v চীনের বিশ্ব কোষv চীন আন্তর্জাতিক বেতারv বাংলা বিভাগ
তিন জন তামিল বিশেষজ্ঞের চোখে পেইচিংয়ের বিগত ৩০ বছর
2009-07-31 21:03:07

চীনের সংস্কার ও উন্মুক্তকরণ নীতি চালু করার প্রক্রিয়ায় অধিক থেকে অধিকতর বিদেশী বন্ধু চীনে এসে কাজ করেন এবং জীবন কাটান। সিআরআই'র তামিল বিভাগ প্রতিষ্ঠার পর ৪৬ বছর ধরে ভারত ও শ্রীলংকা থেকে আসা বহু বিদেশী বিশেষজ্ঞ এ বিভাগে কাজ করেছেন।

কাদিকা ছালাম ছিলেন তামিল বিভাগে সবচেয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করা সিনিয়র বিশেষজ্ঞ। ১৯৮৩ সালে তিনি প্রথমবার পেইচিং আসেন। ২০০৪ সালে তিনি ভারতে ফিরে যান। তিনি চীনে একটানা প্রায় ২০ বছর ছিলেন। এ বিশ বছরে তিনি স্বচক্ষে চীনের বিরাট পরিবর্তন দেখেছেন। তিনি গর্বের সঙ্গে বলেছেন, তিনি দিনে দিনে একটি উন্মুক্ত হওয়া চীন দেখেছেন। বিদেশের উন্নত প্রযুক্তি ও উন্নয়নের অভিজ্ঞতা নিরন্তরভাবে চীনে প্রবেশ করেছে। তিনি স্মরণ করে বলেন, সংস্কার ও উন্মুক্তকরণের প্রথম দিকে প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঘাটতি ছিল। তখন দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় যে কোন পণ্য কিনতে চাইলে বিশেষ টিকিট দিয়ে কেনতে হত। দশ বছর পর চীনের সুপারমার্কেটে বিবিধ সব পণ্য পাওয়া যায়। এমন কি বহু দোকানে বিদেশী পণ্যও বিক্রি হয়। ১৯৯৯ সালে যখন তিনি তৃতীয়বার চীনে আসেন তখন তিনি লক্ষ্য করেছেন, পূর্বে গ্রামের মত নগর সত্যিকারের আধুনিক মহানগরে পরিণত হয়েছে। কারণ এখানে এক একটি উঁচু ভবন ও চওড়া রাস্তা নির্মিত হয়েছে। ছালামের মাসিক বেতনও প্রথম দিকের কয়েক শ ইউয়ান থেকে বেড়ে প্রায় দশ হাজার ইউয়ানে দাঁড়িয়েছে।

'বিংশ শতাব্দীর আশি'র দশকের প্রথম দিকে চীনের দরজা সবেমাত্র খুলেছে। তখনকার নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের অভাবের কথা এখনো আমার স্পষ্টভাবে মনে আছে। আমি পেইচিংয়ে আসার পর নতুন বাসা সাজানোর জন্য একটি সুন্দর জানালার পর্দাও কিনতে পারতাম না। সুতিকাপড়েরও সরবরাহের চেয়ে চাহিদা ছিল বেশি। আমরা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনার জন্য বিদেশী বিনিময় পত্র নিয়ে বাসে করে অনেক দূরের মৈত্রী দোকানে যেতাম। রান্নার সময় স্বযত্নে ময়দা ব্যবহার করতে হতো। সে সময়ের ক্ষুদ্র খাদ্য টিকিট আমার মনে সবচেয়ে গভীর ছাপ রেখেছে।'

২০০৩ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে আসা রাজারাম তাঁর বন্ধুদের সতর্কতামূলক কথার মধ্য দিয়ে চীনে তাঁর নতুন কর্মজীবন শুরু করেছেন। বাস্তব কর্মকান্ড ও জীবনযাপনের মাধ্যমে আগেকার ভুল বুঝাবুঝি দূর হয়েছে। চীনের প্রতি তাঁর সম্পূর্ণ নতুন উপলব্ধি সৃষ্টি হয়েছে। চীন উন্মুক্ত হওয়ার পর খোলা দরজানীতিতে যে কেবল পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অভ্যর্থনা করেছে তা নয়, বরং বিভিন্ন ধরনের জীবনযাপনের পদ্ধতির ভিত্তিতে যুবকরা আরো তত্পর হয়েছে। রাজারাম বলেন, চীনাদের ধাপে ধাপে উন্মুক্ত ও আন্তরিক মনোভাব চীনের বৈদেশিক আদান-প্রদানের ভিত্তি স্থাপন হয়েছে।

