এ কন্ঠশিল্পীর নাম কো শু চেন । এ বছর তার বয়স হলো ৮২ বছর । ১৯২৭ সালে উত্তর চীনের থিয়েন চিন শহরে কো শু চেনের জন্ম । তার বাবা লেখাপড়া জানেন না , শুধু নিজের নাম লিখতে পারেন এবং সহজ হিসাব করতে পারেন । তার মায়ের গলার স্বর খুব মিষ্টি । কো শু চেন ধনী পরিবারের মেয়ে না হলেও তার বাবা- মা লেখাপড়ার গুরুত্ব জানেন , তাই মেয়েকে সময়মতো স্কুলে পাঠাতে কোনো দ্বিধা করেন নি।
। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির সময় কো শু চেন পেইচিংয়ের একটি শিল্পকলা ইন্সটিটিউটে গান শিখতে চান। সেই আমলে গান ও অভিনয় ছিল নীচ ধরনের কাজ , সমাজে শিল্পীদের কোনো মর্যাদা ছিল না । কিন্তু কো শু চেন সহজে নতি স্বীকার করতে চান নি । তিনি তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চান । তিনি বলেন , আমি ছোট বেলা থেকেই গান গাওয়া পছন্দ করি। থিয়েন চিন একটি বড় শহর । রাস্তার দু' পাশের দোকানগুলোর মাইকে নিজ দোকানের পণ্য প্রচারের পাশাপাশি পিকিং অপেরার গানসহ চীনের বিভিন্ন ঐতিহ্যিক অপেরার গান শোনানো হয় ।
আমি প্রতি দিন এ সব গান শুনি । আমার গলার স্বরও মার মতো মিষ্টি , তাই আমি ছোট বেলা থেকেই গান গাইতে পছন্দ করি । প্রাথমিক স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর একজন সংগীত শিক্ষক ক্লাসে আমাদের গানের পাঠ শেখান । পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় একজন নারী শিক্ষক আমাদের গান শিখাতেন । আমার গান প্রায়ই শিক্ষকের প্রশংসা পেত , এ শিক্ষক আমাকে অনেক বেশি পছন্দ করেন । মাধ্যমিক স্কুলের লেখাপড়া শেষ করে কো শু চেন শিল্পকলা বিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ভালো ফলাফল করেন । কিন্তু বাবা মেয়ের গান চর্চার বিরোধিতা করেন । পরের বছর কো শু চেন আরো একবার বিদ্যালয়টির ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন । শিক্ষক তাকে দেখে জিজ্ঞেস করেন , তুমি তো গত বছরই পরীক্ষায় পাশ করেছ , কেন আবার এসেছ ? কো শু চেনের ব্যাখ্যা শুনে শিক্ষক বলেন , তাহলে পরীক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই , তুমি এখানে লেখাপড়া করতে এসো । আত্মীয়সজনের পরামর্শে বাবা বাধ্য হয়ে রাজী হলেন।
এ বিদ্যালয়ে কো শু চেনের প্রথম শিক্ষক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন সংগীতবিদ , পরে তিনি চীনের নামকরা শিল্পী চাও মেই পো'র কাছে সংগীত শিখেন । চাও মেই পো ইউরোপে গান শিখেছিলেন । ১৯৫৩ সালে সংগীত ও চিত্রশিল্প শেখার জন্য চীন সরকার কিছু ছাত্রছাত্রীকে তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নে পাঠায় । কো শু চেন তাদের মধ্যে অন্যতম । তিনি মস্কোর ছাইকোভস্কি সংগীত ইন্সটিটিউটে পাঁচ বছর লেখাপড়া করেছেন । সেখানে সপ্তাহে সাত দিনের মধ্যে ৬ দিনই ক্লাস ছিল । একদিন শিক্ষক তাদেরকে একটি কঠিন সুরের স্বরলিপি লিখে রেখে পর দিন ক্লাসে বাজানোর নির্দেশ দেন । এত অল্প সময়ের মধ্যে এ কাজ সম্পন্ন করা অসম্ভব বলা যায় । ক্লাসের অনেকেই সুরটির স্বরলিপি লিখে রাখতে পারে নি । তবে কো শু চেন নির্ভুলভাবে এ সুরের স্বরলিপি লিখেছেন এবং ক্লাসে সুন্দরভাবে বাজিয়েছেন । তার বাজানো সুর শুনে শিক্ষক সন্তুষ্ট , তিনি জানেন এর জন্য কো শু চেন কত পরিশ্রম করেছেন ।
