আজকের অনুষ্ঠানে চীনের একজন তরুণী কন্ঠশিল্পীর কাহিনী আপনাদের শোনাবো । এ কন্ঠশিল্পীর নাম সোং সোং । তিন বছর আগে মস্কোর নামকরা নেসিন সংগীত ইন্সটিটিউটে একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ একক সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় । রাশিয়ায় অধ্যয়নরত চীনের ছাত্রী সোং সোং অনুষ্ঠানে রুশ ভাষায় রাশিয়ার অনেক গান গেয়েছেন । তার শ্রুতিমধুর গান রাশিয়ার সংগীত মহলের বিশেষজ্ঞ ও দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে । রাশিয়ায় লেখাপড়া চীনের কোনো ছাত্রছাত্রীর এই প্রথমবারের মত রাশিয়ার বিখ্যাত সংগীত ইন্সটিটিউটে একক সংগীতানুষ্ঠান আয়োজিত হয় ।
সোং সোংয়ের বয়স ত্রিশ বছরের কিছু বেশি , মধ্য চীনের হু নান প্রদেশের ছাংশা শহরে তার জন্ম । হু নান প্রদেশ চীনের লোকসংগীতের আধার । সোং সোং ছোট বেলা থেকেই নাচগান পচন্দ করেন । তিনি নামকরা লোকসংগীত শিল্পীদের গান চমত্কারভাবে অনুকরণ করতে পারেন বলে তার জন্মস্থানে সোং সোংয়ের সুনাম ছিল । এক দিন শিক্ষকের বাসায় অপেরা ' লা ট্রাভিয়াটা ' রেকর্ডিং শুনে সোং সোংয়ের খুব ভালো লেগে যায় । সোং সোং বলেন , আমার শিক্ষকের বাসায় ' অপেরা লা ট্রাভিয়াটা'র রেকর্ডিং শুনে আমার খুব ভালো লেগেছে । আমি মনে মনে নিজেকে বলি , আমাকে গান শিখতে হবে এবং একদিন অপেরা ' লা ট্রাবিয়াটার' গান গাইতে হবে ।
উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের লেখাপড়া শেষ করে সোং সোং পরীক্ষার মাধ্যমে সাংহাই সংগীত ইন্সটিটিউটে ভর্তি হন । সাংহাই সংগীত ইন্সটিটিউটে সোং সোং চীনের নামকরা সংগীত শিক্ষক ওয়েন খে চেং ও চৌ সিয়াও ইয়েনের কাছে গান শিখেন । তার শিক্ষক চৌ সিয়াও ইয়েনকে আন্তর্জাতিক সংগীত মহল ' চীনের বুলবুল' বলে প্রশংসা করেছে । দুজন শিক্ষক সোং সোংকে অনেক সাহায্য করেছেন এবং তাকে উত্সাহ দিয়ে বলেন , অভিনয়ের মঞ্চ তোমার জন্য অপেক্ষা করছে ।
সাংহাই সংগীত ইন্সটিটিউট থেকে স্নাতক হওয়ার পর সোং সোং গানের শিক্ষক হিসেবে সাংহাইয়ের একটি শিল্পকলা ইন্সটিটিউটে যোগ দেন । তবে তিনি মঞ্চে অভিনয় করা বন্ধ করেন নি । তিনি চীনের নামকরা গায়ক চান চিয়েন ই ও লিয়াও ছান ইয়োংয়ের সঙ্গে মঞ্চে অপেরায় অভিনয় করেছেন । ১৯৯৬ সালের শেষ দিকে সাংহাই সংগীত ও নৃত্য দল প্রথমবার ফরাসী ভাষায় অপেরা ' কারমেন' মঞ্চস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং প্রকাশ্যে সমগ্র চীনে পরীক্ষার মাধ্যমে গায়ক গায়িকা নির্বাচনের ব্যবস্থা নেয় । সোং সোং এ অপেরার প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেলেন । সেই বছর তিনি ফরাসী ভাষায় তার জীবনের প্রথম অপেরায় অভিনয় করেছেন ।
২০০৪ সালে অব্যাহতভাবে সংগীত শেখার জন্য সোং সোং সরকারী খরচে রাশিয়ায় লেখাপড়ার সুযোগ পেলেন । এর আগে রাশিয়ার সংগীত সম্পর্কে তার কোনো ধারণা ছিল না । তবে ছাইকোভস্কিসহ রাশিয়ার অনেক বিখ্যাত সংগীতবিদের নাম তিনি জানেন । রাশিয়ায় গিয়ে তিনি সেখানকার পরিবেশ খুব পছন্দ করেন । তিনি বলেন, রাশিয়া একটি সুন্দর দেশ । সেখানকার শিল্পকলার পরিবেশ আমি খুব পছন্দ করি । স্থাপত্য , তৈলচিত্র , ভাষ্কর্য , ব্যালে নৃত্য , সাহিত্য , কবিতা , নাটক ও চিত্রশিল্পসহ শিল্পকলার নানা ক্ষেত্রের অনেক কিছু দেখা ও শেখার জিনিস রয়েছে । সেখানে ইচ্ছা থাকলে আমি প্রতি দিন থিয়েটারে সংগীতানুষ্ঠান উপভোগ করতে পারতাম এবং দিনের বেলায় উচ্চ মানের চিত্রপ্রদর্শনী পরিদর্শন করতে পারতাম । রাশিয়ায় নানা ধরনের প্রদর্শনী ছিল । তাই আমি সময় পেলেই সেগুলো দেখতে যেতাম । রাশিয়া লেখাপড়ার অভিজ্ঞতা সত্যিই স্মরণীয় । তিনি মস্কোয় লেখাপড়া করেন , অভিনয় সৌসুমে তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গের থিয়েটারে অপেরা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন। তিনি বলেন , যদিও রাশিয়ায় ছাত্র জীবন অপেক্ষাকৃত কষ্টকর , তবে আমি সেখানে অনেক মূল্যবান জিনিস উপভোগের সুযোগ পাই । চীনে সোং সোং ইতালি ও ফ্রান্সের অপেরার গান চর্চা করেন , রাশিয়ায় গিয়ে তিনি আবার রুশ ভাষায় অপেরার গান গাওয়ার চেষ্টা করেছেন । একবার তিনি বিশ্ববিখ্যাত অপেরা ' লা বোহিমি'তে প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান । কিন্তু মঞ্চস্থ হওয়ার এক সপ্তাহ আগে সোং সোং অসুস্থ হন । তার সব বন্ধু তাকে অভিনয় বর্জনের পরামর্শ দেন । কিন্তু সোং সোং অভিনয়ের এ সুযোগ হারাতে চান না । তিনি সেলাইন বন্ধ করে মঞ্চে উঠেন । সেদিনের অভিনয় সফল হয়েছিল । গ্নেসিন সংগীত ইন্সটিটিউটের বিদেশী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এর আগে কোনো ছাত্র অপেরার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন নি । সেদিন সোং সোংয়ের শ্রুতিমধুর গান ছাড়া তার দৃঢ মনোবল সংগীত ইন্সটিটিউটের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীর মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল । ইন্সটিটিউট থেকে স্নাতক হওয়ার সময় সোং সোং ইন্সটিটিউটে একটি একক সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেন । অনুষ্ঠানে তিনি রুশভাষায় রাশিয়ার অনেক গান গেয়েছেন । তার গানগুলো ইন্সটিটিউটের শিক্ষক ও সহপাঠীদের গভীর মূল্যায়ন পেয়েছে । তাই দেশে ফিরে আসার পরও সোং সোং নেসিন ইন্সটিটিউটে ফিরে অপেরা ' লা ট্রাভিয়াটা'তে প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের আমন্ত্রণ পান । এতে তার ছোট বেলার স্বপ্ন—অপেরা ' লা ট্রাভিয়াটা'-য় অভিনয়ের আশা বাস্তবায়িত হয়েছে ।
২০০৫ সালে বিশ্ব ফ্যাসিবাদ- বিরোধী সংগ্রামে বিজয়ের ৬০তম বার্ষিকীর উদযাপনী কর্মসূচীতে অংশ নেয়ার জন্য চীনের প্রেসিডেন্ট হু চিন থাও রাশিয়া সফর করেন । একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষে প্রেসিডেন্ট হু চিন থাও মঞ্চে উঠে সোং সোংয়ের হাত ধরে তাকে চীন ও রাশিয়ার সাংস্কৃতিক বিনিময়ের দূত হিসেবে কাজ করার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন । সেদিনের কথা স্মরণ করে সোং সোং বলেন , সেদিনের কথা আমি কখনও ভুলবো না । প্রেসিডেন্ট হু আমার সামনে দাড়িয়ে আমার হাত ধরে বলেন ,তোমার গান চমত্কার । তুমি এখানে রাশিয়ার শিল্পীদের কাছ থেকে ভালোভাবে শেখার চেষ্টা কর,দেশে ফিরে গিয়ে দু' দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের দূত হিসেবে কাজ করবে ।
|