'আমি চীনে আসার সময় চীনের নতুন সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে। তখন থেকে রেলগাড়ির গতিবেগ বৃদ্ধির কাজ শুরু হয়। আমি আর আমার এক সহকর্মী রেলগাড়িতে করে শাওলিন মন্দির ও শেচেনে গিয়েছিলাম। ট্রেনে করে পেইচিং থেকে শাংহাই যেতে তখন কেবল দশ ঘন্টা সময় লাগে। আমি নিরন্তর দ্রুততর হওয়া 'চীনের গতি' এ কথাটা বুঝতে পেরেছি। বিদেশী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো চীনে বিনিয়োগ করার পাশাপাশি চীনের জাতীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোও বিভিন্ন দেশে প্রবেশ করেছে। চীনের লেনোভো ও হাইয়ারসহ ট্রেডমার্ক ভারতে সবাই জানে।'

ছালাম ও রাজারামের তুলনায় এখন পেইচিংয়ে কর্মরত মারিয়া মাইকেল ও তাঁর স্ত্রী ম্যারি ফ্রাস্কাল আরো সৌভাগ্যবান। তাঁরা বর্তমান চীনের সমৃদ্ধ বস্তুগত জীবন উপভোগ করার পাশাপাশি সুবিধাজনক পাতাল রেলে বার্ড নেস্টে গিয়ে অলিম্পিক গেমসের প্রতিযোগিতা দেখতে পারেন, জাতীয় থিয়েটারে অপেরা উপভোগ করতে পারেন এবং নতুন করে সাজানো ছিয়েনমেন রাস্তায় গিয়ে নবীন ও প্রাচীন পেইচিং মহানগর অনুভব করতে পারেন।

বন্ধুরা, আপনারা মাইকেলের গাওয়া চীনা গানের রেকর্ডিং শুনছেন। এ আনন্দময় চীনা গানে মাইকেল ও তাঁর স্ত্রীর আরেক জীবন শুরু হল। পেইচিংয়ে দু'বছর থাকার পর তাঁরা চীনের স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে অভ্যাস্ত হয়েছেন। তাঁরা প্রতিবেশীদের সঙ্গে ব্যায়াম করেন। তাঁদের জীবনযাপনের ধারা আস্তে আস্তে চীনাদের মতো হয়ে যাচ্ছে।

কাজের অবসরে মাইকেল ও তাঁর স্ত্রীর সবচেয়ে বড় শখ হচ্ছে ভ্রমণ। তাঁরা পেইচিং শহরে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন। ব্যস্ততম ওয়াংফুচিং থেকে ঐতিহ্যবাহী হুথো, সুমহান প্রাচীর থেকে তাঁদের বাড়ির নিকটের পার্কসহ নানা জায়গায় তাঁদের পদচিহ্ন রয়েছে। তা ছাড়া, তাঁরা থিয়েনচিন, শাংহাই, সিআন ও কুইচৌ শহরও ভ্রমন করেছেন। বিমান করে চীনের আকাশে উড্ডয়ন করতে তাঁদের খুব ভালো লাগে। যদিও তাঁদের চীনা ভাষা খুব ভালো নয়, তবু ভাষা না বুঝতে চীনে তাঁদের ভ্রমণ করা বা সাধারণ জীবনের কোন বাধা সৃষ্টি হয় নি। ম্যাচিলের স্ত্রী ফ্রাস্কাল চীনের তৈরি পণ্যের ওপর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, 'বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য দেখে আমার খুব কেনার ইচ্ছা হয়। শাংহাইয়ের চেংহুয়াংমিয়াও হোক, সিআন শহরের পশ্চিম রাস্তা হোক, পেইচিংয়ের ক্ষুদ্র পণ্য বাজার হোক, প্রতিটি জায়গা গিয়ে আমি আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের জন্য অনেক উপহার কিনেছি। আমার মা চীনের রেশমী দিয়ে তৈরি শাড়ি খুব পছন্দ করেন। ভাবতে পারতাম না, শাড়ি ভারতের ঐতিহ্যিক পোশাক হলেও চীনের উত্পাদিত সস্তা ও সুন্দর শাড়ি আরো বেশি জনপ্রিয়।'

