‘ফাস্ট’ রক্ষাকারী যুবকদের গল্প
2021-02-10 18:53:54

আজকের আসরে চীনের কুইচৌ প্রদেশের পিংথাং জেলায় অবস্থিত বিশ্বের বৃহত্তম একক অ্যাপারচার রেডিও টেলিস্কোপ (ফাস্ট) রক্ষাকারী যুব গবেষক ও কর্মীদের গল্প তুলে ধরবো।

২০২১ সালে ফাস্ট চালু করার এক বছর হয়েছে। পাঁচ শ মিটার ব্যাসের এ টেলিস্কোপটি বিশ্বের এ ধরনের বৃহত্তম টেলিস্কোপ। গত এক বছরে এর মাধ্যমে ২৪০টি পালসার শনাক্ত করা হয়েছে, যা মানবজাতির মহাকাশ গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ফাস্টের পুরো নাম ‘একক অ্যাপারচার রেডিও টেলিস্কোপ’, যা চীনের কুইচৌ প্রদেশের পিংথাং জেলার তাভোতাংতে অবস্থিত। সেখানে দূরবর্তী পাহাড়াঞ্চলের কোলে এর অবস্থান। আশেপাশে লোকসংখ্যা খুবই কম। আকাশ থেকে দেখলে একে একটি বিশালাকৃতির চোখের মতো মনে হয়। তাই চীনারা একে ডাকে ‘থিয়ানইয়ান’ বলে। এর অর্থ হল ‘আকাশের চোখ’। এখান থেকে জেলায় যেতে প্রায় দুই ঘন্টা গাড়ি চালাতে হয়। যদিও স্থানীয় পরিবেশ একটু দুর্বল, তবে অনেক যুব-গবেষকদের আকর্ষণ করে থাকে এ স্থান। এসব গবেষকের গড় বয়স ৩৪ বছর। পর্যবেক্ষণ-ঘাঁটিতে শতাধিক কর্মীর মধ্যে ৩৫ বছর বয়সের চেয়ে কম এমন কর্মী ৭৭ শতাংশ।

‘ফাস্ট’ রক্ষাকারী যুবকদের গল্প_fororder_fast1

২০১১ সালে চীনের কুইচৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগ থেকে স্নাতক হন ছাত্রী হুয়াং মেং লিন। তখন তাকে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তার সামনে তখন প্রশ্ন ছিল: স্নাতক হওয়ার পর কি চাকরি করবেন, নাকি অন্যকিছু করবেন? তখন ফাস্টের নির্মাণকাজ চলছে। স্নাতক হওয়ার পর ফাস্টের একজন কর্মী হিসেবে কাজ করা সুযোগ পান তিনি। তখন হুয়াং মাস্টার্স ডিগ্রীর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তবে ফাস্ট সম্পর্কে জানার পর তাঁর অনেক আগ্রহ হয়। একই বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি বেইজিংয়ে গিয়ে মাস্টার্স ডিগ্রীর পড়াশোনা শুরু করেন।

২০১৪ সালের জুলাই মাসে স্নাতক হওয়ার পর ফাস্টে যোগ দেন মিস হুয়াং। পড়াশোনার সময়ও নিয়মিতভাবে ফাস্ট পর্যবেক্ষণ-ঘাঁটির নির্মাণকাজের ওপর তার মনোযোগ ছিল। এখন তিনি ফাস্টের তথ্যকেন্দ্রে কাজ করেন। প্রতিদিন বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করতে হয় তাকে। দিনের পর দিন তাকে একই কাজ করতে হয়। কিন্তু তিনি বোর ফিল করেন না। কারণ তাঁর দৃষ্টিতে এসব তথ্য-উপাত্ত অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। পাহাড়াঞ্চলে প্রতিদিন মহাশূন্য অনুসন্ধানে রত থাকার কাজটাকে তিনি রোম্যান্টিকও মনে করেন।

‘ফাস্ট’ রক্ষাকারী যুবকদের গল্প_fororder_fast3

পর্যবেক্ষণকাজের সময় তিনি তথ্য রক্ষার ওপর গুরুত্ব দেন। এ সম্পর্কে হুয়াং বলেন, বিদ্যুত্ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, ইন্টারনেট যোগাযোগও অবিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। তা ছাড়া, কম্পিউটারে যথেষ্ট র‍্যামও থাকতে হবে, যাতে ফাস্টের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত না হয়। তথ্য সবচেয়ে মূল্যবান। বিজ্ঞানীদের গবেষণার মূল উপাদান তথ্য। তাই তথ্যে কোনো ভুল থাকা যাবে না।

