চীন একটি বহু জাতিক দেশ। ৫৬টি জাতি সহাবস্থানের মাধ্যমে মিলেমিশে আছে। বিভিন্ন জাতি জাকঁজমকপূর্ণ শিল্পকলা সৃষ্টি করেছে। নয়া চীন প্রতিষ্ঠার পর চীন সরকার বিভিন্ন জাতির সংস্কৃতি সংরক্ষণ এবং শিল্পীদের লালনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে। চীন সরকার বেশ কয়েকটি গুরত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি সংরক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সে কারণে বিলুপ্ত প্রায় ঝুঁকিপূর্ণ ঐতিহ্যবাহী জাতীয় শিল্পকলার অব্যাহত সম্প্রসারণ সম্ভব হয়েছে।
এ সংগীত উইগুর গায়ক মা হান তোংয়ের গাওয়া। মা হান তোংয়ের বয়স ৪৭ বছর। তিনি চীনের উত্তর-পূর্ব নিং সিয়াং উইয়ে জাতি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে বসবাস করেন। স্থানীয়ভাবে তিনি 'হুয়ায়ের রাজকুমার" হিসেবে পরিচিত। মা হান তোংয়ের পাহাড় হুয়ায়ের সঙ্গে ৩০ বছরের সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, ১৯৭২ সালে আমি হুয়ায়ের গাইতে শুরু করেছি। তখন আমি গ্রামে প্রবীণ শিল্পীদের কাছ থেকে শিখতাম। তাঁরা ক্ষেতে খাসি চালনা করে। আমি তাদের সংগীত শুনে অবাক হতাম। তাদের সঙ্গে গাইতে গাইতে গান শিখতে পেরেছি। হুয়ায়েরের উজ্জ্বল ভবিষ্যত অটুন্ট থাকবে বলে আমি মনে করি। সেজন্য আমি এ শিল্পকলা পেশাগতভাবে শিখতে শুরু করেছি। তখন থেকে আজ পর্যন্ত আমি কখনও হুয়ায়ের চর্চা বন্ধ করি নি।
পাহাড়ী হুয়ায়ের চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে খুব জনপ্রিয় লোক সংগীত। নিং সিয়া'র অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বিষয়ক কেন্দ্রের পরিচালক চিন জোং ওয়ে জানিয়েছেন, উইগুর জাতির পাহাড়ী হুয়ায়েরের ইতিহাস হাজার বছরের। এটি হলো উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিস্তির্ণ পাহাড়ের পাদদেশ অধ্যুষিত জনগণের অনুভূতি প্রকাশের একটি পদ্ধতি। সংগীতের সুর উত্তেজনাময় এবং অর্থ সহজ। হাজার হাজার বছর ধরে লোক শিল্পীরা কাজ করার সময় ইচ্ছে মতো এ গান করে। পাহাড়ী হুয়ায়ের শিল্প আগে কখনো সংরক্ষন করা হয় নি। সে কারণে পাহাড়ী হুয়ায়ের লোক গীতি এক সময় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিল।
চীন সরকারের সহায়তায় মা হান তোং পাহাড়ী হুয়ায়ের শিল্প শেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিগত বছরগুলোতে তিনি সংগীতের কথা সংগ্রহ করে আসছেন। তিনি ধীরে ধীরে পাহাড়ী হুয়ায়ের শিল্পের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তি হয়ে উঠেছেন। গত কয়েক বছর মা হান তোং চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিবেশনায় যান। তাছাড়া তিনি বিদেশেও বেশ কয়েকবার সংগীত পরিবেশনা করেছেন। তিনি বলেন, "অন্যদের কোনো ভালো সুর ও গানের শব্দ থাকলে আমরা সংগ্রহ করে সংকলন করি। লোক সংগীতে শেখার মত অনেক কিছু আছে। সে সব যদি উত্তরাধিকারী হয় তা আরও ভালো হবে। ছিং হাই, কান সু ও সিন চিয়াংয়ের হুয়ায়ের এবং শান সি'র সিন থিয়েন ইয়ো লোক সংগীত আমি সবই গাইতে পারি। কত গান গাইতে পারি আমারও ধারণা নেই।
স্থানীয় সরকারও পাহাড়ী হুয়ায়ের শিল্পের উত্তারাধিকারী হওয়ার ওপর গুরুত্ব দেয়। গত শতাব্দির ৮০ দশকে নিং সিয়ায়ে হুয়ায়ের সংগীত সম্মেলন শুরু হয়। এতে বিভিন্ন স্থান থেকে আসা গায়ক ও গায়িকারা অংশ নেয়। প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার জনসাধারণে আকর্ষণ করে এবং যুবকদের মনে সুখ সৃষ্টি করে। এ সম্মেলনের মাধ্যমে এক কিস্তি প্রতিনিধিত্বমূলক শিল্পী বাছাই করা হবে। সাম্প্রতিক বছর নিং সিয়ায়ে "বিদ্যালয়ে হুয়ায়ের সম্প্রসারণ" তত্পরতা চালানো হয়েছে। যাতে ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে হুয়ায়ের গাইতে পারে। নিং সিয়ায়ের অবৈষিক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার বিষয়ক কেন্দ্রের পরিচালক চিন জোং ওয়ে বলেছেন, তারা হুয়ায়ের সংগীত নিয়ে অনেক গবেষণাও সংস্কার করেছেন। যাতে বর্তমান গতির সঙ্গে তার মেশানো যায়।
