শান সি প্রদেশের তা থোং শহর হচ্ছে ২ হাজার ৪শ' বছরের পুরানো একটি ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক নগর। প্রাচীনকালের বিপুল সংখ্যক ভাস্কর্য পুরাকীর্তি থাকার কারণে এটি 'চীনের ভাস্কর্য নগর' বলে পরিচিত। পাহাড় জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ১ হাজার ৫শ' বছরের পুরানো দৃষ্টি নন্দন সব টেরাকোটা শিল্প সমৃদ্ধ এ শহরটিকে তুন হুয়াংয়ের মোও কাও পাহাড় জুড়ে থাকা টেরাকোটা এবং লুও ইয়াং-এর লোং মেন পাহাড় জুড়ে থাকা টেরাকোটার সঙ্গে 'চীনের ৩টি পাহাড় জুড়ে থাকা মূল্যবান টেরাকোটা শিল্পের ঐশ্বর্যভান্ডার' বলে গণ্য করা হয়। আজকের অনুষ্ঠানে আমি আপনাদের ইয়ুন কাং পাহাড় জুড়ে থাকা টেরাকোটা দেখাতে নিয়ে যাবো।
তা থোং শহর হচ্ছে চীন সরকারের প্রথম দফায় নির্ধারিত ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক নগরগুলোর মধ্যে অন্যতম। বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে ইতিহাসে তা থোং শহরটিকে সব সময়ই উত্তর মহাপ্রাচীরের যাযাবর সংখ্যালঘু জাতির এবং মধ্য চীনের সংস্কৃতির মিলন-কেন্দ্র ও গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি বলে বিবেচনা করা হতো। পেই ওয়েই সময়পর্বে অর্থাত খ্রিস্টাব্দ ৩৮৬ থেকে ৫৩৪ বছর পর্যন্ত প্রায় ১শ' বছর তা থোং এ অঞ্চলের রাজধানী ছিল। এর পরের লিয়াও চিন সময়পর্বে ২শ'রও বেশী বছর ছিল সহায়ক রাজধানী। ১২৭৭ সালে ইতালির বিখ্যাত পর্যটক মার্কো পোলো তা থোং-এ এসেছিলেন এবং 'তা থোংকে দেখার পর তিনি এটিকে একটি মহত্ ও সুন্দর শহর' বলে বর্ণনা করেছেন। সুন্দর এই শহরের সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে চোখ ধাধানো সব সূক্ষ্ণ ভাস্কর্য শিল্প। তা থোং শহরের পশ্চিম দিকে অবস্থিত ইয়ুন কাং পাহাড় জুড়ে থাকা টেরাকোটা হচ্ছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ। ইয়ুন কাং পাহাড় জুড়ে থাকা টেরাকোটা সংক্রান্ত গবেষণালয়ের গাইড ওয়াং চিয়া ব্যাখ্যা করে বলেন,
পুরো ইয়ুন কাং পাহাড় জুড়ে টেরাকোটার অঞ্চলটি তা থোং শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে। পাহাড় জুড়ে থাকা টেরাকোটা'র দৈর্ঘ্য পূর্ব থেকে পশ্চিম পর্যন্ত ১ কিলোমিটার। বর্তমানে প্রধান পাহাড়ে টেরাকোটার গুহা ৪৫টি এবং পাহাড়ের বাইরের টেরাকোটা সমৃদ্ধ ছোট গুহা বা ছোট পবিত্র আলয় রয়েছে ২০৯টি। এখানে বড় ও ছোট আকারের মূর্তি রয়েছে ৫ হাজারেরও বেশি।
ইয়ুন কাং পাহাড় জুড়ে থাকা টেরাকোটার বৃহত্তম ভাস্কর্যের উচ্চতা প্রায় ১৭ মিটার এবং সবচেয়ে ছোট্টটার উচ্চতা মাত্র ২ সেন্টিমিটার। ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে কোন কোন মূর্তি মনে হয় বিনয়ের অভিব্যক্তিতে বসে রয়েছে, দেখতে সত্যিই তা মানুষের মত। কোন কোন মূর্তি গান গাওয়ার পাশাপাশি নৃত্য ভঙ্গিমার, দেখতে তেজস্বী। কেউ কেউ ঢাক বা ঘন্টা বাজাচ্ছে, কারো হাতে ছোট বাঁশি অথবা কোলে বীনা রয়েছে। মনে হয় তাদের ওপর চাপ নেই এবং জীবন খুব আরামদায়ক। এ সব ভাস্কর্যের চেহারা বা কাপড়ে চীনের প্রাচীনকালের শ্রমজীবির অভিজ্ঞতা ও পরিশ্রমের ছাপ রয়েছে। বুদ্ধমূর্তিগুলো স্পষ্টভাবে রয়েছে বৈদেশিক স্টাইলের সংমিশ্রনের বহিপ্রকাশ। চীনের ঐতিহ্যবাহী খোদাই শিল্পের ভিত্তিতে ভারতীয় শিল্প এবং পারসিয়ান শিল্পের ধারাও এতে মেশানো হয়েছে। এটা চীনের প্রাচীনকালের মানুষের সৃজনশীল শ্রম ও জ্ঞানাজনের সাফল্যের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের সঙ্গে চীনের বন্ধুত্বপূর্ণ যোগাযোগের ঐতিহাসিক নিদর্শনও বটে।