প্রতিবার পর্যবেক্ষণ শেষ করে তথ্য সংগ্রহ করার পর কোনো সমস্যা নেই নিশ্চিত হবার পর তিনি শান্ত হয়ে বসতে পারেন। এমন কাজ অন্যদের জন্য বোরিং হতে পারে, তবে মিস হুয়াং এ নিয়ে সন্তুষ্ট। টেলিভিশনে ফাস্টের ভিডিও দেখে হুয়াং’র বাবা-মা অনেক গর্ব বোধ করেন। তাঁকে ফোন করে সবসময় সমর্থনের কথা বলেন তারা। এ সম্পর্কে হুয়াং বলেন, ‘আমার পরিবারের সমর্থন আমার কাজের বড় চালিকাশক্তি।’

২০১৮ সালে মিস হুয়াং কুইচৌতে তাঁর প্রেম খুঁজে পান। ফাস্টের একজন সহকর্মীকে তিনি বিয়ে করেন। এখানকার চাকরি, কর্ম-পরিবেশ ও মানুষ তার সবই ভালো লাগে। তাই ফাস্ট ত্যাগ করার কথা তিনি ভাবেন না।

অ্যাকুয়েটর অপারেশন এবং রক্ষণাবেক্ষণ ইঞ্জিনিয়ার লেই চেং ফাস্টের বিভিন্ন তথ্য মনে রাখেন। যেমন, ৬৬৭০টি কেবল জাল ও ৪৪৫০টি প্রতিবিম্বিত পৃষ্ঠ নিয়ে গঠিত ফাস্ট কিভাবে নমনীয়ভাবে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ সংগ্রহ করে,  ইত্যাদি। ২০১০ সালে লেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে যোগ দেন। বেতন ভালো এবং জীবনমানও ভালো ছিল। তবে তিনি ফাস্টে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নেন। কারণ তাঁর মনে এমন বিজ্ঞানসম্মত কাজ করা আরো বেশি তাত্পর্যপূর্ণ।

ফাস্টের একজন প্রকৌশলী হন তিনি। এখানকার টেলিস্কোপ দেখে তার অনেক নতুন জ্ঞান জানার সুযোগ হয়েছে। এটা তার কাছে অতি আকর্ষণীয় ব্যাপার।

২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফাস্ট প্রকল্পের মূল অংশের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ হয়। একই বছরে আরো বেশি জ্ঞান অর্জনে চীনের বিজ্ঞান একাডেমির মাস্টার্স ডিগ্রীর পড়াশোনায় বেইজিংয়ে যান লেই। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে তিনি আবার ফাস্টে ফিরে আসেন এবং অনুঘটকের সংশ্লিষ্ট সমন্বয়ী ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে অংশ নেন।

কিছু কিছু অনুঘটক ক্লিফের পাশে স্থাপিত হয়েছে। তাই রক্ষণাবেক্ষণের সময় মাটিতে নামিয়ে এক হাত দিয়ে তা ঠিক করতে হয়। একটি অনুঘটক রক্ষা করতে দু’এক ঘন্টা সময় লাগে। মাঝে মাঝে অর্ধেক দিনও যথেষ্ট নয়। এ সম্পর্কে প্রকৌশলী লেই বলেন, মেরামতের সময় অবশ্যই বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার করতে হয়। তবে তা ফাস্টের পর্যবেক্ষণ-কাজে সমস্যা সৃষ্টি করে। তাই যত দ্রুত সম্ভব মেরামতকাজ শেষ করতে হয়।

চীনের জাতীয় পর্যায়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অবকাঠামো ব্যবস্থাপনা হিসেবে ফাস্টের অনেক কাজ উদ্ভাবনীমূলক। তাই প্রতিবারের অনুসন্ধানে অনেক সাহস ও প্রচেষ্টা দরকার। ফাস্টের সাথে বড় ও শক্তিশালী হওয়া জরুরি।

কুইচৌ প্রদেশের তাভোতাংয়ে অনেক যুবক প্রকৌশলী রয়েছেন। মিস সুন ছুন তাঁদের মধ্যে একজন। তিনি ফাস্টের পরিমাপ ও নিয়ন্ত্রণ প্রকৌশলী। ২০১২ সালে স্নাতক হওয়ার পর ফাস্টের নির্মাণকাজে যোগ দেন তিনি। প্রতিবিম্বিত পৃষ্ঠে ‘কেবল’ স্থাপন করা তাঁর প্রধান কাজ। কারণ কেবল টেলিস্কোপের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ সংযোগ স্থানে বিদ্যুত্ ও তথ্য সরবরাহ্ করে থাকে। এগুলো যেন ফাস্টের রক্তনালীর মতো।

২০১৪ সালের মার্চ মাস থেকে মিস সুন ফাস্টের নির্মাণ সাইটে কাজ শুরু করেন। তখনন এখানে কোনো দ্রুতগতির রাস্তা চালু হয়নি। প্রতিদিন সকালে কুইইয়াং শহর থেকে গাড়ি চালিয়ে বিকেলে তাভোতাংতে পৌঁছতে সক্ষম হতেন তিনি। সেই জন্য তাভোতাংয়ের অস্থায়ী বাড়িতে প্রায় আড়াই বছর ছিলেন সুন।

