চীনের ছোট ভিডিও প্লাটফর্মে পরিশ্রমী বিদেশির গল্প
2020-11-04 13:37:12

চীনের ছোট ভিডিও প্লাটফর্মে পরিশ্রমী বিদেশির গল্প

প্রিয় বন্ধুরা, আজকের আলোছায়া অনুষ্ঠানে আমরা চীনের সংক্ষিপ্ত ভিডিও প্ল্যাটফর্মে কাজ করা একজন বিদেশির সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো। তাঁর চীনা নাম কাও ইউ সি। চলতি বছর হলো চীনের ত্রয়োদশ পাঁচশালা পরিকল্পনার শেষ বছর। বিগত পাঁচ বছরে চীনের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ঐতিহাসিক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। ফলে চীনা জনগণের আরো সুন্দর জীবন গড়ে ওঠার পাশাপাশি, চীনে বাস করা বিদেশিদের জীবনও উন্নত হয়েছে; বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা নানা সুযোগ পেয়েছে। অনেক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করে চীনের পরিশ্রম তারা প্রত্যক্ষ করেছেন এবং নিজেরা এতে অংশগ্রহণও করেছেন।

‘এখানে ১৫ হাজার মাস্ক আছে এবং মেডিকেল সার্জারি গাউন আছে। এসব জিনিস চীনে পাঠানো হবে।’

প্রিয় বন্ধুরা, আপনার এখন শুনছেন বিদেশি মানুষ কাও ইউ সি’র কথা।

কাও ইউ সি টানা ১৩ বছর ধরে চীনে বাস করছেন। তিনি ইসরাইলি তরুণ। নভেল করোনাভাইরাস মহামারীর প্রাদুর্ভাবের শুরুতে তিনি বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কিছু মহামারীর প্রতিরোধমূলক দ্রব্য সংগ্রহ করে উহান শহরে পাঠান। তিনি এই প্রক্রিয়া ক্যামেরায় ধারণ করে চীনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেছেন। প্রায় ১০ মিনিটের ভিডিওটি সাড়ে ৪ কোটিবার দেখা হয়েছে এবং ১ লাখ ২০টি মন্তব্য এসেছে।

মাত্র ২০ বছরের যুবক কাও ইউ সি অনেক চীনা তরুণ নেটব্যবহারকারীদের কাছে খুব বিখ্যাত একজন বিদেশি। তার মতো আরো বিখ্যাত হয়ে উঠেছে তার প্রতিষ্ঠিত স্ব-মিডিয়া এজেন্সি-বিদেশিদের গবেষণা সংস্থা।

মাধ্যমিক স্কুল পাস করে কাও ইউ সি যথাক্রমে হংকং ও বেইজিংসহ বিভিন্ন জায়গায় পড়াশোনা করেছেন। বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি পাওয়ার পর সাবলীল চীনা ভাষায় কথা বলতে পারেন কাও ইউ সি। তিনি নিজ উদ্যোগে বিদেশিদের গবেষণা প্রতিষ্ঠান গঠন করেছেন। তার প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে ‘চীনকে বিদেশিদের দেখা’ থিমকে কেন্দ্র করে নানা ভিডিও তৈরি করে। তিনি ক্যামেরা দিয়ে বিদেশিদের চোখে দেখা বৈচিত্র্যময় চীন তুলে ধরেছেন এবং সত্যিকার চীনকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রদর্শন করেছেন।

কাও ইউ সি ‘বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত’- এই শব্দ দিয়ে চীনের স্বল্প ভিডিও প্লাটফর্মের সাম্প্রতিক বছরগুলোর উন্নয়ন বর্ণনা করেছেন। স্বল্প ভিডিও’র প্রতি চীনা জনগণের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। এটিই তার এই পেশা বাছাই করার গুরুত্বপূর্ণ কারণ। কাও ইউ সি বলেন,

