রাশিয়ার চলচ্চিত্র ও রুশ চলচ্চিত্র বাজার
2020-12-16 16:15:10

রাশিয়ার চলচ্চিত্র ও রুশ চলচ্চিত্র বাজার

রাশিয়ার চলচ্চিত্র ও রুশ চলচ্চিত্র বাজার

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে তৈরি চলচ্চিত্র ‘T-34’ সম্প্রতি চীনে প্রদর্শিত হয়েছে। এটি হলো চলতি বছর চীনে আমদানিকৃত একটি রাশান চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটি গত বছরের পহেলা জানুয়ারি রাশিয়াতে মুক্তি পায় এবং এটি ডোমেস্টিক যুদ্ধবিষয়ক চলচ্চিত্রের বক্স-অফিসে সর্বোচ্চ আয় করে। আপাতত চীনের বাজারে সবচে ভালো পারফর্ম করা রুশ চলচ্চিত্র হলো গত বছরে প্রদর্শিত ‘Going Vertical’। চলতি বছর চীনে ‘T-34’ নামের চলচ্চিত্রটির বক্স-অফিসের উপার্জন কি ‘Going Vertical’ সিনেমাকেও ছাড়িয়ে যাবে? সময়ই তা বলে দেবে।

বন্ধুরা, আজকের অনুষ্ঠানে আমরা রাশিয়ার চলচ্চিত্র অঙ্গনের ওপর দৃষ্টি দেবো।

 

চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষাকারী প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে অনেক দর্শক জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্রের সঙ্গে সুপরিচিত। তবে রাশিয়ার চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে চীনা দর্শকদের জানাশোনা খুবই কম। আসলে আমাদের পিতা-মাতা ও আগের প্রজন্মের মানুষের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের চলচ্চিত্র হলো তাদের যৌবনের দারুণ স্মৃতি। ‘Lenin in 1918’, ‘Tikhiy Don’, ‘A Village School-teacher’ এবং ‘ How the Steel Was Tempered’ নামের চলচ্চিত্রগুলো হলো চীনের কয়েক প্রজন্মের মানুষের লালন করা স্মৃতি।

 

বৈশ্বিক চলচ্চিত্র ইতিহাসের ওপর দৃষ্টি দিলে সোভিয়েত ইউনিয়নের চলচ্চিত্রের বিশেষ বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায়। শৈল্পিক চলচ্চিত্র বিশ্বের সর্বোচ্চ মানে পৌঁছেছে এবং বহুবার কান, বার্লিন, ভেনিস ও অস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কার জয় করেছে। তবে বর্তমান বিশ্ব বাজারে রাশান চলচ্চিত্রের অবস্থা ততটা মজবুত নয়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের চলচ্চিত্র কেন মন্দায় পড়েছে? সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার পর কেমন পরিবর্তন হয়েছে? রাশান চলচ্চিত্র শিল্পের কী অবস্থা? চীনের সঙ্গে রাশিয়ার চলচ্চিত্র খাতের সহযোগিতার কোনো অগ্রগতি হয়েছে কি?

অ্যালেক্সাজান্তার দেরাংক নামে একজন সাংবাদিকের ১৯০৮ সালে নির্মিত ‘Stepan Razin’ হলো রাশিয়ার সবচে পুরানো চলচ্চিত্র। সে সময় রাশিয়ার অধিকাংশ চলচ্চিত্র বিভিন্ন সাহিত্য অনুযায়ী তৈরি হতো। তবে তখনকার প্রযুক্তিগত সুবিধা ও আবন্ধ পরিবেশের কারণে রুশ চলচ্চিত্রগুলো খুব একটা জনপ্রিয়তা পায় নি।

 

১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লবের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে ফেডারেল সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রজাতন্ত্রের নেতা লেনিন চলচ্চিত্রের সামাজিক প্রভাবের ওপর গুরুত্বারোপ করতেন। দেশীয় উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত মুভি স্টুডিও চলচ্চিত্র শিল্প নিয়ন্ত্রণ করতো। সে সময় দেশটিতে বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্র স্কুলও প্রতিষ্ঠিত হয়। এর বর্তমানে নাম- মস্কো জাতীয় চলচ্চিত্র একাডেমি।

 

