v চীনের বিশ্ব কোষv চীন আন্তর্জাতিক বেতারv বাংলা বিভাগ
গভীর পাহাড়ের "বসন্তকালীন মুকুলের গান"
2009-07-07 22:13:20
চীনে "বসন্ত মুকুল পরিকল্পনা" চালু হচ্ছে । পরিকল্পনাটি দরিদ্র অঞ্চলের স্কুলচ্যুত মেয়েকে আবার স্কুলে ফিরে যেতে সাহায্য করার একটি কল্যাণকর প্রকল্প । ১৯৮৯ সালে প্রকল্পটি চালু হয় । তখন থেকে এ পযন্ত ২০ বছর পার হয়ে গেছে । সে সময়কালের ছোট ছোট মুকুল সুন্দর ফুলে পরিণত হয়েছে । যে মেয়েরা সবচেয়ে আগে আর্থিক সাহায্য গ্রহণ করতো তারা ইতোমধ্যেই কর্মস্থলে দরিদ্র অঞ্চলের শিক্ষা ও চিকিত্সা অবস্থা পরিবর্তন করার একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তিতে পরিণত হয়েছে ।

যে গানটি শুনিয়েছেন তারা চীনের কুয়াংসি চুয়াং স্বায়তশাসিত অঞ্চলের রোংসুই মিয়াও স্বায়তশাসিত জেলার পেশদার শিক্ষা কেন্দ্রের ছাত্রছাত্রীরা । সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ১৫০০মিটার উঁচু রোংসুই জেলায় যুগযুগ ধরে মিয়াও ও তুংসহ কয়েকটি সংখ্যালঘুজাতি বসবাস করছে । তারা আন্তরিক ও অতিথিপরায়ণ এবং নাচগান প্রিয় । তারা সবসময় মধুর গান দিয়ে চার দিকের অতিথিকে স্বাগত জানান । কিন্তু গভীর পাহাড়ী এলাকায় বসবাস করার কারণে এখানকার অর্থনৈতিক অবস্থা পশ্চাদপদ ছিল, এখানকার মানুষ বাইরের বিশ্ব সম্পর্কে কম জানেন । বিশেষ করে পুরানো ধারণার প্রভাবে এখানকার মেয়েরা স্কুলে শিক্ষা লাভ করতে পারত না ।

হুয়াং চিংমেই এমন অবস্থায়ই বড় হয়েছে । তার বাড়ি রোংসুই জেলার গভীর পাহাড়ী এলাকার একটি ছোট গ্রামে । গাড়িতে করে তার বাড়ি থেকে জেলানগরে যেতে ৪ ঘন্টা লাগে । হুয়াং চিংমেইর ৫জন ভাইবোন আছে । তারা সবাই স্কুলে লেখাপড়া করে । তাদের স্কুলফি এবং সংসার বাবামার ওপর একটি ভারী বোঝা । হুয়াং চিংমেই জানান, সে সময় তার বাবার শুকর ও গরু লালনপালন করে যে আয় হয় সে আয় এবং বড় বোনের অতি অল্প বেতনের ওপর নির্ভর করে তাদের সংসার মোটামুটি চলতো। এ সম্পর্কে হুয়াং চিংমেই বলেন, সংসারের জন্য আমার বাবা খুবই ব্যস্ত ছিলেন । তিনি অনেক শুকর ও গরু লালনপালন করেছেন । আমাদের স্কুল ফির জন্য প্রতি বছর তিনি ৯টি শুকর ও দুটি গরু বিক্রি করতেন । একটি গ্রামীন পরিবারের পক্ষে এটা সহজ ব্যাপার নয় । বড় বোন ছাড়া আমরা সবাই স্কুলে লেখাপড়া করছিলাম । ১৮ বছর বয়সেই বড় বোন কাজ করে উপার্জন করতে শুরু করে । সেসময় আমরা ভাইবোনরা এক সঙ্গে তার ১৪৭ ইউয়ান বেতন ভোগ করতাম ।

১৯৯৩ সালে হুয়াং চিংমেই রোংসুই জেলার সংখ্যালঘু জাতি মাধ্যমিক স্কুলের প্রথম মেয়েদের ক্লাসে ভর্তি হয় । বেড়ে যাওয়া স্কুল ফির কারণে তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হয় । তিন বছর পর বাবা গুরুতর রোগে আক্রান্ত হন এবং বড় বোনের বেতন ঠিক সময় না পাওয়ায় তাদের অর্থনৈতিক উত্স চ্ছিন্ন হয়ে যায় ।যার ফলে হুয়াং চিংমেইর লেখাপড়াও প্রায় বন্ধ হতে বসে । কিন্তু তাহলেও হুয়াং চিনমেই নিজের লেখাপড়ার স্বপ্ন পরিত্যাগ করেননি । এ সম্পর্কে তিনি বলেন, শুধু শুকর ও গরু লালনপালনের ওপর নির্ভর করে যথেষ্ট নয় ।এটা আমাদের বেড়ে যাওয়া ব্যয় মেটাতে পারে না । বাবা মা ও বড় বোন যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়েছেন । যা পান এবং যা ধার নিতে পারেন সে সব বাবার চিকিত্সায় ব্যবহার করা হয়েছে । আমি বাধ্য হয়ে ২০ ইউয়ান ধার করে স্কুলে যাই । এমন অবস্থার সম্মুখীন হলেও আমি লেখাপড়া ছেড়ে দেইনি ।

