পেইচিং অলিম্পিক গেমসের এক বছর পার হয়েছে। যদিও প্রতিযোগিতার মাঠে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুহুর্ত অনেক আগেই শেষ হয়েছে। তবুও অলিম্পিক গেমসের কারণে পেইচিংয়ে যে পরিবর্তন ঘটেছে, অলিম্পিক গেমসের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে তা শেষ হয়ে যায় নি। অলিম্পিক গেমসের পর পেইচিংয়ে থাকা অনেক বিদেশী বন্ধু সত্যি সত্যি পেইচিংয়ের ব্যাপক পরিবর্তন অনুভব করেছেন। আজকের অনুষ্ঠানে কয়েক জন বিদেশী বন্ধুর তাঁদের চোখে দেখা নতুন পেইচিং সম্পর্কে আপনাদের জানাবো।
মিশর থেকে আসা আহমেদ আবুজায়িদ পেইচিংয়ে পাঁচ বছর কাজ করেছেন। এর আগে তিনি বিশ্বের অনেক শহরে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, 'পেইচিং পৃথিবীর অনেক শহরের চেয়ে ভালো। পেইচিং খুব সুন্দর, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সবুজমেখলার আয়তনও খুব বেশি। শহরটি সুশৃঙ্খল ও পরিপাটি।'
গত বছর অলিম্পিক গেমসের সময় কর্ম ব্যস্ততার কারণে তিনি মাঠে প্রতিযোগিতা উপভোগ করতে পারেন নি। কিন্তু অলিম্পিকের পর তিনি কয়েক বার অলিম্পিক পার্ক, বার্ড নেস্ট, ওয়াটার কিউবিকসহ অলিম্পিক গেমসের স্টেডিয়ামে গিয়েছেন এবং অনেক ছবি তুলেছেন। তিনি বলেন, এটা হলো তাঁর সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি। স্বদেশে ফেরার পর তিনি আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের সঙ্গে উপভোগ করবেন। তিনি মনে করেন, অলিম্পিকের পর পেইচিং আরো আকর্ষণীয় হয়েছে। তিনি বলেন, 'আগে আমি পেইচিংয়ে সবসময় পুরাতন বাস ও পাতাল রেল করে বাইরে যেতাম। তখন পেইচিংয়ের পরিবহনের কিছু সমস্যা ছিল। অলিম্পিকের পর অবিশ্বাস্য ব্যাপার, আমরা আধুনিক পাবলিক বাস ব্যবহার করছি, এ গাড়িতে দুটি এল.সি.ডি মনিটর আছে। সড়কপথও সুষ্ঠুভাবে নির্মিত হয়েছে। পাতাল রেলের লাইনও আরো জটিল হয়েছে।'
তিনি সংবাদদাতাকে ঠাট্টা করে বলেছেন, তিনি জানেন, চীন সরকার এ সব বুনিয়াদী ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য অনেক অর্থ ব্যয় করেছে। নিঃসন্দেহে পেইচিং ও সারা চীনের জনগণের প্রচেষ্টায় এ পরিবর্তন হয়েছে। কেবল অর্থ দিলে তা বাস্তবায়িত হতো না।
পেইচিংয়ের বুনিয়াদী ব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া আহমেদের চোখে পেইচিংবাসীদের জীবনযাপন ও আচরণও চুপে চুপে বদলে যাচ্ছে। তিনি বলেন, চীনারা বন্ধুত্বপূর্ণ, কিন্তু অপেক্ষাকৃত চাপা স্বভাবের। তিনি চীনে আসার পর সবসময় মনে করতেন, রাস্তায় কেউ তাঁকে দেখে হাসি মুখ দেখাবে না এবং তাঁর সঙ্গে বিনিময় করবেন না। একসময় তার এ ধারণা পাল্টে যায়। তিনি মনে করেন, চীনারা আসলে তেমন উষ্ণ লোক নয়। কিন্তু পেইচিং অলিম্পিক গেমসের আগে চীনের টেলিভিশনে প্রায়শই ছোট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শহরবাসীদের আরো উষ্ণ ও আতিথেয়তা প্রকাশের পদ্ধতি শেখানো হয়। বিশেষ করে বিদেশী পর্যটকের সামনে মৃদুহাসি দেখান। আহমেদ পেইচিংবাসীদের পোশাকের পরিবর্তনের দিকটিও লক্ষ্য করেছেন। তিনি বলেন, 'পেইচিংবাসীদের পোশাক পরার অভ্যাসেরও কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। যেমন যারা ঘরের বাইরে কাজ করেন, আগে গরম কালে তারা প্রায়শই শার্ট খুলে কাজ করতেন। অলিম্পিক গেমসের আগে চীন সরকার টেলিভিশন ও অন্যান্য তথ্য মাধ্যমের মাধ্যমে শ্রমিকদের জানিয়েছে যে, এভাবে করলে নিজের ভাবমূর্তি নষ্ট হয় এবং অন্যের কাছেও অভদ্রতা প্রকাশ পায়। ফলে এখন রাস্তায় এমন লোক খুব কম দেখা যায়। বুঝা যায়, চীন সরকারের সাধারণ মানুষের কুঅভ্যাস বদলানোর উপায় কার্যকর হয়েছে।'
