আতশবাজি শিল্পী ছাই কুও ছিয়াং
2021-01-14 14:56:12

আতশবাজি শিল্পী ছাই কুও ছিয়াং_fororder_yanhua1

আতশবাজি শিল্পী ছাই কুও ছিয়াং_fororder_yanhua2

আতশবাজি শিল্পী ছাই কুও ছিয়াং_fororder_yanhua3

আতশবাজি শিল্পী ছাই কুও ছিয়াং_fororder_yanhua

এক হাজার বছরেরও আগে চীনারা গানপাউডার বা বারুদ আবিষ্কার করেন। এরপর লোকজন বারুদ দিয়ে পটকা ও আতশবাজি তৈরি করে। বর্তমানে আতশবাজির প্রতি ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিদেশিদের আগ্রহ চীনাদের চেয়েও বেশি।

নববর্ষ উপলক্ষ্যে ব্রিটেনের লন্ডন ও এডিনবার্গসহ বিভিন্ন জায়গার আইকনিক ভবনের সামনের রাস্তায় লোকজন আতশবাজি উপভোগ করেন।

প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবসে মার্কিনীরা কনসার্ট আয়োজন করে থাকেন। আতশবাজির মাধ্যমে জাঁকজমকপূর্ণভাবে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করে থাকেন আমেরিকানরা।

প্রতি বছর গ্রীষ্মকালে জাপানে আতশবাজি উত্সবের আয়োজন করা হয়; যা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

তা ছাড়া, ফ্রান্স, গ্রিস, সুইজারল্যান্ড, পোল্যান্ড, রাশিয়া, জার্মানি ও বেলজিয়ামসহ আরো অনেক দেশ আতশবাজি ফাটাতে খুব পছন্দ করে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা সারা বিশ্বে বারুদের ব্যবহারে দক্ষ এক ব্যক্তির সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো। তার নাম হলো ছাই কুও ছিয়াং।

আতশবাজি পরিবেশনা সবসময়ই বেশ আকর্ষণীয় পরিবেশনা। অন্ধকার রাতে আতশবাজি ফোটানো হয়, দারুণ উজ্জ্বলতার পর খুব দ্রুত তা বিলীন হয়ে যায়।

২০০৮ সালে ২৯তম বেইজিং অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আতশবাজি পরিবেশনা এখনও অনেকের মনে আছে। ২৯টি বিশাল আশতবাজির তৈরি আলোকসজ্জা ১৫ কিলোমিটার দূর থেকেও দেখা গিয়েছিল। এটি প্রতি দুই সেকেন্ড পরপর বার্ডনেস্ট বা ন্যাশনাল স্টেডিয়ামের দিকে ছুটে যাচ্ছিলো।

মানুষ কল্পনাও করতে পারেন নি যে, এই বারুদ দিয়ে তৈরি আতশবাজি এত চমত্কার হতে পারে। এসব আতশবাজি দিয়ে অন্ধকার আকাশের বুকে তৈরি ডিজাইন সত্যিই মানুষের মনে দারুণ প্রভাব ফেলেছিল।

অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সেই ডিজাইন প্রসঙ্গে ছাই কুও ছিয়াং বলেন, বেইজিং অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আরো শৈল্পিক হয়ে উঠেছিল। ২০১৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ৭০তম বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ছাই কুও ছিয়াংয়ের আতশবাজির পরিবেশনা আবার বিশ্ববাসীকে নাড়া দেয়। তিনি আতশবাজি দিয়ে ‘জনগণ দীর্ঘজীবী হোক’ এবং ‘৭০’ এই নম্বর তৈরি করেছিলেন।

আসলে বেইজিং অলিম্পিক গেমসের আগেই ছাই কুও ছিয়াংয়ের নাম বিদেশে পরিচিতি লাভ করে। বলা যায়, তিনি বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম একজন হয়ে ওঠেন।

১৯৮৫ সালে ছাই কুও ছিয়াং সাংহাই থিয়েটার একাডেমি থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেন। এরপর তিনি দেশের বাইরে ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নেন।

তাই, তিনি প্রথমে জাপানে যান। সেখানে তিনি পূর্বাঞ্চলীয় সংস্কৃতির বিষয় ও জীবনযাপনের দৃষ্টিভঙ্গি গভীরভাবে অনুভব করেন।