এই ধার করা ২০ ইউয়ান হুয়াং চিংমেইর সারা জীবন পরিবর্তন করেছে । সে সময় চীনা শিশু তহবিল সংস্থা রোংসুই জেলায় " বসন্তকালীন মুকুল পরিকল্পনা"র বাস্তবায়ন পরীক্ষা করছিল । তহবিল সংস্থার মহাসচিব লি চিকুয়াং প্রথম মেয়েদের ক্লাসে ৮টি ছাত্রীর বক্তব্য শুনেছেন । তারা যারযার লেখাপড়ার স্বপ্ন এবং নিজের অসুবিধা ও কষ্টের কথা ব্যক্ত করেছে । হুয়াং চিংমেই ৮জনের মধ্যে একজন । ৬২ বছর বয়সী লি চিকুয়াং স্মরণ করে বলেন, তারা শিক্ষকের কথা , তাদের নিজের কথা এবং পরিবারের কথা বলেছে । তাদের লেখাপড়ার স্বপ্ন তাদের শিক্ষকের মনোভাবে আমি খুব মুগ্ধ হয়েছি । একজন দাতব্যকর্মী হিসেবে আমাদের তাদের সাহায্য করার দায়িত্ব আছে ।

লি চিকুয়াং মেয়েদের বক্তব্য শুনেরোংসুই সংখ্যালঘু জাতি মাধ্যমিক স্কুলের মেয়েদের " বসন্তকালী মুকুল পরিকল্পনায়" অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন । এছাড়াও তিনি ব্যক্তিগতভাবে হুয়াং চিনমেইকে আর্থিক সাহায্য করার সিদ্ধান্তও নিয়েছেন । ১৩ বছর পর পুনরায় সাক্ষাতের সময় হুয়াং চিংমেই চাচা লি চিকুয়াংকে বলেন, যখন আপনি আমাকে "পরিকল্পনার"আওতায় অন্তর্ভুক্ত করেন তখন আমি বুঝেছি সে সময় থেকেই আমার ভাগ্য পরিবর্তন শুরু হয়েছে । আমি উচ্চ শিক্ষা লাভের মাধ্যমে জ্ঞান ও কলাকৌশল লাভ করতে পারব ।যার ফলে আমার জীবন-দৃষ্টিভঙ্গী ও মূল্যবোধেরও পরিবর্তন হয়েছে । আমরা জানি, সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছে । নিজের গুণগতমানের উন্নতি হলে সমাজের সঙ্গে নিজের সঙ্গতিকে ধরে রাখতে পারব ।

লি চিকুয়াংয়ের কাছে পাঠানো চিঠিতে হুয়াং চিংমেই লিখেছিলেন, জীবনযাত্রার পথ মন্থর । সারা জীবন কষ্ট ও অসুবিধার সম্মুখীন হতে পারি । আমি দৃঢ়তার সঙ্গে আসুবিধা ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়ে মোকাবিলা করবো । আমি ভাগ্যের সামনে নত স্বীকার করব না ।

২০০০ সালে হুয়াং চিংমেই শ্রেষ্ঠ ফলাফল নিয়ে শিক্ষক স্কুল থেকে স্নাতক হয়ে পাহাড়ী এলাকায় প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা হয়েছেন । তিনি ছেলেমেয়েদের নাচগান শেখান , বাইরের বিশ্ব সম্পর্কে বর্ণনা করেন এবং নিজের বড় হওয়ার গল্প শোনান । তিনি ছাত্রছাত্রীদের জানান,ভবিষ্যত নিজের হাতেই, লেখাপড়ার সুযোগ নিজের প্রচেষ্টায় লাভ করতে হবে । ২৮ বছর বয়সী হুয়াং চিংমেই এখন গানের শিক্ষক । তার ছাত্রছাত্রীরা পরে কিন্টারগার্টেনের শিক্ষক হবে । তিনি চান ,তার"জ্ঞান বিজ্ঞানের মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তনের"কাহিনী আরও বেশি লোকের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে ।

বর্তমান চীনে ১৮ লাখ লোক হুয়াং চিংমেইর মতো " বসন্তকালীন মুকুল পরিকল্পনার" সাহায্য গ্রহণ করছে । ১৯৮৯ সালে চালু হওয়ার পর পরিকল্পনাটি মোট ৮০ কোটি রেনমিনপি সাহায্য পেয়েছে । এ অর্থে প্রায় ৮০০টি স্কুল গড়ে তোলা হয়েছে । নিজের রচনায় "বসন্তকালীন মুকুলের গানে" হুয়াং চিংমেই লিখেছেন , বসন্তকালের বাতাস ও বৃষ্টিতে বসন্তকালীন মুকুল বীজ বপন করেছে এবং ফসলের আশা অর্জন করেছে । আল্লাহ একটি দরজা বন্ধ করেছে বটে,তবে অন্য একটি জানালা খুলে দিয়েছে । যাতে সকালের উষা দেখা যায় এবং দিক দিগন্ত খুঁজে বের করা যায় । সেই প্রথম আলোকে পৃথিবীর দুঃখদুর্দশা মুছে ফেলেছে । সেটা হল পুনরায় জীবন তৈরীর অমোঘ শক্তি ।

  • সাক্ষাত্কার
  • সর্বশেষ সংবাদ
  • অন-লাইন জরীপ
     
    © China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
    16A Shijingshan Road, Beijing, China