কেবল লাইন অধিকাংশই মাটির নিচে স্থাপন করতে হয়। মাঝে মাঝে মাটিতে শক্ত পাহাড় থাকে। তাই মাটির উপরে তখন তা স্থাপন করতে হয়। তখন প্রতিদিনের মূল কাজ পাহাড়াঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে কেবল স্থাপনের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন সুন। সেই কাজ একজন নারীর জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জের।

কঠোর নির্মাণ মানদন্ডের ফলে অসাধারণ ফলাফল অর্জিত হয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ফাস্টের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে এবং এ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ পরিষেবার সময় ৫২০০ ঘন্টারও বেশি, যা পরিকল্পিত লক্ষ্যমাত্রার প্রায় দ্বিগুণ।

২০১৫ সালে ফাস্টের একজন প্রকৌশলীর  সাথে বিয়ে হয় সুনের। দুই বছর পর তাঁদের বাচ্চাও জন্মগ্রহণ করেছে। এখন তিনি পরিবারের সাথে ফাস্টের নির্মাণ-ঘাঁটিতে আছেন। তিনি প্রতিদিন মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণের কাজ করেন। এখন কাজের চাপ আগের চেয়ে অনেক কমে গেছে। ফাস্টের কাজ সম্পর্কে সুন বলেন, “এটাই আমার বাড়ি। আমার জন্মস্থান কুইচৌতে। তাই আমার জন্মস্থান ও দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে নিজের অবদান রাখতে চাই।”

ফাস্টের কথা বলতে গেলে এর প্রধান নির্মাণকারী ডক্টর নান রেন তুংয়ের কথা উল্লেখ করতে হবে। এখানকার অনেক যুবক তাঁকে বেশ শ্রদ্ধা করেন। গত ২০ বছর ধরে জনাব নান ফাস্টের নির্মাণকাজে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। চীনের বিভিন্ন এলাকার ভৌগোলিক অবস্থান পরিদর্শন করার পর তিনি অবশেষে তাভোতাংকে এ টেলিস্কোপ স্থাপনের জন্য বেছে নেন। এ প্রকল্পের বাজেট সংগ্রহে অনেক চেষ্টা করেন তিনি এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশ নিয়ে ফাস্টের  জন্য তহবিল সংগ্রহ করেনভ এ সম্পর্কে কর্মী থাং চিয়া চিয়া বলেন, ২০১৮ সালে টেলিভিশনে জনাব নানের ছবি দেখে তিনি অনেক মুগ্ধ হন। ডক্টর নানের মতো দেশের উন্নয়নে নিজের অবদান রাখতে চান তিনি।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে থাং ফাস্টে যোগদান করে বিদ্যুত্ সরবরাহ নিশ্চিত করার কাজের দায়িত্ব পালন করা শুরু করেন। ফাস্টের স্বাভাবিক পরিচালনা নিশ্চিতে ব্যাকআপ বিদ্যুত্ সরবরাহ ব্যবস্থাও থাকতে হবে। দুই বিদ্যুত্ লাইনের স্থাপন কম সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে, যাতে ফাস্টের পর্যবেক্ষণ সময় নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। তাঁরা গবেষণার মাধ্যমে চূড়ান্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। প্রতিদিন ভোর ৬টা থেকে শুরু এবং রাত দুইটা- তিনটা পর্যন্ত, টানা ৫ দিনের মধ্যে এ কাজ সম্পন্ন করা হয়।

ছুটির দিনে থাং চিয়া চিয়া ও সহকর্মীদের নিয়ে শরীরচর্চা করেন এবং মাঝে মাঝে গাড়ি চালিয়ে ২০ কিলোমিটার দূরে জেলার রেস্তোরাঁয় একসাথে খাবার খান। যদিও অধিকাংশ সময় পাহাড়াঞ্চলে কাটান, তবে তিনি কখনো উদাস হন না। বরং মনোযোগ দিয়ে কাজ করে থাকেন। ফাস্টের কাজ সম্পর্কে থাং বলেন, “এখন আমি অনেক ব্যস্ত। আরো অনেক কাজ করতে হবে। শুধু নতুন অনুসন্ধান নতুন বিষয় জানাতে পারে।”

আগামী পয়লা এপ্রিল ফাস্টের দরজা বিশ্বের জন্য খোলা হবে। এটি মানবজাতির মহাশূন্য অনুসন্ধানে সক্রিয় ভুমিকা পালন করবে এবং অজানাকে জানতে মানবজাতিকে সাহায্য করবে, এমন আশা সকলের।

(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)