৪৪ বছর বয়স্ক নারেন কাওয়া সিনচিয়াং উইগুর স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলের একজন মঙ্গোলীয় কর্মকর্তা ও প্রকৌশলী । তার নিজের ছেলেমেয়ে নেই । কিন্তু গত ১৬ বছরে তিনি মায়ের স্নেহ-ভালবাসা আর মমতা দিয়ে ৫জন মেয়েকে লালন পালন করেছেন ।
৮ বছর আগের শীতকালের এক দিন নারেন কাওয়া সিনচিয়াংয়ের রাজধানী উরুমোচি রেল স্টেশনে গিয়ে মধ্য চীনের হোনান প্রদেশ থেকে আগত ওয়াং ইয়ে চি নামে একটি মেয়েকে স্বাগত জানান । ওয়াং ইয়ে চি হোনান প্রদেশের গ্রামাঞ্চল থেকে এসেছে । ১২ বছর বয়সে সে লেখাপড়া বন্ধ করে শহরের একটি মাংস দোকানে চাকরি করতো । সে খুব পরিশ্রমী ছিল । অল্পবয়সের কারণে অসাবধানতাবসত তার হাত গরম পানিতে ঝলসে গিয়ে আহত হয় । নারেন কাওয়া হোনান প্রদেশের রাজধানী চেংচৌতে কর্মরত তার মায়ের কাছ থেকে এ খবর জেনেছেন । ওয়ান ইয়ে চি'র বাবা মায়ের অনুমতি নিয়ে তিনি মেয়েটিকে সিনচিয়াংয়ে এনেছেন । পড়াশুনার জন্য তিনি প্রথমে তাকে স্কুলে পাঠাতে চাইলেন । কিন্তু তার লেখাপড়ার ভিত্তির দুর্বলতার কারণে তিনি বাড়িতে তাকে পড়াতেন । তিনি বহু দিন রাত তার কাছে ছিলেন এবং অনবরতভাবে তাকে পড়াতেন । নারেন কাওয়া বলেন ,
যখন ইয়ে চি'র বয়স ১৪ বছর , তখন নারেন কাওয়া লেখাপড়ার জন্য তাকে স্কুলে পাঠান । বয়সের হিসেবে তাকে মাধ্যমিক স্কুলে পড়তে হতো , কিন্তু ভিত্তির দুর্বলতার কারণে তাকে প্রাথমিক স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়তে হতো । সে অন্য সহপাঠীদের চেয়ে আনেক লম্বা ছিল । এ ক্ষেত্রে তার বেশি চাপ ও চিন্তা ছিল । অন্যদের সঙ্গে বিনিময়ের সুবিধার জন্য নারেন কাওয়া তাকে চীনের স্ট্যান্টার্ড ভাষা- ফুথুংহুয়া শিখতে উত্সাহ দেন ।
নারেন কাওয়ার সাহায্যে ওয়াং ইয়ে চি অধ্যবসায়ের সঙ্গে লেখাপড়া করে , চীনের স্ট্যান্টার্ড ভাষা-ফুথুংহুয়া ভালভাবে আয়ত্ত করে এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মাধ্যমিক পেশাগত প্রযুক্তিগত বিদ্যালয়ে ভর্তি হয় । বর্তমানে সে সরকারী প্রতিষ্ঠানের একজন কারিগরে পরিণত হয়েছে । ওয়াং ইয়ে চি পরিশ্রমী এবং কাজে ব্যস্ত থাকে । গভীর রাত পর্যন্ত সে কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ করে থাকে , সে আগ্রহের সঙ্গে বাড়ির কাজও করে । এ সব অবস্থা দেখে নারেন কাওয়া খুব আনন্দিত । তিনি মা হিসেবে এক ধরনের স্নেহময়ী মায়ের অশেষ গৌরবও বোধ করেন ।
ইয়াং ইয়ান হুয়া নামের একটি মেয়ে পশ্চিম চীনের কানসু প্রদেশ থেকে এসেছে । দারিদ্র ও মায়ের অসুস্থতার কারণে সে নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলের লেখা-পড়াও শেষ করতে পারে নি । এর পর সে কৃষি কাজ শুরু করে । ইয়াং ইয়ান হুয়া কানসু প্রদেশের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে । তার কথা বুঝতে পারা খুব কঠিন । সুতরাং তার জন্য উপযোগী চাকরি পাওয়াও খুব কঠিন ।
তিনি মেয়েটির চাকরি ও ভবিষ্যতের জন্য খুব চিন্তিত পড়েন ।
