এ বছর চীনের উদ্যোগে আয়োজিত রাশিয়া ভাষা বর্ষ । তাই আজকের সংস্কৃতি সম্ভার অনুষ্ঠানে চীনের একজন নামকরা সুরকারের কাহিনী আপনাদের জানাবো আমি ফোং সিউ ছিয়েন । এ সুরকারের নাম উ চু ছিয়াং । এ বছর তার বয়স হলো ৮২ বছর । তার জীবন সবসময় সংগীতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত । পঞ্চাশেরর দশকে উ ছু ছিয়াং তখনকার সোভিয়েত ইউয়ানে পড়াশুনা করেছেন ,তখনকার সেই অভিজ্ঞতা তার সুর রচনার ভিত্তিকে শক্ত করেছে ।
পেইচিংয়ে উ চু ছিয়াংয়ের জন্ম । তার বাবা একজন চিত্রশিল্পী । তিনি চীনের রাজপ্রাসাদ যাদুঘরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা । ৯ বছর বয়সের সময় বড় বোনের পিয়ানো বাজানো সুর শুনে উ চু ছিয়াংয়ের খুব ভালো লেগে যায় । তখন থেকেই তিনি সংগীত চর্চা করতে শুরু করেন । এক দিন তিনি হঠাত্ পিয়ানোতে সহজ ধরনের একটি সুর বাজান , তার বাজানো সুর শুনে বাবা মা ও বড় বোনসহ সবাই অবাক হয়ে যান । তাই তারা উ চু ছিয়াংয়ের জন্য সংগীত শেখার ব্যবস্থা করেন । ১৯৪৭ সালে উ চু ছিয়াং নানচিং সংগীত ইন্সটিটিউটে ভর্তি হন , সেখানে তিনি শিক্ষক চিয়াং তিন সিয়েনের কাছে সুর রচনা শিখতে শুরু করেন । ১৯৫২ সালে ইন্সটিটিউট থেকে স্নাতক হওয়ার পর তিনি তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নে যান । উ চু ছিয়াং সোভিয়েত ইউনিয়নের মস্কোর ছাকোভস্কি সংগীত ইন্সটিটিউটের সুর রচনা বিভাগে পড়াশুনা করেন । সেখানে তিনি দীর্ঘ পাঁচ বছর ছিলেন । এ প্রসঙ্গে উ চু ছিয়াং বলেন , সোভিয়েত ইউনিয়নে আমি পাঁচ বছর ছিলাম । সেখানকার নিয়ম খুব কড়া ছিল , প্রথম দু' বছর ছুটির সময়ও দেশে ফিরে আসতে পারি নি । তবে ছুটির সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ আমাদের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে নিয়ে যায় । আমি সাইবেরিয়াসহ সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক স্থান ভ্রমণ করেছি । সোভিয়েত ইউনিয়নের সহপাঠীদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ ছিল ।তখন চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ের সম্পর্কও ভালো ছিল। রাশিয়ার ভাষা আয়ত্ত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশেষভাবে চীনা ছাত্রছাত্রীদের জন্য রাশিয়ার ভাষা শেভার ক্লাসের ব্যবস্থা নেয়। লেখাপড়ায় চীনা ছাত্রছাত্রীরা প্রায়শ্যই শিক্ষকদের প্রশংসা পেতেন ।
উ চু ছিয়াং আরো বলেন ,সোভিয়েত ইউনিয়নের সহপাঠীদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব ভালো ছিল। আমার এখনও মনে আছে , চীনের কেন্দ্রীয় সংগীত ইন্সটিটিউট শিক্ষার জন্য একটি রাশিয়ার ভাষার পাঠ্যবই পাওয়ার চেষ্টা করেছিল । তবে অনেক খুঁজেও পায় নি । এর জন্য শিক্ষকরা খুব চিন্তিত ছিল। খবর পেয়ে আমি আমার এক সহপাঠীকে এ বিষয়টি জানালাম । এ সহপাঠী তার নিজের বই আমাকে উপহার দিলেন । আমি সঙ্গে সঙ্গেই এ বই দেশে পাঠিয়ে দিলাম । পরে এ বই চীনা ভাষায় অনুদিত হয়ে চীনের কেন্দ্রীয় সংগীত ইন্সটিটিউটে বহু বছর ব্যবহার করা হয়েছে । সোভিয়েত ইউনিয়নের সহপাঠীদের সঙ্গে উ চু ছিয়াংয়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আজ পর্যন্ত বজায় রয়েছে । তিনি একাধিকবার তার রাশিয়ার সহপাঠীকে চীনে সফর ও লেকচার দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন । তিনি বলেন , রাশিয়ার বন্ধুদের সঙ্গে আমার এখনও যোগাযোগ আছে । সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়াশুনার সময়কালীন আমার একজন রুমমেট এখন একজন সংগীত দলের পরিচালক । আমার আমন্ত্রণে তিনি চীনে দুবার এসেছেন । তিনি চীনে এসে সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন এবং চীনা ছাত্রছাত্রীদের প্রশিক্ষণের কাজও করেছেন । এ বছরের সংগীতানুষ্ঠানে আমি আবার তাকে আমন্ত্রণ জানাবো । নানা কারণে দুটি দেশের সম্পর্কের পরিবর্তন হতে পারে , তবে সাধারণ মানুষের মধ্যেকার সম্পর্ক কখনো পরিবর্তিত হবে না ।
