প্রামাণ্যচিত্রের পরিচালক তাকেউচি রিও
2021-01-21 10:19:58

প্রামাণ্যচিত্রের পরিচালক তাকেউচি রিও_fororder_0121

প্রামাণ্যচিত্রের পরিচালক তাকেউচি রিও_fororder_01211

প্রামাণ্যচিত্রের পরিচালক তাকেউচি রিও_fororder_01212

প্রামাণ্যচিত্রের পরিচালক তাকেউচি রিও_fororder_01213

প্রামাণ্যচিত্রের পরিচালক তাকেউচি রিও_fororder_01214

বিশ্বজুড়ে নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ দেখা যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন আগের চেয়ে বেশি সিরিয়াস। দেশগুলো সাধ্যমতো মহামারী মোকাবিলার চেষ্টা করছে। আমরা বিশ্বাস করি, মহামারীর এই প্রকোপ কমে আসবে এবং একসময় বিশ্ব মহামারীর কবল থেকে রেহাই পাবে।  চীনেও ইদানিং বিভিন্ন স্থানে আক্রান্তের সংখ্যা নতুন করে বাড়ছে, যদিও তা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম। চীন বরাবরের মতোই নিজের মহামারী প্রতিরোধক ব্যবস্থার ওপর  আস্থাশীল। মহামারীর প্রথম ঢেউ সফলভাবে মোকাবিলার পর চীনে যে অধিকাংশ সামাজিক ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপ শুরু হয়েছিল, তা এখনও মোটামুটি সুশৃঙ্খলভাবে চলছে। শুধু যেসব স্থানে নতুন করে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হচ্ছে, সেসব স্থানে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা জোরদার করা হচ্ছে। কোনো কোনো স্থানে সাময়িক লকডাউনও ঘোষণা করা হচ্ছে। তবে, সার্বিকভাবে চীনে মহামারী নিয়ন্ত্রণে আছে বললে বাড়িয়ে বলা হবে না।

‘বিশ্বে একমাত্র চীনই পারে মহামারীর মোকাবিলায় এতো দ্রুত ও কার্যকর প্রতিক্রিয়া দেখাতে।’ না, এ কথা আমরা বলিনি, বরং একজন বিদেশি পরিচালক নিজের প্রামাণ্যচিত্রে এভাবে চীনের প্রশংসা করেছেন। তার নাম তাকেউচি রিও। আজকের ‘আলোছায়া’য় আমরা তাকেউচি রিও নামের এই পরিচালকের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো।  

ছয় মাস আগে তিনি ‘Long Time No See, Wuhan’ শীর্ষক একটি প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এতে উহান শহরে মহামারীর বয়ে আনা ক্ষয়ক্ষতি ও কষ্ট তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি, মহামারীর ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা উহানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথাও প্রকাশ করা হয়।

ছয় মাস পর তিনি আবার উহান শহরে ফিরে যান। ‘Long Time No See, Wuhan’ নামের এ প্রামাণ্যচিত্রে লকডাউন থেকে মুক্তি পাওয়া উহান শহরের বর্তমান চালচিত্র তুলে ধরা হয়। তার নতুন প্রামাণ্যচিত্রে মহামারী-উত্তর চীনের ওপর দৃষ্টি দেওয়া হয়। তার এই নতুন প্রামাণ্যচিত্রের নাম হলো ‘China’s Post-Pandemic Era: Winning Against All Odds’। এ প্রামাণ্যচিত্রে বিদেশিদের মনে জাগা অনেক প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি। এসব প্রশ্নের মধ্যে সর্বাধিক উচ্চারিত প্রশ্ন হচ্ছে: চীন কীভাবে এতো দ্রুত পুনরুদ্ধারের পথে ফিরে আসতে পেরেছে?

তিনি বলেন, ‘বিগত এক বছরে আমি চীনের মহামারী প্রসঙ্গে বিদেশি গণমাধ্যমের বৈষম্যমূলক প্রতিবেদন ও চীনের ওপর আরোপিত তাদের বিভিন্ন অপবাদ দেখেছি। চীন কিভাবে মহামারী থেকে মুক্তি পেয়েছে? স্বচোখে না-দেখলে তা বোঝা মুশকিল।’  

পরিচালক তাকেউচি রিও বলেন, কেউ কেউ চীনকে বিশ্বাস করে না এবং তাদের কথা আমলে নেয় না। তাকেউচি রিও একজন জাপানি। তিনি চীনের নানচিং শহরে বাস করেন। তিনি বস্তুনিষ্ঠভাবে চীনে মহামারীর বিরুদ্ধে চীনাদের সংগ্রামের প্রক্রিয়া রেকর্ড করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি মহামারী প্রতিরোধের ক্ষেত্রে চীনের অভিজ্ঞতা ও শক্তি জাপানসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভাগাভাগিও করতে চান। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে চীন সাফল্যের সঙ্গে মহামারী প্রতিরোধ করতে এবং অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে পারে। আর এটা ১৪০ কোটি চীনা মানুষের একতা ও পরিশ্রমের ফসল। কেবল সরকারের শক্তির ওপর নির্ভর করে এমন সাফল্য আশা করা যায় না। রঙিন চশমা পরে চীনকে দেখা হবে না বলে আমি আশা করি।’

