এ চিত্র শিল্পীর নাম চাং তিং । এ বছর তার বয়স ৯৩ বছর হয়েছে । তিনি চীন গণ প্রজাতন্ত্রের প্রতীক ও নয়া চীনের প্রথম ডাক টিকিটের ডিজাইন করেছেন । চাং তিংকে চীনের চারু শিল্পের ইতিহাসের একজন অনন্যসাধারণ চিত্রশিল্পী বলা যায় ।
১৯১৭ সালে উত্তর-পূর্ব চীনের লিয়াও নিং প্রদেশের এক কৃষক পরিবারে চাং তিংয়ের জন্ম । ছোট বেলা থেকেই তিনি ছবি আঁকা পছন্দ করেন। তিনি কোনো শিক্ষকের কাছে চারুকলার ওপর হাতেখড়িও নেন নি । নিজে নিজে ছবি আঁকার কৌশল আয়ত্ত করেছেন । ছোটবেলায় তার আঁকা ছবিগুলো গ্রামবাসীরা খুব পছন্দ করতো এবং নববর্ষ বা উত্সবের সময় ছবিগুলো বাসার দেওয়ালে টাঙ্গিয়ে উপভোগ করতো । কয়েক বছর আগে চীনের কেন্দ্রীয় টেলিভিশন কেন্দ্র সি সি টি ভির সংবাদদাতাকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে তার ছোট বেলার কথা স্মরণ করে চাং তিং বলেন , আমি ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকা পছন্দ করি । সেই সময় আমার বড় ভাইরা স্কুলে পড়তো , তাদের কাছে লেখার জন্য রঙীন চক ছিল । আমার জন্মস্থানের বসতবাড়ির দরজাগুলোর রং কালো ছিল , তাই আমি রঙীন চক দিয়ে কালো দরজার উপর ছবি আঁকতাম ।
চাং তিংয়ের বয়স যখন ১৪বছর , অর্থাত্ ১৯৩১ সালে ১৮ই সেপ্টেম্বর ঘটনা ঘটে । জাপান আক্রমণকারীরা উত্তর-পূর্ব চীনের তিনটি প্রদেশ দখল করে। চাং তিং সে সময় একাই জন্মস্থান ত্যাগ করে পেইচিংয়ে চলে আসেন। তিনি পরীক্ষার মাধ্যমে পেইচিংয়ের একটি চারুকলা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন । জাপানের আক্রমণের বিরুদ্ধে এ সময় চীনারা অনেক প্রতিবাদ কর্মসূচীর আয়োজন করে , কিন্তু চাং তিংয়ের বিদ্যালয়ে এ সব উপেক্ষা করে শিক্ষকরা আগের মতোই ছাত্রছাত্রীদের ফুল আঁকার কৌশল শেখাতে থাকেন । এর জন্য চাং তিং খুব রাগ করেন । মনের ক্ষোভ প্রকাশের জন্য তিনি অন্ধকার সমাজের ওপর অনেক ছবি আঁকেন । ১৯৩৬ সালে তিনি নানচিংয়ে গিয়ে তার পেশাদার ব্যঙ্গচিত্র শিল্পীর জীবন শুরু করেন । চাং তিং জাপানের আক্রমণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানোর জন্য অনেক ব্যঙ্গচিত্র আঁকেন । তাঁর আঁকা অনেক ব্যঙ্গচিত্র বিভিন্ন সাময়িকীতে ছাপা হয় । পত্রিকায় চাং তিংয়ের আঁকা ছবি প্রকাশিত হয় । সেই সময় ব্যঙ্গচিত্র সাময়িকীর সম্পাদকরা চাং তিংয়ের আঁকা ছবির উচ্চ মূল্যায়ন করেন । মনে হলো তারা যেন একটি সোনার খনি আবিষ্কার করেছেন , মাসিক সাময়িকীগুলোতে তার ছবি নিয়মিত ছাপা হতো ।
কয়েক বছর পর চাং তিং তখনকার বিপ্লবী ঘাঁটি ইয়েনানে চলে যান। সেখানে চাং তিং ডিজাইনার হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন । তিনি বিশেষ করে নাচের অনুষ্ঠানের পোশাক , মুখোশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চসয্যার ডিজাইন করেন এবং ইয়েনানের একটি লেখক ক্লাবের কক্ষগুলোর অভ্যন্তরীণ ডিজাইন ও প্রদর্শনী সাজানোর কাজ করেন । তিনি প্রাচীনকালের ঐতিহ্যিক ডিজাইনের সঙ্গে আধুনিকতার সংমিশ্রণে শানসি প্রদেশের এ পাহাড়ী অঞ্চলের বৈশিষ্টময় ফ্যাশন নিয়ে আসেন । চীনের বিখ্যাত কবি আই ছিং বলেছিলেন , চাং তিং যেখানেই যান , আধুনিক প্রবণতা যেন তার সাথে সাথে চলে যায় ।