১৯২৫ সালে নির্মিত ‘Bronenosets Potemkin’ নামে চলচ্চিত্রটি চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বিশেষ মর্যাদা ধারণ করে। কারণ, চলচ্চিত্রটির পরিচালক সার্গেই এম এইসেস্টেইন এ চলচ্চিত্রে প্রথমবারের মতো মন্তেজ নামক সম্পাদনার পদ্ধতি প্রয়োগ করেন।

 

২০ শতকের ৩০ দশকে সবাক চলচ্চিত্রের জন্ম হয়। ১৯৩৪ সালে প্রথমবারের মতো সোভিয়েত ইউনিয়নের লেখকদের প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ‘সমাজতান্ত্রিক বাস্তব্‌বাদ’ সৃষ্টির উপায় তুলে ধরা হয়। এক্ষেত্রে ভ্যাসিলেভ ব্রাদার পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলোর মাইলফলক তাত্পর্য রয়েছে। তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের চলচ্চিত্রের ঐতিহাসিক ঘটনা, সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ ও জনগণের জীবনের প্রতিফলন বেশ গুরুত্ব পায়। তাই সেসময়, সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের প্রথম শ্রেণীর চলচ্চিত্র তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল।

 

জার্মানির সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের যুদ্ধের কারণে সেদেশের চলচ্চিত্র ১০ বছরের মন্দা শুরু হয়। ১৯৫৩ সালে পরিবর্তন শুরু হয়। নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্র নির্মাতারা বিভিন্ন মতবাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করেন। তাদের চেষ্টায় ৬০ ও ৭০ দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের চলচ্চিত্রে সোনালি সময় শুরু হয়। যেমন,  ভেনিস মেমোরিয়াল পুরষ্কার অর্জনকারী চলচ্চিত্র হলো- ‘The Dawns Here Are Quiet’, অস্কার শ্রেষ্ঠ বিদেশি চলচ্চিত্র ‘War and Peace’ এবং ‘Moscow Does Not Believe in Tears’। সোভিয়েত ইউনিয়নের এ চলচ্চিত্রগুলো ইউরোপের তিনটি চলচ্চিত্র উত্সবে বড় পুরস্কার লাভ করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাবার আগ্‌ পর্যন্ত সম্পূর্ণরূপে কার্যকরী, সুষ্ঠু পরিচালনা-ব্যবস্থা ও মুনাফা অর্জনের দক্ষতাসম্পন্ন জাতীয় চলচ্চিত্রশিল্প বিদ্যমান ছিলো।

 

তবে, দেশটির রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটের বিশাল সংস্কার চলচ্চিত্র শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলে রুশ চলচ্চিত্র বাজার সার্বিকভাবে উন্মুক্ত হতে শুরু করে। ফলে জাতীয় মুভি স্টুডিওগুলোর অবস্থা ক্রমশঃ অবনতি হচ্ছিলো এবং বেসরকারি প্রকাশনা সংস্থার উন্নয়ন শুরু হয়েছিল। প্রকাশনা সংস্থা বিদেশ থেকে আমদানি করা চলচ্চিত্রকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কারণে মার্কিন চলচ্চিত্রগুলো বন্যার পানির মতো রাশিয়ার চলচ্চিত্র বাজার দখল করে নেয় এবং সরাসরি দেশীয় চলচ্চিত্র খাতে আঘাত হানে।

 

২১ শতকের প্রথম দুই দশকে রাশিয়ার চলচ্চিত্র বাজার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রশাসন চলচ্চিত্র শিল্পকে সমর্থনের জন্য ধারাবাহিক নীতিমালা গ্রহণ করে। যেমন, রাষ্ট্রায়ত্ত মুভি স্টুডিওয়ের সংস্কার এবং দেশীয় চলচ্চিত্রে সরকারি বরাদ্দ বাড়ানো ইত্যাদি। এসব নীতি বহুবছর ধরে চালু রয়েছে। ফলে রাশিয়ার চলচ্চিত্র বাজারে হলিউডের চলচ্চিত্র শীর্ষস্থানে থাকলেও এসময় রাশিয়ার নিজস্ব চলচ্চিত্র অঙ্গন ধাপে ধাপে শক্তিশালী হতে থাকে।

 

বিগত দশ বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, রাশিয়ার চলচ্চিত্র বাজারে বক্স অফিসে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্রের সংখ্যা ও দর্শকসংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১১ সালে মাত্র ৬৭টি চলচ্চিত্র রশার সিনেমা হলে প্রদর্শিত হয়েছিলো এবং এই সংখ্যা ২০১৯ সালে ১২২টিতে গিয়ে ঠেকে। ২০১১ সালে সিনেমা হলে গিয়ে চলচ্চিত্র উপভোগ করেছিল মাত্র ১৬ কোটি মানুষ। সেই সংখ্যা ২০১৯ সালে এসে হয় প্রায় ২২ কোটি।