‘China’s Post-Pandemic Era: Winning Against All Odds’ নামের প্রামাণ্যচিত্রের মোট ৪টি অধ্যায় আছে। প্রত্যেক অধ্যায়ের সময় লম্বা না হলেও এর বিষয় অনেক বৈচিত্র্যময়। প্রথম অধ্যায়ের নাম হলো ‘মানববিহীন’। এতে চীনে নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর সময় কীভাবে রোবট বা রোবট-প্রযুক্তি কাজে লাগানো হয়েছে, তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যেমন, সুচৌ শহরের ‘চালকবিহীন বাস’, হাংচৌ শহরে ‘মানববিহীন এক্সপ্রেস ডেলিভারি যান’ ইত্যাদির কথা তার প্রামাণ্যচিত্রে উঠে এসেছে।  

দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম হলো ‘জাতীয় লাইভ প্রচার’। এতে অনলাইনে লাইভ প্রচারের মাধ্যমে পণ্য বিক্রির প্রবণতা তুলে ধরা হয়েছে। এই অধ্যায়ে তাকেউচি রিও চেচিয়াং প্রদেশের ইউ জেলায় তার পরিদর্শনের চিত্র তুলে ধরেন। ‘জাতীয় লাইভ প্রচারের’ জাঁকজমকপূর্ণ দৃশ্য দেখে তিনি অবাক হয়ে যান।  

‘নভেল করোনাভাইরাস দূরীকরণ’ নামের তৃতীয় অধ্যায়ে তাকেউচি রিও বিভিন্ন সংস্থার কাজের ওপর আলোকপাত করেন। তিনি এতে দেখান যে, মহামারী প্রতিরোধে চীনের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালিয়েছে।

‘জিরো ইনফেকশনের উহান শহর’ নামের চতুর্থ অধ্যায়ে তাকেউচি রিও আবার উহান শহরে ফিরে যান। লেনোভো কোম্পানির উহান শাখা কোম্পানির মহামারী প্রতিরোধের পদক্ষেপ বিস্তারিতভাবে দর্শকদের সামনে হাজির করেন তিনি। মহামারী প্রতিরোধের ক্ষেত্রে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তুলে ধরা হয় এ অধ্যায়ে।

‘China’s Post-Pandemic Era: Winning Against All Odds’ নামের তাকেউচি রিও’র এ প্রামাণ্যচিত্র ৩ জানুয়ারি জাপানের সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী ইয়াহু ওয়েবসাইটের মূলপাতায় পোস্ট করা হয়। পোস্টটি জাপানি নেট-ব্যবহারকারীদের মাছে তুমুল সাড়া ফেলে দেয়। কেউ কেউ মহামারী প্রতিরোধে চীনের প্রচেষ্টার স্বীকৃতি দেন, কেউ কেউ চীনের সৃজনশীলতা ও উন্নয়নের প্রশংসা করেন, আবার কেউ কেউ প্রামাণ্যচিত্রের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। এ ব্যাপারে গণমাধ্যমগুলোকে দেওয়া সাক্ষাত্কারে তিনি বলেন, তার প্রামাণ্যচিত্র্যের মূল্যায়ন ইতিবাচক বা নেতিবাচক যা-ই হোক না কেন, তিনি অব্যাহতভাবে এ কাজ করে যাবেন। তিনি বলেন, যদি কেউ সত্যটা তুলে না-ধরে, তবে চিরকাল একটা মিথ্যা সত্য হিসেবে অনেকে কাছে রয়ে যাবে।

এমন চিন্তাধারা থেকেই তাকেউচি রিও বস্তুনিষ্ঠভাবে নিজের চোখে দেখা সবকিছু রেকর্ড করেছেন। তিনি মনে করেন, প্রামান্যচিত্র করার ক্ষেত্রে পক্ষপাতমুক্ত থাকা একজন পরিচালকের সবচেয়ে মূল্যবান বৈশিষ্ট্য।

প্রামাণ্যচিত্র শুটিং করার ক্ষেত্রে তাকেউচি রিও’র প্রায় ২০ বছরের অভিজ্ঞতা আছে। এ ক্ষেত্রে তিনি অনেক পরিচিতিও লাভ করেছেন। তিনি এনএইচকে ও টোকিও টেলিভিশন কেন্দ্রের জন্যও অনেক প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছেন।

২০০৭ ও ২০০৮ সালে তিনি প্রায় ৫০টি টিভি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশই চীন-সম্পর্কিত।

তাকেউচি রিও’র ব্যক্তিত্ব সহজ ও সরল। অন্যরা কে কী বলল, সেটাকে তেমন গুরুত্ব দেন না তিনি। তার ব্যক্তিত্ব সরাসরি তার নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রে প্রতিফলিত হয়।