ইন্টারনেট-ভিত্তিক নানা সরঞ্জাম জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এবং স্বল্প ভিডিও’র প্লাটফর্মও বের হয়েছে। এতে সার্বিকভাবে চীনা জনগণের বিনোদনের অভ্যাস এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের উপায় বদলে গেছে। চীনা জনগণ অন্যান্য সাংস্কৃতিক অভ্যাস জানতে আগ্রহী বলে আমি এই সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছি। যখন আমি এই সংস্থা প্রতিষ্ঠা করি, তখন জনপ্রিয় স্বল্প ভিডিওগুলো ছিল মাত্র ৫ মিনিট। তবে, এখন স্বল্প ভিডিও’র গড় সময় প্রায় ৩০ সেকেন্ড। চীনাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের গতি অনেক দ্রুত হয়েছে এবং চীনা জনগণ নতুন প্রবণতার সঙ্গে খাপ খাওয়েতে পারেন।

২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে বিদেশিদের গবেষণা সংস্থা প্রতিষ্ঠার পর পরই প্রথম ভিডিওটি তৈরি করা হয়। এই ভিডিও’র নাম হলো ‘বিদেশিদের উইচ্যাটের লাল খাম ব্যবহার করার চেষ্টার পর।’

এই স্বল্প ভিডিওতে আমরা দেখতে পাই যে, কাও ইউ সি মাইক্রোফোন নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে নানা বিদেশিদের সাক্ষাত্কার নিচ্ছেন। অনেকে হাসিঠাট্টা করেন, তারা লাল খামে মাত্র এক ফেন পান! আরো অনেক লোক বলেন, উইচ্যাটের লাল খাম অনেক মজার।

মাত্র তিন মিনিটেরও কম সময়ের ভিডিওটি ইন্টারনেটে অনেক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মাইক্রোব্লগে এই ভিডিওয়ের ক্লিকের পরিমাণ দেড় কোটিতে পৌঁছে যায় এবং এক লাখ নতুন ফ্যান আকর্ষণ করেন।

এই ভিডিওয়ের পর কাও ইউ সি এবং তার সহকর্মীরা ‘বিদেশিদের চীনে চাকরি খোঁজার পর’ এবং ‘বিদেশিদের চীনে ভ্রমণ করার পর’সহ নানা বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে রাস্তায় সাক্ষাত্কার নেওয়ার জন্য ভিডিও তৈরি করেন।

প্রিয় বন্ধুরা, আপনার এখন যে শব্দ শুনছেন তা হলো- রাস্তায় কাও ইউ সি’র নানা বিদেশিদের সাক্ষাত্কার নেওয়ার কিছু অংশ।

কাও ইউ সি’র বিদেশিদের গবেষণা সংস্থার প্রকাশিত সর্বশেষ এক ভিডিওতে এক দল বিদেশির সঙ্গে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন নিয়ে আলোচনা করেন।

এখন পর্যন্ত বিদেশি গবেষণা সংস্থার ফ্যানের সংখ্যা ২ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এ সংস্থার তৈরি ভিডিওগুলো ১৫ বিলিয়ন বার দেখা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কাও ইউ সি বলেন,

‘চীনে আমাদের ভিডিওয়ের সবচে উত্সাহী দর্শক হচ্ছেন ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সী লোক। তাদের সংখ্যা মোট দর্শকদের ৬০ শতাংশ। তার পর ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী দর্শক মোট দর্শকের ২০ শতাংশ। তা ছাড়া, ৩৫ বছর বয়সের বেশি দর্শকও আমাদের আছে। তারা আমাদের তুলনামূলক গভীর বিষয়সম্পন্ন ভিডিও উপভোগ করতে পছন্দ করেন, যেমন, আমাদের তৈরি বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র।’

প্রভাব সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে বিদেশিদের গবেষণা সংস্থার সদস্য প্রথম দিকের কয়েকজনের তুলনায় বর্তমানে কয়েক ডজন বেড়ে যায়। এখন বিদেশিদের খুব ভালো চীনা ভাষা বলার দক্ষতা ছাড়াও, বিশেষ কিছু নৈপুণ্য থাকতে হবে।

