিয়ে জাতিসংঘ একে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করেছে। বিশ্বব্যাপী আজ স্মরণ করা হয় বাঙালির ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাসকে। তবে বিশ্লেষকরা মনে করেন নিজের ভাষাকে যথাযথ গুরুত্ব না দিয়ে আন্তর্জতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন অর্থবহ হবে না। নিজভাষায় দক্ষতা ও গুরুত্ব ছাড়া ভিনদেশি ভাষায় ভালো দখল অর্জন সম্ভব নয়।

ভাষার প্রতি মমতা ও ভালোবাসা তৈরিতে পরিবারের একটা বড় ভূমিকা আছে বলে মনে করেন ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক। পরিবার এবং স্কুলে নবীন শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাসের কথা। এতে করে ভাষার প্রতি তাদের মমতা তৈরি হবে। সনিষ্ঠ সাধনায় দখল লাভ করতে হবে নিজ মাতৃভাষায়। আর একে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয়ার প্রধান দায়িত্বটি রাষ্ট্রের বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

মাহমুদ হাশিম, ঢাকা থেকে।