তাকেউচি রিও’র ক্যামেরায় যেন যাদু আছে। ২০১৩ সালে শানচিং শহরে আসার পর তিনি চীন নিয়ে পাগলের মতো কাজ করা শুরু করেন। ২০১৫ সাল থেকেই তিনি ‘আমার এখানে বাস করার কারণ’ নামে সিরিজ প্রামাণ্যচিত্র শুটিং করে আসছেন। প্রামাণ্যচিত্রে তিনি প্রথমে জাপানে বাস করা চীনা এবং চীনে বাস করা জাপানিদের জীবন রেকর্ড করেন। তিনি বলেন, মানুষ ও সমাজের পরিবর্তন হলো চিরন্তন বিষয়। তিনি পরিবর্তনশীল এই বিশ্বের বিভিন্ন গল্প বলতে পছন্দ করেন এবং পরিবর্তনশীল চীন তার চোখে আরও আকর্ষণীয়।

একটা ব্যাপারে সবাই কৌতুহলী। তাকেউচি রিও কেন চীনের নানচিং শহরে বাস করেন? যখন কেউ তাকে এই প্রশ্ন করেন, তিনি দ্বিধা না-করে উত্তর দেন, কারণ তার স্ত্রী নানচিংবাসী। ভালোবাসার কারণে তিনি নানচিং শহরকে নিজের বাসস্থান হিসেবে বেছে নেন। চীনে প্রামাণ্যচিত্র শুটিং করার চিন্তার কারণ  অবশ্য ভিন্ন।  

২০১০ সালে তাকেউচি রিও ইয়াংসি নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকায় এনএইচকে’র জন্য প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। তিনি নিজের ক্যামেরা ওখানে বাস করা সবচেয়ে সাধারণ জনগণের দৈনন্দিন জীবনের ওপর ফোকাস করেন। তিনি শিশুদের স্বপ্ন শুনেন এবং যুগের পরিবর্তন রেকর্ড করেন। শুটিং করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি প্রায়ই স্থানীয় জীবনের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দেখতেন। খুব দ্রুতই তিনি বুঝতে পারেন যে, জাপান সম্পর্কে স্থানীয় জনগণের জানাশোনা আসলেই খুবই কম। সেই সময় চীনে জাপানের সংস্কৃতির পরিচয় তুলে ধরতে প্রামাণ্যচিত্র শুটিং করার চিন্তা করতে শুরু করেন। তবে তার এই চিন্তার বিরোধিতা করেন তার স্ত্রী। কারণ, সেই সময় তারা চিন্তামুক্ত জীবন কাটাচ্ছিলেন এবং ঝুঁকি নিয়ে শিল্পসৃষ্টি করার কোনো দরকার নেই বলে স্ত্রী মত প্রকাশ করলেন।  

অবশেষে তাকেউচি রিও’র জেদের কাছে পরাজয় স্বীকার করেন তার স্ত্রী। ‘আমার এখানে বাস করার কারণ’ নামের সিরিজ প্রামাণ্যচিত্র শুটিংয়ের কাজ এভাবেই শুরু হয়।

‘আমার এখানে বাস করার কারণ’ নামের সিরিজ প্রামাণ্যচিত্রের বিভিন্ন প্রধান চরিত্রের মর্যাদা, বয়স ও অবস্থা ভিন্ন বলে তাদের চিন্তাধারা ও মনোভাবও  ভিন্নরকম।

আপনি কেন এখান বাস করেন? সখের কারণে, জীবনের কারণে অথবা চাকরির কারণে? এই প্রশ্নের উত্তর একেক জনের কাছে একেকরকম। তবে এমন একটি বিষয়ে সবার মধ্যে মিল রয়েছে, আর সেটি হচ্ছে: সবাই আগামীকাল নিয়ে আশাবাদী; তারা নিজ নিজ স্বপ্ন পূরণের জন্য চেষ্টারত।

যেমন, ‘আমার এখানে বাস করার কারণ’ নামের সিরিজ প্রামাণ্যচিত্রের একটি চরিত্র হচ্ছেন উহান বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি একটি দোকানের মালিক, যিনি জাপানি ও বয়স্ক। প্রামাণ্যচিত্র শুটিং করার সময় তার বয়স ছিলো ৭০ বছর। চীনে টানা ৭ বছর ধরে তিনি বাস করছেন। উহানে থাকার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিনি সবচেয়ে সুস্বাদু কারি তৈরি করে তার বিক্রি করতে চান। তিনি অনেকগুলো শাখা খুলতে চান। তিনি প্রতিমাসে কয়েক হাজার ইউয়ান মুনাফা করেন এবং এ নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট। বেশি টাকা উপার্জন নিয়ে তার বেশি আগ্রহ নেই। জীবন উপভোগ করা হলো তার একমাত্র উদ্দেশ্য। তিনি কারি তৈরির গোপন তথ্য আশেপাশের দোকানের মালিকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করেন এবং বিনামূল্যে জাপানি ভাষা শেখান।

তাকেউচি রিও’র কাছে স্বাধীনভাবে নিজের আগ্রহের বিষয় শুটিং করা এবং নিজের জানাশোনা ও উপলব্ধি বিশ্বের সামনে তুলে ধরা হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। (লিলি/আলিম/শুয়ে)