১৯৯৩ সালে তিনি ফের চীনে ফিরে আসেন। চীনারা হাজার বছর ধরে আতশবাজি ব্যবহার করে আসছেন। কিন্তু কখনও বারুদ দিয়ে ছবি তৈরির বিষয়টি ভাবেন নি। তবে, ছাই কুও ছিয়াং বারুদ দিয়ে শিল্প তৈরি করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান।

২০১৫ সালের ১৬ জুন ভোরে ফুচিয়েন প্রদেশের ছুয়েনচৌ শহরের একটি নিরিবিলি জেলেপল্লীতে ৫০০ মিটার উঁচু এবং ২৫ টনের জ্বলন্ত ‘স্কাই ল্যাডার’ আকাশের দিকে উঠে যেতে দেখা যায়। এর দৃশ্যমান প্রভাব বর্ণনার জন্য ‘যাদু’ ছাড়া আরো কোনো শব্দ খুঁজে পাওয়া যায় না।

‘স্কাই ল্যাডার’ নামের এ আতশবাজির পরিবেশনা হলো তার নানীর জন্মদিন উপলক্ষ্যে ছাই কুও ছিয়াংয়ের উপহার। এই ভিডিও ইন্টারনেটে পোস্ট করার পর গোটা বিশ্বে ১৫ কোটির বেশি ভিউ হয়।

চীনা ভাষায় যখন আমরা এমন একটি কঠিন ব্যাপার বর্ণনা করি, তখন আমরা সবসময়ই ‘আকাশে আরোহণের চেয়েও কঠিন’ কথাটি ব্যবহার করি।

আসলে ‘স্কাই ল্যাডার’ নামের ছাই কুও ছিয়াংয়ের এই  আতশবাজি পরিবেশনার পেছনে অনেক পরিশ্রম রয়েছে। ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় এই আতশবাজি পরিবেশনার চেষ্টা করেছেন। তবে, বারবার ব্যর্থ হন তিনি। অবশ্য তিনি কখনওই হাল ছেড়ে দেন নি।

‘Sky Ladder: The Art of Cai Guo-Qiang’ নামে এই প্রামাণ্যচিত্রে প্রধানত ‘স্কাই ল্যাডার’ আতশবাজির জন্ম নেওয়ার প্রক্রিয়া তুলে ধরা হয়।

অস্কার বিজয়ী কেভিন ম্যাকডোনাল্ড দু’বছর ধরে শুটিং করেন। এতে ৮০ দশকে ছাই কুও ছিয়াংয়ের ছুয়েনচৌ থেকে রওনা হয়ে ৩০ বছরে পাঁচটি মহাদেশের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে বড় হওয়া এবং আস্তে আস্তে আন্তর্জাতিক মঞ্চের বিখ্যাত শিল্পী হওয়ার গল্প তুলে ধরা হয়।

১৯৫৭ সালে ছাই কুও ছিয়াং ফোংশুইতে বিশ্বাসী এমন একটি ফিশিং গ্রাম, অথবা ছুয়েনচৌতে জন্মগ্রহণ করেন।

চীনা জনগণের দৃষ্টিতে ফোংশুই মানে অদৃশ্য শক্তি। ছোটবেলায় অনেক বাচ্চার মতো ছাই কুও ছিয়াংয়েরও মহাকাশ ভ্রমণের স্বপ্ন ছিল।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি মনে করেন, মহাকাশের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার সেতু হলো শিল্প। ছোটবেলায় গ্রামের বয়স্করা তাকে জানান যে, ৫০০ মিটার উুঁচুতে দাঁড়িয়ে মেঘ ও তারা স্পর্শ করা যায়। তাই ‘মেঘ ও তারা স্পর্শ করার’ স্বপ্ন চিরদিন তার মনে গেঁথে যায়। এই ৫০০ মিটার হলো ‘স্কাই ল্যাডার’ নামে আতশবাজি পরিবেশনার উচ্চতা।