সংগীতের প্রতি প্রবল আগ্রহ ও নিরলস প্রচেষ্টার কারণে কো শু চেন সংগীত ক্ষেত্রে সাফল্য পেয়েছেন । ১৯৫৫ সালে তিনি পোলান্ডে অনুষ্ঠিত পঞ্চম বিশ্ব যুবক-যুবতীদের মহাসম্মীলনীর সংগীত প্রতিযোগিতায় তৃতীয় পুরস্কার পান । ১৯৫৭ সালে মস্কোয় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ প্রতিযোগিতায় কো শু চেন ফরাসী ভাষায় দেবুউসির একটি গান গেয়েছেন এবং ইতালীয় ,চেক ও রুশ ভাষায় বেশ কয়েকটি ক্লাসিক্যাল গান গেয়ে বিভিন্ন দেশের বিচারকের মন জয় করে প্রথম পুরস্কার পান । এ প্রসঙ্গে কো শু চেন বলেন , বিশ্ব যুবক-যুবতী মহাসম্মীলনের সংগীত প্রতিযোগিতা এক পেশাদার সংগীত প্রতিযোগিতা । প্রতিযোগিতার বিচারক কমিটির সদস্যরা হলেন বিভিন্ন দেশের নামকরা সংগীতবিদ । বিচারক কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন ইতালির একজন নামকরা সংগীতবিদ । আরেকজন বিচারক ছিলেন পোল্যান্ডের সংগীতবিদ , গত শতাব্দীর ত্রিশ-চল্লিশ দশকেই তিনি ইউরোপের নামকরা কণ্ঠশিল্পী । বিচারক কমিটি বিভিন্ন দেশের নামকরা শিল্পী ও সংগীতবিদ নিয়ে গঠিত ।
চীনের কোন কন্ঠশিল্পী এই প্রথমবার আন্তর্জাতিক সংগীত প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরষ্কার পেলো । খবর পেয়ে চীনের তথ্য মাধ্যমের অনেক সাংবাদিক থিয়েন চিনে কো শু চেনের বাসায় গিয়ে তার বাবা –মার সাক্ষাত্কার নেন । বিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ স্নাতক হিসেবে কো শু চেনের নাম সংগীত বিদ্যালয়ের সম্মানসূচক নামের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ।
বিদ্যালয়ে দীর্ঘ পাঁচ বছরের লেখাপড়া শেষ করে কো শু চেনের চীনা সহপাঠীরা দেশে ফিরে যান । সংগীত বিদ্যালয় কো শু চেনকে রাশিয়ায় আরো ছয় মাস থাকার অনুরোধ জানালেন । এ ছ' মাসে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন শহরে ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গান পরিবেশন করার সুযোগ পান । এ প্রসঙ্গে কো শু চেন বলেন , সেই সময় চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক ছিল খুব ঘনিষ্ঠ । এ ছয় মাসে আমি রাশিয়ার লেনিনগ্রাড ও ইউক্রেনসহ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠান পরিবেশন করেছি । সেই সব সংগীতানুষ্ঠানে গান ছাড়া আমি দু'টি অপেরার প্রধান অভিনেত্রীও ছিলাম ।
এ দু'টি অপেরা হল ছাইকোভস্কির ' ইউগেন ওনেগিন ' ও ইতালির সুরকার পুচনিরএকটি ক্লাসিকাল অপেরা দেশে ফিরে আসার পর কো শু চেন গান পরিবেশন ছাড়া চীনের কেন্দ্রীয় সংগীত ইন্সটিটিউটে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ।
এখন বয়স বেশি হলেও তিনি শিক্ষকতার কাজ বন্ধ করেন নি । প্রতি সপ্তাহে পাঁচ দিন তার ক্লাস নিতে হয় ।এ বছরের দশই জুলাই তার শিক্ষকতার ৬২ বছর পূর্তি উপলক্ষে পেইচিংয়ের মহাগণভবনে কো শু চেনের ছাত্রছাত্রীদের উদ্যোগে একটি বিশেষ সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে ।
এ অনুষ্ঠানে তিনি ও তার ছাত্রছাত্রীরা অপেরা ' ইউগেন ওনেগিন 'সহ অনেক গান পরিবেশন করবেন । কো শু চেন বলেন , গত কয়েক দশকে আমি ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর মধ্য দিয়ে নিজের জীবনকে সমৃদ্ধ করেছি । |