ইয়েনানে ডিজাইনের অভিজ্ঞতার কল্যাণে নয়া চীন প্রতিষ্ঠার পর নয়া চীনের প্রচার কাজের দায়িত্ব চাং তিংকেই দেয়া হয় । চাং তিংয়ের নেতৃত্বাধীন একটি শিল্পী গ্রুপ চীন গণ প্রজাতন্ত্রের প্রতীক , চীনের রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনের প্রতীক ও চীনের প্রথম কিস্তির ডাক ডিকিট ডিজাইন করে । আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীগুলোতে চীনা প্রদর্শনী কক্ষ ডিজাইনের জন্য চাং তিংকে একাধিকবার বিদেশে পাঠানো হয়। ১৯৫৬ সালে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশ নেয়ার জন্য চীনের প্রদর্শনী কক্ষ হিসেবে চাং তিং বাঁশ দিয়ে একটি ছোট বাগান তৈরী করেন । প্রদর্শনী শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রদর্শনীর একজন দর্শক চাং তিংয়ের তৈরী এ বাগান ক্রয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সেই বছর চাং তিং চীনের চিত্রশিল্পীর প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী পিকাসো'র সঙ্গে সাক্ষাত করেন । চীনের রাজধানী বিমানবন্দরে অনেক দেওয়ালচিত্র চাং তিং ও তার সহকর্মীরা এঁকেছেন ।
চাং তিং চীনের ঐতিহ্যিক চিত্র বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন । চীনের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ইউয়ান ইয়ুন ফু বলেন , আমি মনে করি চীনের ঐতিহ্যিক চিত্রের সংস্কার চাং তিং শুরু করেন । তার আঁকা পাহাড় ও নদীর ছবিতে প্রকৃতির সঙ্গে তার অনুভূতি মিশ্রণ সুষ্পষ্ট । এ ধরনের প্রকাশ শক্তি অন্য চিত্রকর্মে কম দেখা যায়। গত শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে চাং তিং কালি দিয়ে পাহাড় ও নদীসহ প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবি আকঁতে শুরু করেন । চীনের ঐতিহ্যিক ছবিতে কালি দিয়ে এক ধরনের বিশেষ কাগজের উপরে ছবি আঁকার সময় ' সুয়ান চি ' নামের বিশেষ কাগজ কালির পানি চুশার সঙ্গে সঙ্গে কালির রং গাঢ থেকে হালকা হয়ে যায় । ছবিতে গাঢ ও হালকা কালি পাহাড় ও নদীসহ প্রাকৃতিক দৃশ্যের কাছের ও দূরের হিসেবে প্রকাশিত হয়। কিন্তু এ ধরনের ছবি আঁকার পদ্ধতি চীনের ইতিহাসের থান ও সুং রাজবংশের পর ' সুয়ান চি ' কাগজ জনপ্রিয় হওয়ার পরই ব্যবহার করা হয়। পাঁচ হাজার বছর আগে থেকেই চীনে কালি দিয়ে ছবি আঁকা শুরু হয়। তখন ছবিতে কালির রংয়ের পরিবর্তন ছিল না । প্রাচীনকালে মাটির পাত্রের উপর এ ধরনের ছবি আঁকা হতো। বিশ-বাইশ বছর ধরে চাং তিং উত্তর চীনের নদনদী ও পর্বতপাহাড় আঁকার সময় উত্তর চীনের প্রাকৃতিক দৃশ্যের মহত্ব ও প্রাণশক্তি দেখানোর জন্য কালি দিয়ে ছবি আঁকেন । তার আঁকা ছবিগুলোতে কালির হালকা ও গাঢের পরিবর্তন নেই । তিনি কালি দিয়ে দেওয়াল চিত্র ও ব্যঙ্গ চিত্র এঁকেছেন ,তার আগে কোনো চিত্রশিল্পীই কালি-কলম দিয়ে দেওয়ালচিত্র আঁকার সাহস পান নি ।
সম্প্রতি চাং তিংয়ের একটি চিত্রপ্রদর্শনী পেইচিংয়ের রাজপ্রাসাদ যাদুঘরে প্রদর্শিত হয়েছে । এতে তার আঁকা ৪৭টি চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয় । তিনি প্রদর্শিত ১০টি চিত্রকর্ম রাজপ্রাসাদ যাদুঘরকে উপহার দিয়েছেন ।
রাজপ্রাসাদ যাদু ঘরের মহাপরিচালক চেন সিন মিয়াও চাং তিংয়ের চিত্রকর্মের মূল্যায়ন করে বলেন ,চাং তিং হলেন বিংশ শতাব্দীতে চীনের একজন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী। তার প্রায় সত্তর বছরের স্থায়ী ছবি আঁকার জীবনে ঐতিহ্যিক চিত্র , ব্যঙ্গচিত্র , দেওয়ালচিত্র , কলিগ্রাফি , হস্তশিল্প , চিত্রশিল্প শিক্ষা ও তত্ত্ব ক্ষেত্রে চাং তিংয়ের অবদান পেশাদার শিল্পী ও বিশেষজ্ঞদের ব্যাপক স্বীকৃতি পেয়েছে । প্রদর্শনীতে চাং তিং সাংবাদিককে জানান , আমার আঁকা ছবিগুলোতে অনুভূতি ও মমতা প্রকাশ বেশি গুরুত্বপূর্ণ , ছবি আঁকার কৌশল দ্বিতীয় স্থানের । তবে চীনের ৮৫ বছর বয়সী কবি ও অনুবাদক থু আন বলেন , চাং তিংয়ের আঁকা ছবিগুলো প্রকৃতির আত্মার সঙ্গে তার নিজের আত্মা ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বয়ের শিশ্পকর্ম ।
|