গাইড ওয়াং চিয়া বলেছেন, ইয়ুন কাং পাহাড় জুড়ে থাকা টেরাকোটা চীনের চারুশিল্প ইতিহাসের বিস্ময়। প্রতি বছর তা দেখতে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকার বহু সংখ্যক পর্যটক এখানে আসেন। ওয়াং চিয়া বলেন,
দূর থেকে দেখলে পাহাড়টি খুব উঁচু নয় এবং মাটি দিয়ে তৈরীটিলার মতো। তবে পর্যটকরা পাহাড় জুড়ে থাকা টেরাকোটার ভেতরে গেলে অথবা সামনে আসলে, অবাক হয়ে যান। কারণ, সারা পাহাড় জুড়ে থাকা টেরাকোটার খোদাই কাজ অতন্ত উত্কৃষ্ট ও সুন্দর। বিশেষ করে কিছু কিছু বিদেশী পর্যটক ইয়ুন কাং পাহাড় জুড়ে থাকা টেরাকোটার ভাস্কর্য দেখে বিস্ময়াহয় বিভূত চোখে চেয়ে থাকেন।
পর্যটক লি বিশেষ করে চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে ইয়ুন কাং পাহাড় জুড়ে থাকা টেরাকোটা দেখতে এসেছেন। তিনি বলেন,
এটিকে এক ধরনের বিস্ময়কর প্রতিভা বলা উচিত। প্রথমবার প্রবেশ করেই খুব ভালো লেগে যায় এবং বিস্ময় অভিভুতি হয়ে পড়ি। বৌদ্ধ ধর্ম চীনে আসার এ ধরনের একটি ঐতিহাসিক স্মারক বস্তু রয়েছে। পরবর্তী বংশধরদের জন্য যা রেখে দেয়া হয়েছে, তা খুবই মূল্যবান। ভবিষ্যতের মানুষেরা চীনের ইতিহাসকে দেখতে পারবে। তা হলো ইতিহাস। ইতিহাসের জিনিসের বারবার আবির্ভাব হয় না। সুতরাং তা সংরক্ষণ করতে হবে।
ইয়ুন কাং পাহাড় জুড়ে থাকা টেরাকোটা শিল্প বিশ্বের বিভিন্ন এলাকার পর্যটকদের আকর্ষণ করার পাশাপাশি অনেক শিল্পীদের মনের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলেছে। সম্প্রতি চীনের বিখ্যাত চিত্রকর হান মেই লিন প্রথমবারের মতো ইয়ুন কাং পাহাড় জুড়ে থাকা টেরাকোটা দেখতে এসেছেন। তিনি এবারের পরিদর্শনকে ভাস্কর্য শিল্পের তীর্থযাত্রা হিসেবে দেখেন। তিনি বলেন,
আমার জন্য খুব পরিতাপের বিষয় হলো ২০ বা ৩০ এমনকি ৫০ বছর আগে আমি কেন এখানে আসি নি। আমি অনেক বই পড়েছি, আমার বাসায় ইয়ুন কাং পাহাড় জুড়ে থাকা টেরাকোটা সংক্রান্ত অনেক বই আছে। তবে আজকের মতো এত গভীর অনুভুতি কখনো ছিল না। তার আকার হোক, কাঠামো হোক, আমি মনে করি ইতিহাস আমাদেরকে অনেক অনেক সুন্দর রঙ ও রূপ দিয়েছে। সুতরাং আমার আজকের এ অতি মুগ্ধতার পাশাপাশি আমার এখানে আসতে দেরি হয়েছে বলেও খারাপ লাগছে।
ইয়ুন কাং পাহাড় জুড়ে থাকা টেরাকোটা ছাড়া তা থোং শহরের হুয়া ইয়ান মন্দির ও শান হুয়া মন্দিরসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন স্থানেও হাজার হাজার বছরের ইতিহাস থাকা প্রাচীনকালের ভাস্কর্য শিল্প দেখা যায়। সমৃদ্ধ ভাস্কর্য পুরাকীর্তি নিদর্শন সম্পদ থাকার কারণে চীনের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের ব্যক্তিদের উদ্যোগে সাম্প্রতিককালে তা থোং শহর 'নতুন ইয়ুন কাং পরিকল্পনা'র কাজ শুরু করে দিয়েছে। পরিকল্পনাটির মূল্য লক্ষ্য হলো সার্বিকভাবে ঐতিহাসিক ও আধুনিক ভাস্কর্য শিল্পের পারস্পরিক সৌন্দর্য্য বাড়ানো এবং 'চীনের ভাস্কর্য নগর' তৈরী করা। তা থোং শহরের মেয়র গেং ইয়ান বো বলেন,
তা থোং সবচেয়ে বড় হোক এটা কাম্য নয়। তবে বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব চাই। ভাস্কর্য শিল্পই হচ্ছে এই বৈশিষ্ট্যময় শহরের সবচেয়ে সুন্দর ফুল। চীনের ভাস্কর্য নগর তৈরী করা একটি দীর্ঘমেয়াদী ও কৌশলগত লক্ষ্য। আমরা এবং আমাদের পরের কয়েক বংশধরের নিরলস চেষ্টা এমনকি দেশী-বিদেশী ভাস্কর্য শিল্পীদের মনোযোগ ও সমর্থন দরকার। সার্বিকভাবে চীনের ভাস্কর্য নগর—নতুন ইয়ুন কাং পরিকল্পনার বাস্তবায়ন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় চীনের তা থোংয়ের ভাস্কর্য শিল্প এই সাংস্কৃতিক নেম কার্ড সারা দেশ এবং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে হবে। |