ফ্রাস্কাল চীনে আসার আগে কেনিয়াকুমারী মাধ্যমিক স্কুলের একজন শিক্ষিকা ছিলেন। তাঁর স্বদেশে ৯০ শতাংশ বিবাহিত মহিলা হচ্ছেন গৃহিণী। দু'বছর আঘে তিনি স্বামীর সঙ্গে ভারত ত্যাগ করার সময় তিনি গৃহিণী হওয়ার প্রস্তুত নিয়েছেন। কিন্তু তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। ২০০৮ সালে তিনি চীনের গণ যোগাযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু বিদেশী শিক্ষকের অন্যতমে পরিণত হয়েছেন। এ খবর জেনে ফ্রাস্কাল উত্তেজিত হয়ে বলেছেন, তাঁর চীনা স্বপ্ন সবেমাত্র শুরু হলো।

ম্যাচিল দম্পতির মতো এখন অনেক বিদেশী বন্ধু চীনে চাকরি করতে বা থাকতে আসেন। 'চীনা স্বপ্নের' আকর্ষণে আরো বেশি ভারতীয় ব্যক্তিরাও চীনে আসছেন। ম্যাচিল বলেন, তাঁর বন্ধু মোহান বান্দারি ও রাজিব সিংও তাঁদের মতো চীনে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন।

ইউগা কোচ্ মোহন বান্দারি তিনি বছর আগে ভারতের ইউগার পবিত্র স্থান –রিশিকেশ থেকে চীনে এসে ইউগা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ পর্যন্ত সারা চীনে তাঁর ৫১টি ইউগা শেক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

২৭ বছর বয়সী রাজিভ সিং ভারতের আসাম রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেছেন। চার বছর ঘরে তিনি রেঁস্তোরার একজন ওয়েটার থেকে বর্তমানে চেংতু শহরের থানদুর হোটেলের জেনারেল ম্যানেজার হয়েছেন। এক এক বন্ধু নিজের মতো চীনে চমত্কার জীবন উপভোগ করছেন দেখে ম্যাচিল আবেগের সঙ্গে বলেন, 'চীনের শহরের রাস্তায় রাস্তায় ভরা প্রাণশক্তি ও সুযোগ প্রমাণিত হয়েছে, ওয়েটার ম্যানেজার হতে পারেন। ইউগা কোচ সি.ই.ও হতে পারেন। চীন উন্মুক্ত মনোভাব নিয়ে স্বপ্ন বহনকারীদের গ্রহণ করেছে। চীনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে কেবল একটি সুযোগ আবিষ্কার করে এবং আকড়ে ধরে। আমি বিশ্বাস করি, চীনে ভারত দূতাবাসের গেটের সামনে ভিসা আবেদকদের লাইন আরো লম্বা হবে।'

ম্যাচিল আরো লক্ষ্য করেছেন, উন্মুক্তকরণের প্রক্রিয়ায় চীন সক্রিয়ভাবে নিজের ভূমিকা পরিবর্তন করছে। চীন গ্রহক হওয়ার পাশাপাশি সক্রিয়ভাবে নিজের শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতি সারা বিশ্বের কাছে পরিচয় করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, 'আমি শুনেছি, আমার বাসা ভারতের তামিল নাদু রাজ্যে অবিলম্বে একটি বেতার কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হবে। চীন সারা বিশ্বে চীনা ভাষা শিক্ষার হিড়িক সৃষ্টি করেছে। চীনের শিল্পীরা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে চীনের সংস্কৃতি প্রদর্শন করেন। চীনে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমস সারা বিশ্বের কাছে চীনের উন্মুক্ত মনোভাব দেখিয়েছে। আর্থিক সংকট মোকাবিলায় চীন বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সংকট উত্তীর্ণ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং নিজের বাণিজ্য দল বিদেশে পাঠিয়েছে। আমি মনে করি, চীনের ভূমিকা নিরন্তরভাবে বদলে যাচ্ছে।' (ইয়ু কুয়াং ইউয়ে)

  • সাক্ষাত্কার
  • সর্বশেষ সংবাদ
  • অন-লাইন জরীপ
     
    © China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
    16A Shijingshan Road, Beijing, China