মুকাম চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে উইগুর জাতির মধ্যে জনপ্রিয় এক ধরণের বলা ও গাওয়া শিল্প। গত শতাব্দির ৫০ বা ৬০-এর দশকে চীনের প্রথম প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই মুকাম শিল্প ও শিল্পীদের সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেন।
মুকাম শিল্প নিয়ে গবেষণারত সিন চিয়াংয়ের শাছে জেলার শিল্পী দলের নেতা ইলহাম বলেছেন, অন্য অনেক ঐতিহ্যবাহী শিল্পের মত মাস্টার শিখার্থীকে শেখানো এবং মুখে মুখে এমন একক পদ্ধতিতে মুকাম সম্প্রসারণ করা হয়। মুকামের অনেক ধরণ রয়েছে এবং অনেক লম্বা সুর বলে এ শিল্পও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিলো। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, "নয়া চীন প্রতিষ্ঠার আগে মুকাম বিপর্যায়ের অবস্থায় ছিল। বাজাতে পারে এমন লোক ছিল খুব কম। যারা বাজাতে পারেন, তারা কিন্তু কিছু অংশ বাজাতে পারেন। নয়া চীন প্রতিষ্ঠার পর প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই বিশেষজ্ঞ পাঠিয়েছেন। তারা মুকামের রেকডিং করে, সুর কাগজে লিখে নেন এবং শব্দ সংগ্রহ করেন। তখন খুব কম লোক গাইতে পারতো, বাজাতে পারতো। তাদের বয়স অনেক বড়। সেজন্য আমাদের দেশ তাড়াতাড়ি তাদের সংরক্ষণ করে। বলা যায় আমাদের ভাগ্য চীনের কমিউনিস্ট পাটিঁর সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে।
ইলহামের শাছে জেলায় 'বারো মুকাম"-এর খ্যাতি রয়েছে। এ জেলা এক সময় ইতিহাসে সমৃদ্ধ ইয়েরছিংহান রাজ্যের রাজধানী ছিলো। কথিত আছে যে, সে সময় ইয়েরছিংহান রাজ্যের রানী আমেনিশাহান একজন বিখ্যাত কবি ও গীতি শিল্পী ছিলেন। তিনি তার পুরো জীবন দিয়ে মুকাম নিয়ে গবেষণা করেছেন। অবশেষে তিনি তথন এলোমেলো মুখামের বারোটি সেট সংগীতে পরিণত করেছেন। এ বারোটি সেট সংগীত আজকের বারো মুকামক নামে পরিচিত চিহ্নিত হয়। স্থানীয় লোকজন মনে করেন যে, মুকাম আবহাওয়া ও খাদ্যের মত। অভাবতার সম্ভবত নেই। বিপর্যায়ের মুখে থাকা এ শিল্প সংরক্ষনের জন্য চীনের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় মুকাম সংগ্রহ ও সংকলনের জণ্য অনেক গীতি শিল্পী পাঁঠিয়েছিলো।
মুকাম শিল্পী ইউসুপ টৌহতি ছোট বেলা থেকে তার বাবার কাছ থেকে মুকাম পরিবেশনা শেখেন। তিনি হচ্ছেন শাছে জেলায় এক মাত্র লোক যিনি বারোটি সেট সংগীত পরিবেশনা আয়ত্ত করেছেন। তিনি বহুবার পেইচিং, জাপান, বৃটেন ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন স্থানে সুকাম পরিবেশনা করেছেন। সে সব দেশে তাকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানানো হয়ে ছিল।
চীন সরকারের সহায়তায় সংখ্যালঘু জাতির সংস্কৃতি নিয়ে গবেষনা বর্তমানে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। গে তত্ত্ব এর মধ্যে অন্যতম। বর্তমানে সারা বিশ্বে প্রচলিত সবচেয়ে লম্বা ও এখনও জনপ্রিয় ঐতিহাসিক কবিতা " রাজা গেসার" নিয়ে গে তত্ত্ব প্রধানত গবেষণা করে। রাজা গেসার তিব্বতীদের মনে সাহসী ও আন্তরিক শহীদ। তাকে নিয়ে বানানো ঐতিহাসিক কাব্য ' রাজা গেসার' এক হাজারেরও বেশি বছর ধরে প্রচলিত হয়ে আসছে। কিন্তু এ কাব্যের অনেক ধরণ রয়েছে। নয়া চীন প্রতিষ্ঠার পর এ কাব্যের সংগ্রহ সংকলন ও গবেষনার কাজ শুরু হয়। এ পর্যন্ত চীনে বেশ কয়েকটি গবেষনা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এ কেন্দ্রগুলোতে প্রায়ই বড় আকারের আন্তর্জাতিক কার্য গবেষনা সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এ পর্যন্ত তিব্বতী, মঙ্গোলিয়া ও চীনা ভাষা মোট একশ'র বেশিটি "রাজা গেসার" কাব্য প্রকাশিত হয়েছে এবং ১৫০জন লোক শিল্পী খুঁজে পাওয়া গেছে।
তিব্বত সায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সমাজ ও প্রযুক্তি একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক সিওয়াং প্রেটি মনে করেন, রাজা গেসারের ওপর চীনের সংরক্ষণ পুরো জাতির সংস্কৃতি সংরক্ষনের ক্ষেত্রে ছোট একটি অংশ। বিগত বছরগুলোতে ধরে চীনের জাতীয় সংস্কৃতির ভালো সংরক্ষন ও উন্নয়ন হয়।
চীন সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভবিষ্যতে চীন শিল্পী একাডেমী ও দলের ওপর সমর্থন, জাতীয় সাংস্কৃতিক পুরাকীর্তি বিশেষ করে সংখ্যালঘু জাতির উত্তরাধিকার উদ্ধার ও সংরক্ষণ কাজ জোরদার করবে। যাতে চীনের বহু জাতির সংস্কৃতি ও শিল্প আরও সমৃদ্ধ হবে। |