আসলে এর আগে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ‘স্কাই ল্যাডার’ নামে আতশবাজি পরিবেশনার চেষ্টা করেছিলেন এই শিল্পী। প্রথমবার ১৯৯৪ সালে ইংল্যান্ডে চেষ্টা করেন তিনি। তবে, সেখানকার খারাপ আবহাওয়ার জন্য তা ব্যর্থ হয়। দ্বিতীয়বার শাংহাই শহরে চেষ্টা করেন। তবে, নাইন-ইলেভেনের সন্ত্রাসী হামলার কারণে তার আতশবাজির পরিবেশনা বাতিল করা হয়। তৃতীয়বার ২০১২ সালে লস এঞ্জেলসে চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কায় তার আতশবাজি পরিবেশনার অনুমোদন বাতিল করা হয়।

আস্তে আস্তে ছাই কুও ছিয়াং বুঝতে পারেন, বড় শহরে তার এই আতশবাজি পরিবেশনা করা সম্ভব নয়। তাই মাত্র ৪০০ মানুষের জন্মস্থান হুই ইউ দ্বীপ নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ স্থান।  

তাই তিনি জন্মস্থানে ফিরে আসেন। আসলে ‘স্কাই ল্যাডার’ নামে এই আতশবাজি পরিবেশনার আরো গভীর অর্থ আছে।

তিনি এই পরিবেশনাটি উপহার হিসেবে নানীকে দিতে চান।

ছোটবেলায় ছাই কুও ছিয়াংয়ের নানী মাঝে মাঝে বলতেন, তার নাতি অবশ্যই বিখ্যাত একজন শিল্পী হবে। তাই ছোটবেলা থেকে নিজের প্রিয় নানীকে তার শিল্পী হওয়ার প্রমাণ দেখানোর ইচ্ছা পোষণ করেন ছাই কুও ছিয়াং।

২০১৫ সালের ১৫ জুন ভোর ৪টা ৫৯ মিনিটে ছাই কুও ছিয়াং এবং ছুয়েনচৌ হুই ইউ দ্বীপের চারশ’ মানুষ একসঙ্গে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ৬২০০ ঘনমিটার হিলিয়াম বহন করা একটি সাদা রংয়ের বেলুন নীরবে অপেক্ষা করছিলো।

সেদিন তার নানী অসুস্থ থাকায় সেখানে যান নি। তাই ছাই কুও ছিয়াং সেলফোন দিয়ে নানীর জন্য ভিডিওটি সরাসরি প্রচার করেন।

কাউন্টডাউন শেষ হলে ছাই কুও ছিয়াং গভীর একটা শ্বাস নেন। তারপর লাইটার দিয়ে ‘স্কাই ল্যাডার’ প্রজ্বলিত করেন।

প্রথম লাইনের বারুদ খুব দ্রুত পুড়তে শুরু করে; তারপর একটির পর একটি। আগুনের বিশাল মই আকাশের দিকে তরতর করে উঠে যেতে থাকে।

এর মাত্র ৩০ দিন পর তার প্রিয় নানী মারা যান। আতশবাজির আলো খুব দ্রুত ফুরিয়ে যায়। তবে আতশবাজির ভরপুর আনন্দ-অনুভূতি অনেকদিন মানুষের মনে থেকে যায়।

বারুদ দিয়ে আতশবাজি তৈরির পাশাপাশি, পরিবেশ সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে ছাই কুও ছিয়াং পরিবেশ-বান্ধব উপাদান দিয়ে আতশবাজি তৈরি করেন। এ ধরনের উপাদান দিয়ে তৈরি আতশবাজি দিনের বেলাও ফুটানো যায়।

ছাই কুও ছিয়াংয়ের আগে আতশবাজি ছিল শুধুই আতশবাজি, অথবা ধ্বংসাত্মক অস্ত্র। তবে তিনি বারুদ দিয়ে শিল্পকলা সৃষ্টি করেছেন।

চীনাদের কাছে সোং রাজবংশের সময় থেকে আতশবাজি উত্সবের সঙ্গে জড়িত একটি বিষয়। এরপর বহুদিন পার হয়েছে। বন্ধুরা, আপনাদের মনে আতশবাজির কোনো অবিস্মরণীয় স্মৃতি আছে কি? আমাদের জানাতে ভুলবেন না কিন্তু!

(লিলি/তৌহিদ/শুয়ে)