সোভিয়েত ইউনিয়নে পাঁচ বছরের লেখাপড়ার জীবন উ চু ছিয়াংয়ের সুর রচনার দৃঢ ভিত্তি স্থাপন করেছে । দেশে ফিরে আসার পর তিনি চীনের কেন্দ্র্রীয় সংগীত ইন্সটিটিউটে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন । এর পাশাপাশি উ চু ছিয়াং অনেক সুর রচনা করেন । সুর রচনার সময় তিনি চীনের ঐতিহ্যিক লোকসংগীতের সঙ্গে সিম্ফোনী সুরের সম্বনয় করে মিশ্র সুর রচনা করেছেন । এ ধরনের সুর চীনে তথা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক সমাদর পেয়েছে । নৃত্যনাট্য ' ইয়ু মেই রেন' ও ব্যালেনৃত্য ' হোন সে নিয়ান চি চুন'-এর সুরও উ চু চিয়াং রচনা করেছেন । এ দু'টি নৃত্যনাট্যের সুর তার ঐতিহ্যিক সুর ও সিম্ফোনী সুরের সমন্বয়ের অনন্য দৃষ্টান্ত বলা যায় । ১৯৭৩ সালে উ চু ছিয়াং চীনের লোকসংগীতবিদ হুয়া ইয়েন চুনের রচিত ' আর ছুয়েন ইং ইউয়ে ' নামে চীনের লোকসংগীতের বাদ্যযন্ত্র আর হু সুরের ভিত্তিতে আর হু সুরের সঙ্গে অকেস্ট্রা সুর মিশিয়ে দেন । ফলে এ সুর আরো হৃদয়গ্রাহী হয়েছে । ' আর ছুয়েন ইং ইউয়ে ' ছাড়া উ চু ছিয়াং ' থিং সুন ' ' ছুন চিয়াং হুয়া ইউয়ে ইয়েসহ অনেক ঐতিহ্যিক সুরে পাশ্চাত্য সুরের উপাদান মেশানোর চেষ্টা করেছেন । এ প্রসঙ্গে উ চু ছিয়াং বলেন , আমি রাশিয়ায় থাকাকালে শুধু রাশিয়ার সংগীতের বৈশিষ্ট্যই শিখি নি । রাশিয়ার সংগীতবিদদের ক্লাসিক্যাল সুর ও ইউরোপের সংগীতের বৈশিষ্ট্যকে বেশি গুরুত্ব দেয় । আমার ধারণা, সংগীতে জাতীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় । তাই আমি বিদেশী সুরের গ্রহণযোগ্য আবেগময় উপাদান চীনের সংগীতে মেশানোর চেষ্টা করেছি ।
১৯৮২ সালে উ চু ছিয়াং চীনের কেন্দ্রীয় সংগীত ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালকের দায়িত্ব নেন । তার এ দায়িত্ব ১১ বছর স্থায়ী ছিল । তাছাড়া তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগীত প্রতিযোগিতার বিচারকও নির্বাচন ছিলেন । ১৯৮৫ সালে তিনি চীনের সংগীতবিদ সমিতির ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন । তিনি চীনের সংগীতবিদ হিসেবে তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন , ও চেকস্লোভাকিয়া এবং ব্রিটেন ও জাপান সফর করেছেন । ব্যস্ত হলেও উ চু ছিয়াং কখনও তার শিক্ষকতার কাজ বন্ধ করেন নি । এখন তার বয়স বেশি বলে আর ইন্সটিটিউটের প্রশাসনিক কাজ করেন না , তবে মাঝেমধ্যে তিনি সেখানে ক্লাস নেন । তিনি বলেন , তিনি ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে থাকতে পছন্দ করেন ।
দু' বছর আগে উ চু ছিয়াংয়ের আশিতম জন্মদিন উপলক্ষে চীনের অকেস্ট্রা দলের উদ্যোগে একটি বিশেষ সংগীতানুষ্ঠান আয়োজন করা হয় । এ অনুষ্ঠানে উ চু ছিয়াংয়ের বিভিন্ন সময় রচিত বিভিন্ন বিষয়ের সুর বাজানো হয়েছে । উ চু ছিয়ানের কয়েক দশকের সংগীত চর্চায় চীনের সংগীত ব্রতের গতিপথ এবং চীন ও রাশিয়ার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিফলিত হয়েছে । |