উরুমুচিতে নিশ্চিন্তে থাকতে মেয়েটিকে সাহায্য করার জন্য নারেন কাওয়া অনেক চেষ্টা করেন । প্রথমে অন্য লোকজনের সঙ্গে মেয়েটির ভাষা ও বিনিময়ের দক্ষতা যাতে বেড়ে যায়, সেজন্য রাস্তার পাশে পত্র-পত্রিকা বিক্রির ব্যবসা করার জন্য তিনি মেয়েটিকে সহায়তা করেন । প্রথমে নারেন কাওয়াও লজ্জা পেতেন , তিনি পরিচিত লোকজনের সঙ্গে দেখা করতে ভয় পেতেন । গোটা শীতকালই যখন নারেন কাওয়ার অফিসের কাজ শেষ করতেন , তখন তিনি রাস্তার পাশে গিয়ে মেয়েটির ব্যবসায় সাহায্য করতেন। রাত ১০টা না বাজা পর্যন্ত তিনি কখনো বাড়িতে ফিরে যেতেন না । অফিসের কাজ ছাড়া তিনি প্রতিদিন পত্র-পত্রিকা বিক্রির কাজে ব্যস্ত থাকতেন । কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি ও তার এ মেয়ের বই ও পত্র-পত্রিকা বিক্রির ব্যবসা ভাল হয়েছে এবং তারা অনেক আয়ও করেছেন । তাদের প্রচেষ্টায় এখন তাদের একটি বড় বইয়ের দোকানও গড়ে উঠেছে । প্রত্যেক মাসে তারা সরকারের কাছে ২ হাজার ইউয়ানেরও বেশি আয় কর জমা দেন । এখন ইয়াং ইয়ান হুয়া বিয়ে করেছে , তার ও একটি ছেলে সন্তান নিয়ে এখন গড়ে উঠেছে একটি সুখী পরিবার । সে বলেছে,
এখন নিজের ছেলে আছে । এ সুন্দর সংসারের জন্য সে নারেন কাওয়ার প্রতি খুব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ।
চৌ ছুই হুয়া নামে আরেকটি মেয়ে ছিল খুব গরীব । উরুমুচিতে লেখাপড়ার জন্য সে দূরের একটি পাহাড়ী বনাঞ্চল থেকে এসেছে । ১০ বছর আগে এক দিন দুপুরেবেলা নারেন কাওয়া একটি ছোট রেস্তোরাঁয় বসে খাচ্ছেন । চা দেয়ার জন্য একটি হাল্কা-পাতলা গড়নের মেয়ে তার সামনে এসে হাজির হয় । তখন রেস্তোরাঁয় লোকজনের ভিড় ছিল । মেয়েটি খুব ভালভাবে নারেন কাওয়ার সেবা করে । এতে নারেন কাওয়া খুব মুগ্ধ হন। তখন থেকে তারা দু'জনের মধ্যে মা ও মেয়ের মতো এক ধরনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন ।
নারেন কাওয়ার সাহায্য ও যত্নে চৌ ছুই হুয়া পুনরায় লেখাপড়া শুরু করে । অধ্যবসায়ের সঙ্গে লেখাপড়া করে মাধ্যমে সে চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় । স্নাতক হওয়ার পর তার উপযোগী একটি চাকরি পাওয়ার জন্য নারেন কাওয়া বহু বন্ধু বান্ধবের কাছে আবেদন জানান । অবশেষে চৌ ছুই হুয়া একটি উপযুক্ত চাকরি পেয়েছে । সে আবেগের সঙ্গে বলে,
নারেন কাওয়ার কাছ থেকে মায়ের মতো আদর ও স্নেহ-মমতা পেয়ে চৌ ছুই হুয়া বিশেষভাবে মুগ্ধ হয় । সে বিয়ে করেছে এবং এখন তার একটি ৪ বছর বয়সী মেয়ে আছে । কাজের অবসরে সে অব্যাহতভাবে লেখাপড়া করছে । সে বলে , মা নারেন কাওয়া জীবন গড়ার জন্য তাকে অনেক সাহায্য করেছেন , চাকরি ও ভবিষ্যতের জন্য তাকে বহু দক্ষতা শিখিয়েছেন । নারেন কাওয়ার উত্সাহে নতুন জ্ঞান ও প্রযুক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে সে অব্যাহতভাবে চেষ্টা করছে । সে নিজের মেয়েকে একটি ভাল দৃষ্টান্ত স্থাপনের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ । সে নারেন কাওয়ার মতো একজন যোগ্য ও স্নেহময়ী মা হতে চায় ।
মঙ্গোলীয় ভাষায় 'নারেন কাওয়া' অর্থ ' সুন্দর সূর্য' । ২০০৯ সালে নারেন কাওয়া সিনচিয়াংয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ ১০জন মায়ের অন্যতম হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ।
(থান ইয়াও খাং) |