 

রাশিয়ার চলচ্চিত্র বাজার পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য অর্জনের পর যুদ্ধবিষয়ক চলচ্চিত্র, সাই-ফাই চলচ্চিত্র, কমেডি ও ক্রীড়াবিষয়ক চলচ্চিত্রগুলো ধীরে ধীরে উন্নত হয়। দেশীয় চলচ্চিত্র অঙ্গন চাঙ্গা করায় তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

 

রুশ চলচ্চিত্রের সৃজনশীলতা ও আন্তর্জাতিক মর্যাদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়ার চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে জড়িত লোকজন আরো পরিচিত হয়ে ওঠেন। আন্দ্রে ভিয়াগিনাতসেভের প্রথম শিল্পকর্ম ‘The Return’ ২০০৩ সালে ভেনিস গোল্ডেন লায়ন অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে। ‘Leviathan’ নামের চলচ্চিত্র ২০১৪ সালে কান চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যের পুরস্কার জয় করে। ‘Paper Soldier’ নামে  অ্যালেক্সাই অ্যালেক্সসেয়েভিচ গের্মানের পরিচালিত চলচ্চিত্রটি ২০০৮ সালে ভেনিসের শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার লাভ করে এবং অ্যালেক্সান্দার সোকুরোভের পরিচালিত ‘Faust’ চলচ্চিত্রটি ২০১১ সালে ভেনিস গোল্ডেন লায়ন অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে।

 

মোটের ওপর বলতে গেলে রুশ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চেয়ে রুশ পরিচালকদের আন্তর্জাতিক মর্যাদা বেশি হয়।

আসলে চীনে রুশ বৈশিষ্ট্যের চলচ্চিত্র আমদানির ইতিহাস প্রায় শত বছরের। গত শতাব্দীর বিশের দশক থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের চলচ্চিত্রগুলো চীনে আমদানি করা শুরু হয়। ৩০ দশকে চীনের বিপ্লব ঘাঁটিতে তা প্রদর্শিত হয়েছিলো। গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর প্রায় ৫০ দশকে চীনে প্রদর্শিত সোভিয়েত ইউনিয়নের চলচ্চিত্রের সংখ্যা প্রায় ৭৫০টিতে উন্নীত হয়। সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের চলচ্চিত্রগুলো দর্শকদের ব্যাপক সমাদর পায়। তবে, সময় এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চীনের চলচ্চিত্র বাজারে রুশ চলচ্চিত্রের কিছুটা সংকট দেখা দেয়। এ অবস্থায় চীনে রাশান চলচ্চিত্রের প্রভাব দিন দিন কমে আসে।

 

তবে, চীন ও রাশিয়ার সাংস্কৃতিক বিনিময় ঘনিষ্ঠতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দু’দেশের চলচ্চিত্র খাতে সহযোগিতা আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। ২০০৬ সাল থেকে প্রতি দু’বছরে একবার কোরে ‘চলচ্চিত্র সপ্তাহ’ কার্যক্রম আয়োজন করা হচ্ছে। ২০১৩ সালে ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগ শুরু হলে ‘চলচ্চিত্র সপ্তাহের’ কার্যক্রম প্রতি বছর ধারাবাহিকভাবে আয়োজন করা হয়। রাশান চলচ্চিত্রের জন্য চীনের দরজা আরো প্রসারিত হয়েছে। প্রতি বছর চীন ৫/৬টি রুশ চলচ্চিত্র আমদানি করে। ২০১৭ সালে চীন ও রাশিয়া যৌথভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণের বিষয়ে চুক্তি স্বাক্ষরও করেছে। আশা করা যায়, ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগ দুই দেশের বিভিন্ন মহলের কাছে গুরুত্ব পাবে। পাশাপাশি, চীন ও রুশ চলচ্চিত্র খাতে সাংস্কৃতিক বিনিময় বাড়বে। এখন আরও বেশি সহযোগিতা প্রকল্প চালু হচ্ছে এবং চীনের বাজারে ‘রুশ চলচ্চিত্রের সুদিন’ ফিরে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।

(লিলি/তৌহিদ/ফেই)