লিলা নামে একটি মার্কিন মেয়ে তাদের মধ্যে একজন। তিনি বলেন,

 ‘উচ্চ বিদ্যালয় থেকে আমি চীনা ভাষা শিখতে শুরু করি। চীনা ভাষা সম্পর্কে আমি খুব আগ্রহী। তারপর চীনের প্রতি আমার আগ্রহও বাড়ছে। তাই আমি চীনে লেখাপড়া করার সিদ্ধান্ত নেই। বেইজিং বিশ্ববিদ্যালয় খুব বিখ্যাত। আমি একে আমার লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করি। ছোটবেলা থেকে আমি শিল্পকলা দারুণ পছন্দ করি। তারপর চলচ্চিত্রের প্রতিও আমি বেশ আকৃষ্ট বোধ করি। আসলে প্রথমে আমি পর্দার আড়ালে কাজ করতে চেয়েছিলাম। আকস্মিক এক সুযোগে আমি ক্যামেরার সমানে হাজির হই। তারপর দু’দিনের মধ্যে মাইক্রোব্লগে আমার ভক্তের সংখ্যা ৭০/৮০ হাজার হয়ে যায়। ক্যামেরার সামনে আমার কাজ এভাবেই শুরু হয়।’

তিনি বলেন,

 ‘এসব ভিডিও তৈরির মাধ্যমে ক্যামেরার সামনে সে অনুভূতির সঙ্গে আমি পরিচিত হতে শুরু করি। আমি মুখের ভাষা ও দেহের ভাষা দিয়ে নিজের চিন্তাধারা প্রকাশ করি। কয়েক বছর পর আমি সাহসিকতার সঙ্গে চীনের টিভি অনুষ্ঠানে হাজির হই। আমি খুব খুশি।’

চীনের সংস্কৃতি ও জীবন আরো ভালোভাবে তুলে ধরতে কাও ইউ সি ও তার সহকর্মীরা ‘মজার’ বিষয় থেকে ‘গভীর’ বিষয়ের দিকে মোড় নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তারা অব্যাহতভাবে অভিজ্ঞ ভিডিও এবং আলোচনা অনুষ্ঠানসহ নানা নতুন ভিডিও তৈরি করেন।

চীনের দরিদ্র অঞ্চলের জনগণের দারিদ্র্যমুক্তির অবস্থা তুলে ধরতে কাও ইউ সি’র নেতৃত্বে সংস্থার সদস্যরা চীনের কুইচৌ ও সিছুয়ানসহ বিভিন্ন জায়গার গ্রামাঞ্চল পরিদর্শন করেন। স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আলোচনার অভিজ্ঞতা কাও ইউ সি’র মনে গভীর দাগ কাটে। তিনি বলেন,

 ‘বিগত কয়েক বছরে চীনের দারিদ্র্যমুক্তি-বিষয়ক নানা নীতিমালা এসব দরিদ্র লোকদের উন্নয়নের সুযোগ করে দিয়েছে। বর্তমানে যেকাজ তারা করতে পারেন সেকাজ আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। দারিদ্র্যমুক্তি আসল অর্থ কি? তার মানে দরিদ্র লোকদের কাজ বাছাই করার সুযোগ দেওয়া, স্থায়ী উপার্জনের ব্যবস্থা করা এবং সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ ও বিনিময় করার সুযোগ দেওয়া।’

চীনের দারিদ্র্যমুক্তের প্রচেষ্টা ও সফলতা আরো বেশি লোকের কাছে তুলে ধরতে কাও ইউ সি এবারের নির্মিত ভিডিও বেশ কয়েকটি বিদেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেন। তিনি বলেন,

 ‘এবারে আমি ভিডিও’র ইংরেজি সংস্করণও তৈরি করেছি। আমি অন্য দেশের জনগণকে জানাতে চাই যে, চীনের দারিদ্র্যমুক্তি কেমন। চীন প্রসঙ্গে নতুন ধারনা দিতে চাই আমি। অনেক দেশে এই ভিডিও’র ইতিবাচক মূল্যায়ন হয়েছে। অনেক নেটব্যবহারকারী এই ভিডিও’র প্রশংসা করেছেন। তারা মনে করছেন, চীনের এসব নীতি তাদের জন্যও প্রয়োজনীয়।’

কাও ইউ সি বলেন, তার এই সংস্থা বিদেশি তরুণ প্রজন্মের জন্য চীনকে জানার জানালা হিসেবে ভূমিকা রাখবে। তিনি সত্যিকার চীনা গল্প সারা বিশ্বকে বলতে চান।

(লিলি/তৌহিদ)