আহমেদ বলেন, এখন পেইচিংয়ের রাস্তায় ইচ্ছা করে থুথু ফেলার লোক খুব কম দেখা যায়। কুকুর নিয়ে ঘুরে বেড়ানো লোকেরাও যথাসময়ে পোষা প্রাণীর মল পরিষ্কার করেন। এ ভাল অভ্যাসগুলো কম বেশি অলিম্পিকের প্রভাবের কারণে সৃষ্টি হয়েছে।
ফরাসী অ্যানটোনিও লাগালা গত বছর পেইচিংয়ে চাকরি করতে এসেছেন। এখন তিনি একটি সংবাদ মাধ্যমে কাজ করেন। তাঁর মতে অলিম্পিক গেমস পেইচিংয়ে সবচেয়ে ভালো উত্তরাধিকার রেখে দিয়েছে, তা হলো উন্নত আবহাওয়ার গুণগত মান। তিনি বলেন, 'অলিম্পিক গেমসের সময় পেইচিংয়ের আবহাওয়া ছিল অত্যন্ত ভালো। কারণ প্রতিদিন প্রায় অর্ধেক সংখ্যক মোটরগাড়ির বাইরে যাওয়া নিষেধ। যদিও এখন প্রতিদিন নিষিদ্ধ গাড়ির সংখ্যা অলিম্পিক গেমসের সময়ের চেয়ে কম। তবে আবহাওয়া অলিম্পিকের আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়েছে। আমি মনে করি, এটা হচ্ছে অলিম্পিক গেমস পেইচিংয়ের শহরবাসীদেরকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উত্তরাধিকার।'
গত বছর অলিম্পিক গেমসের পর পেইচিংয়ে মোটরগাড়ির জোড়-বেজোড় সংখ্যা অনুযায়ী অস্থায়ী যাতায়াত নিষিদ্ধ ব্যবস্থা বন্ধ করেছে। এর পরিবর্তে প্রতি কাজের দিন কেবল ২০ শতাংশ মোটরগাড়ির যাতায়াত নিষেধ করা হয়। ক্রোয়েশিয়া থেকে আসা আলবার্তিনা নেজেভিচ পেইচিংয়ে চার বছর কাজ করেছেন। তিনি মনে করেন, স্বল্প সংখ্যক গাড়ির রাস্তায় বের না হওয়া পেইচিংয়ের পরিবর্তিত আরামদায়ক পরিবেশের জন্য সত্যিই প্রশংসনীয় ব্যাপার। তিনি বলেন, 'আমাদের জন্য এটা অবশ্যই একটি ভালো ব্যবস্থা। আমি তা সমর্থন করি। পরিবেশ সুরক্ষার জন্য চীন নানা ক্ষেত্রে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। পেইচিং এক মহানগর হলেও আমি দেখেছি যে, ৮০ শতাংশ সময় পেইচিংয়ের আকাশ পরিষ্কার নীল। পেইচিংয়ের আবহাওয়া বিশ্বের যে কোন জায়গার তুলনায় খারাপ হবে না। বরং আরো অনেক ভালো।'
অলিম্পিকের পর পেইচিংয়ের অধিবাসীরা আগের চেয়ে ক্রীড়া ও ব্যায়াম করতে আরো বেশি পছন্দ করেন। এটা আলবার্তিনার মনে গভীর দাগ কেটেছে। তিনি বলেন, 'ক্রীড়া সংস্কৃতির জনপ্রিয়তা হচ্ছে অলিম্পিকের পর পেইচিংয়ের সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের অন্যতম। যদিও চীনের হাজার বছরের সংস্কৃতির মধ্যে ক্রীড়া সংস্কৃতি রয়েছে। তবে তা নবায়ন করা দরকার। অলিম্পিক গেমস তরুণ তরুণী ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য নতুন ক্রীড়া মর্ম বয়ে এনেছে। তুমি দেখতে পাবে, অনেক লোক ঘরের বাইরে ব্যায়াম করেন।'
এ ক্ষেত্রে আহমেদেরও রয়েছে একই অনুভূতি । তিনি বলেন, 'আমার বাড়ির ভবনের নিচে একটি বড় বাগান আছে। আমি লক্ষ্য করেছি, আগে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় কেউ কেউ বাগানে ব্যায়াম করেন। কিন্তু এখন আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখেছি, ব্যায়াম করার লোক অধিক থেকে অধিকতর হয়েছে। কমপক্ষে আগের দ্বিগুণ হয়েছে।'
আলবার্তিনা বলেন, অলিম্পিক স্টেডিয়ামের পুনর্ব্যবহার হচ্ছে ক্রীড়া সংস্কৃতির একটি অংশ। কিছু দিন আগে পেইচিং অলিম্পিকের সাঁতার স্টেডিয়াম—ওয়াটার কিউব উন্মুক্ত হয়েছে। দর্শকরা ৫০ ইউয়ানের টিকিট কিনে জাতীয় পর্যায়ের স্টেডিয়ামে সাঁতার কাটতে পারেন। আহমেদ এর প্রশংসা করেছেন।
কিছু দিন আগে পেইচিং অলিম্পিক গেমসের প্রধান স্টেডিয়াম – বার্ড নেস্টে ইতালি সুপার কাপ প্রতিযোগিতা ও নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে। অ্যানটোনিও আশা করেন, এ সব আয় কল্যাণমূলক কাজে ব্যবহৃত হবে। (ইয়ু কুয়াং ইউয়ে) |